হালদা নদী শতভাগ দূষণমুক্ত না হওয়ার চার কারণ

ভূজপুর রাবার ড্যাম, মানিকছড়িতে তামাক চাষ, পোল্ট্রি ও ট্যানারি বর্জ্য, তিন খালের দূষণ

কেশব কুমার বড়ুয়া, হাটহাজারী | রবিবার , ১ জুন, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী চার কারণে শতভাগ দূষণমুক্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ভূজপুর রাবার ড্যাম, নদীর উজানে মানিকছড়িতে তামাক চাষ, পোল্ট্রি ও ট্যানারি বর্জ্য এবং কাটাখালী, কৃষ্ণখালী ও খন্দকিয়া খালের দূষণ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হালদা নদীতে ভূজপুর এলাকায় কৃষি কাজের সুবিধার্থে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে রাবার ড্যাম স্থাপন করা হয়েছিল। এই রাবার ড্যামে শুষ্ক মৌসুমে ইরি ও বোরো আবাদের সুবিধা হলেও হালদা নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এমনকি গত শুষ্ক মৌসুমে রাবার ড্যামের কারণে নদীর পাইন্দং যুনীঘাটা এলাকায় নদীর তলদেশে ফাটল দেখা দেয়। অনাবৃষ্টি ও রাবার ড্যামের কারণে হালদার এই অংশে তলদেশে ফাটলের সৃষ্টি হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন। হাটহাজারীর গড়দুয়ারার নয়াহাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর জানান, তিনি হালদা নদী থেকে প্রতি বছর ডিম সংগ্রহ করেন। তাই প্রত্যেক সভাসমাবেশ ও সেমিনারে রাবার ড্যাম সরানোর প্রস্তাব করে আসছেন। মাছের প্রজনন মৌসুমে এর ক্ষতিকর দিক বারবার তুলে ধরেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু না হয়নি। তার প্রশ্ন, রাবার ড্যামের বিষয়ে কার কাছে বললে প্রতিকার পাব?

কাটাখালী, কৃষ্ণখালী ও খন্দকিয়া খালের দূষণের ব্যাপারে ১৪ নং শিকারপুর ইউনিয়নের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান এম লোকমান হাকিম বলেন, এই তিনটি খাল দূষণমুক্ত রাখার জন্য অসংখ্যবার প্রতিবাদ করেছি। এজন্য চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রামে সাবেক জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছিলাম। এই তিনটি খালের কারণে এলাকার চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। কালো দূষিত পানির গন্ধে শুষ্ক মৌসুমে রাস্তা দিয়ে চলাচল কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। খাল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, বিশেষ করে শিশুরা প্রতিনিয়ত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাছাড়া ওইসব খালের দূষিত পানি হালদায় পড়ে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এতে মাছের প্রজননে বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া নদী সংলগ্ন স্থানে করা পোল্ট্রি ফার্মের বর্জ্য ও ইটভাটার কারণে নদী দূষিত হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

সরকারের পক্ষ থেকে হালদা নদীর উজানে মানিকছড়িতে হালদাপাড়ের তামাক চাষিদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সম্প্রতি বিনামূল্যে ছাগল প্রতিপালনের জন্য উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের (২য় পর্যায়) আয়োজনে এসব বিতরণ করা হয়। এতে প্রতিজন চাষিকে ২টি ছাগল, ছাগল প্রতিপালনের একটি ঘর, খাদ্য ও ঔষধ বিতরণ করেন প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. রাজু আহমদ, মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আফরোজ ভুঁইয়া, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান, কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জহির রায়হান ও পরিসংখ্যান কর্মকর্তা রাকেশ বিশ্বাস।

বক্তারা জানান, হালদা নদীর উজানে মানিকছড়ি অংশের দুই পাড়ে অবাধে বিষাক্ত তামাক চাষের ফলে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। ফলে হালদার মূল অংশে ব্যাহত হচ্ছে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন। নদীর জীববৈচিত্র্য, মাছের জীবন ও হালদার পরিবেশ রক্ষায় হালদাপাড়ের তামাক চাষিদের এগিয়ে আসতে হবে।

হালদা গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান এবং হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, হালদা নদীতে ২০১৬ সালে ব্রুড মাছ ডিম না ছাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয় মানিকছড়ি এলাকায় হালদা নদীর তীরে ব্যাপক হারে তামাক চাষকে। ২০১৭ সাল থেকে আইডিএফ এবং পিকেএসএফের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি যৌথভাবে তামাক চাষ বন্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০২১২২ সালের দিকে এখানকার প্রায় ৯৯ ভাগ তামাক চাষিকে মূল ধারার কৃষিকাজে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এ সফলতা তামাক কোম্পানিগুলো মেনে নিতে পারেনি। ২০২৩ সাল থেকে তামাক কোম্পানিগুলো যৌথভাবে এই এলাকার তামাক চাষিদের প্রণোদনা প্রায় চার গুণ বাড়িয়ে দিয়ে আবার তামাক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। তখন থেকে আবার কিছু লোভী কৃষক তামাক চাষে সম্পৃক্ত হন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি পরিদর্শনে গিয়ে দেখলাম, এক ভাগ থেকে আবার প্রায় ২০ ভাগ কৃষক তামাক চাষে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ইতোমধ্যে হালদা নদীর হেরিটেজ গেজেটে হালদা বেসিনে তামাক চাষ বন্ধে সংশোধনী আনার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক চাষ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে হালদা নদীর মৎস্য প্রজনন হেরিটেজ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

উল্লেখিত কারণে হালদার দূষণ শতভাগ কমছে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বিভাগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপিকে কাল যমুনায় ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধঢাকার বদলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করল ৪টি ফ্লাইট