হালদা নদীর তীর থেকে রাজশাহীর মোহনপুর। দুইদিন দুই রাত্রি। সেই ৬৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। কেমন ছিল আমাদের পূর্ব বাংলা। আমাদের জেনারেশন। জন্ম থেকে আমাদের রূপকথার পুরুষ ছিল পাকিস্তানের জাদরেল প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল জেনারেল আইয়ুব খান।
সেই হালদা নদীর পাড়ে আমাদের ছোট গ্রাম রাউজানের গহিরা মোবারক খীল। পাকিস্তানের রাজধানীর রাওয়াল পিন্ডি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের বাড়ির মুরুব্বী জ্যাঠা রুহুল আহমদ চৌধুরী হাক ডাক। আমাদের যে সমস্ত রায়েতী প্রজা ছিল তাদের সবাইকে বাড়ির পিছনের পুকুরে নামিয়ে দিয়েছে কচুরিপানা পরিষ্কার করার জন্য। সব জায়গায় একটি ভয় ভীতি। রাস্তাঘাটে কেউ বিড়ির টুকরা ফেলায় না সেই আইয়ুব খানের ভয় আমি দেখেছি যখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। আমাদের ছোট মনে গভীর রেখাপাত করেছিল কে এই আইয়ুব খান। যার ভয়ে সবাই তটস্থ।
আইয়ুব খানকে নিয়েই আমাদের শৈশব আমাদের কৈশোর গড়ে উঠেছিল। ৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধে তিনি ছিলেন আমাদের রূপকথার রাজা। যুদ্ধের সময় রেডিও পাকিস্তানে সরকার কবির উদ্দিনের ভরা কণ্ঠ আয়বের সেই অগ্নিগর্ভা ভাষণ আমাদের আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আব্বার চাকরির সুবাদে কুমিল্লার লাকসাম অতুল হাই স্কুল বর্তমানে লাকসাম পাইলট হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। একটি মাত্র রেডিও ছিল এক ব্যান্ডের আওয়ামী রেডিও। আব্বার অধীনস্থ তহশিলদার গাফফার সাহেবের সেই সদ্য কেনা এক ব্যান্ডের রেডিওটি। পাড়ার সবাই আমরা ভিড় করতাম সেই আওয়ামী রেডিওর সামনে। পাকিস্তান আর্মির দিল্লি দখল করে ফেলবে আমাদের কী যে আনন্দ। পরবর্তীকালে দেখেছি কি একটি মিথ্যা স্বপ্নে আমরা বিভোর ছিলাম।
সেই ছোটবেলায় আব্বা একদিন আমাদের বললেন আমার আম্মাকে সহ যে আমি বদলি হয়ে গেছি রাজশাহী মোহনপুর ও তানোর থানার সার্কেল ইন্সপেক্টর রেভিনিও হিসাবে। বর্তমানে যে দায়িত্ব পালন করে উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা।
আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, আব্বা আমাদের উৎসাহ দিতে লাগলেন যে বাসার পাশে হাট বা বাজার। তোরা বাজারে যেতে পারবি। আমি আর আমার পিঠাপিঠি ভাই মামুন আমাদের কী উৎসাহ, আনন্দে লাফাচ্ছি বাজারে কত দোকান, সেখানে আমরা যেতে পারব। রাত্রে ঘুম হয় না, দাদি আম্মার আদর স্নেহ আমাদের দুইজনকে ঘিরে, দাদীর মন খারাপ আমরা চলে যাব বহুদূরে।
সেই সময় একদিন এসে গেল, আমাদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে হালদা নদী। সাম্পানে চলে আমাদের হাটহাজারীও দূরে বড় ভাঞ্জিন নামে একটি ঘাট ছিল, দোকানপাট পরিপূর্ণ ছিল, বর্তমানে রাস্তাঘাট উন্নত হওয়ায় এটার কোনো চিহ্ন নেই। রাঙ্গামাটি হাটহাজারী রোডে এই জায়গাটা ছিল দুই থানার লোকদের মিলনমালা। রাউজান হালদা নদীর পাড়ে যারা বাস করত তারা এই ঘাট ব্যবহার করত। বাড়ির সবাই ঘাটে আসলো। আমরা বাঙ পেটারা নিয়ে আমার আম্মাসহ (আপাদমস্তক বোরকা পরিহিত। মাথায় বোরকার টুপি একটু উপরে মধ্যখানে দুইটা ছিদ্র। সেখানে আম্মার চোখ দুটি দেখা যায়)। হালদা নদীতে জোয়ার। সাম্পান ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে আমাদের গ্রাম অদৃশ্য হয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে থেকে। সাম্পানের মাথায় আমরা দুই ভাই বসে আছি। কেউ নদী থেকে জল দিচ্ছে তাদের মরিচ ক্ষেতে, মাঝে মাঝে ডলফিনের ডুব সাঁতার, জেলে পাড়ার মেয়েদের নদীতে গোসল এগুলি দেখতে দেখতে এক সময় বড় ভাঞ্জন ঘাটে আমরা এসে পড়লাম। সেখান থেকে একটি মাইক্রোবাসের মত গাড়ি বর্তমানে নেই, যার পিছনে ছিল দরজা। আমরা মধ্যখানে ফতেয়াবাদ নানা বাড়িতে বিরতি নিয়ে চট্টগ্রাম বটতলী স্টেশন চললাম। বিকেল সাড়ে তিনটায় রাজশাহী বাহাদুরবাদ এক্সপ্রেস ছাড়বে। জগন্নাথপুর স্টেশনে যাবে।
আমরা চৌধুরীহাট স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম নাজিরহাট ট্রেনে চলে আসবো বটতলী স্টেশনে। সেই আব্বার বেডিং, আমাদের বাক্স সব মিলে চারটি লাগেজ স্টেশনের কুলি আমাদের তুলে দিল। সে সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল ট্রেন স্টেশন। নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্ট, অক্সিজেন এগুলো দেখতে দেখতে আমরা বিরাট স্টেশন চট্টগ্রাম বটতলীতে এসে পড়লাম।
চট্টগ্রাম স্টেশন সে সময় জমজমাট ছিল। ট্রেনের গার্ডের সেই সাদা ড্রেস মাথায় হেট এবং হাতে বাঁশি সবুজ পতাকা। ট্রেন ছাড়ার সময় ঘণ্টার ধ্বনি। স্টেশনে হকারদের হাঁক ডাক এক অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য। আমাদের রাজশাহী এঙপ্রেস ছেড়ে দিল। সে সময় ট্রেনে সিট নাম্বার ছিল না। কুলি গামছা দিয়ে জায়গা দখল করে দিত। বকশিশ পেলে ওরা খুশি।
আত্মীয়–স্বজন আমার ফুফা এবং একমাত্র চাচা ওরা আমাদের বিদায় দিতে এসেছিল। আস্তে আস্তে বাঁশির ঘণ্টায় গার্ডের সবুজপতাকা উত্তোলনে রাজশাহী এঙপ্রেস ছুটে চলল। পথের মধ্যে ট্রেনটি পাহাড়তলী, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই সামান্য যাত্রা বিরতি, একমাত্র ট্রেনে ছিল আমাদের উত্তরবঙ্গে যাত্রার একমাত্র বাহন সুতরাং এ সমস্ত স্টেশনে ট্রেনটি থামত। আমরা স্টেশনের নামগুলি মুখস্থ করতাম। তার মধ্যে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল চিনকি আস্তানা মিরসরায়ের পর সেই স্টেশনটি। সে সময় ট্রেনের মধ্যে অন্ধ ভিক্ষুকের গজল, ছন খোলা বাতের বড়ি, বিভিন্ন হকারের শারীরিক কলাকৌশল এবং অঙ্গভঙ্গি আমাদের মুগ্ধ করত। সন্ধ্যার দিকে লাকসামের কত বাতি আমাদের অবাক করলো। ট্রেনটা যখন একটু বাক নিয়ে লাকসাম দেখা গেল দেখলাম শত শত বিদ্যুৎ বাতি ঝলমল করছে। ছোটকালে প্রবাদ কত লাকসাম কত বাতি। এই লাকসামে একদিন আমার হাইস্কুল জীবন চলে যাবে সেটা তো ভাবতে পারেনি।
একেবারে ভোরের দিকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট। তাড়াহুড়া করে আমরা নেমে পড়লাম। একটি স্টিমারে উঠে পড়লাম। শত শত লোক দৌড়াদৌড়ি করে সবাই স্টিমারে সিট নিয়ে নিচ্ছে। স্টিমারের সারেং আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের হাটহাজারী গোড়দুয়ারা আব্বার পূর্ব পরিচিত। আমরা তার কেবিনে বসলাম। রাত্রিতে সাড়ে তিনটা স্টিমার ছেড়ে দিল। ভরাট যমুনা নদী। স্টিমারের সার্চলাইট এদিক–ওদিক ঘুরাঘুরি করছে। সেই এক মনোরম দৃশ্য। ভোর বেলায় আমরা সিরাজগঞ্জে ঘাটে পৌঁছলাম। সেখান থেকে রাজশাহী এক্সপ্রেস। এখানকার ট্রেনের কামরাগুলা বেশ বড়সড়। ব্রডগেজ লাইনের জন্য হয়তো। এটা পরে বুঝেছি। ক্লান্ত দেহ আমাদের, সন্ধ্যার দিকে রাজশাহী পৌঁছলাম। ইতিমধ্যে এক রাত্রি চলে গেছে। রাজশাহী স্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়িতে করে এখানে আবার টমটমো আছে। আমরা একটা পালকি গাড়ি নিলাম বেশ বড়সড়। এই প্রথম সুন্দর পালকি ঘোড়া গাড়ি দেখলাম। সেখান থেকে নওহাটা। ওখান থেকে নদী পার হয়ে গরু গাড়ি নিতে হবে। আমরা বড় নৌকা করে নদী পার হয়ে দুটি গরু গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ির মধ্যে বেডিং বিছিয়ে নিলাম। সবাই শুয়ে পড়লাম। গাড়ির সামনের দিকে ঝুলন্ত হারিকেন বাতি। রাজশাহীর লাল ধুলি মাখা সেই পথ। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছগুলি তাদের রূপ পাল্টিয়ে গেছে ধুলির আস্তরণে। আস্তে আস্তে গরুর গাড়িগুলো চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে হট হট চিৎকার, কোন সময় বেসুরে গলায় গান।
মধ্যরাতে আমরা হরিহর তহশীল অফিসে যাত্রা বিরতি। আমরা ওখানে নেমে পড়লাম। সেখানে রাত্রে খাওয়া। আমাদের জন্য মোরগ জবাই। আমরা দুই ভাই মরিচের ঝালে উঃ আঃ করতে লাগলাম।
তহশিলদার সাহেব আমাদের মরিচের ঝালের জন্য চিৎকার সহ্য করতে পারল না। বলল খোকাবাবুরা গুড় খাবে? সেই গভীর রাত্রিতে কোথা থেকে দুইটি গুড়ের টুকরা আমাদের মুখে তুলে দিল। অনেক বছর হয়ে গেছে, সেই গুড় খাওয়ার দৃশ্য এখনো ভুলা যায় না। একেবারে ভোরবেলায় আমাদের বাসস্থান মোহনপুর থানা হাটরা গ্রামের এক পরিত্যক্ত হিন্দু জমিদার বাড়ি বোধই কৃষ্ণকুমারী সেখানে এসে পৌঁছলাম। এই বাড়িতে আমাদের থাকতে হবে। জমিদার তার বিরাট বাড়ি ফেলে হিন্দুস্তান চলে গেছে, এখন এগুলো পাকিস্তান সরকারের শত্রু সম্পত্তি আর আমার আব্বা এগুলোর সাধারণ ভাষায় কেয়ার টেকার। সেই চট্টগ্রাম থেকে দুই দিন দুই রাত্তির পর রাজশাহীর এই অজ পাড়াগায়ে আমরা এসে পৌঁছলাম। আজকের দিনে রূপকথার মত। এখন তো চট্টগ্রাম থেকে দিনে দিনে পদ্মা সেতু দিয়ে রাজশাহী পৌঁছা যায়। ৭০০০ মাইল দূরে কানাডায় গেছি ১৪ ঘণ্টায়। এ ছিল আমাদের পূর্ব পাকিস্তান আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা।
এই বিরাট বাড়ি। চারিদিকে বন জঙ্গল। বিরাট আম বাগান। বড় বড় পুকুর আমাদের। আমাদের কৌতূহল আমরা বাজার দেখব। আব্বা থেকে পারমিশন নিয়ে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির কিছু দূরে আমরা বাজার দেখতে গেলাম। বাজারে গিয়ে দেখি কিছু দোকানপাট নেই। ছনের ছাউনি দেওয়া কিছু খোলা উন্মুক্ত ঘর। জনবসতি নেই। আমরা একেবারে নিরাশ হয়ে গেলাম। কোথায় আসলাম হালদা নদীর কোলাহল ছেড়ে একেবারে এক বড় জঙ্গলে। আব্বাকে বললাম এটা কি বাজার। আব্বা বললেন গায়ের হাট। আগামীকাল বাজারের দিন সোমবার দেখবি। সত্যিই সে সোমবার আসলো। ছোট ছোট দোকানদারেরা মাথায় মালপত্র নিয়ে এসে বিকেলের দিকে হাট জমে উঠলো। সন্ধ্যার দিকে একেবারে খালি। আমরা আমাদের গ্রামে কালাচাঁদ হাট দেখেছি। হাটের দিন ছাড়াও দোকানপাট অনেক থাকে। এখানে ব্যতিক্রম দেখলাম। যাক আমাকে হাটরা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। এক নতুন পরিবেশ। মানুষগুলো সহজ সরল।
সরকারের আইন কানুনকে ভয় করে। জমিদার বাড়ির ফল, পুকুরের মাছ কেউ স্পর্শ করে না। একদিন ভোর বেলায় একটি বিরাট রুই মাছ লাফ দিয়ে পুকুরের পাড়ে উঠে বসেছে। গ্রামের লোক এত বড় মাছটি পেয়ে আব্বার কাছে নিয়ে আসলো।
বলল স্যার এটা সরকারের মাছ আমরা নিয়ে এসেছি। আমি অবাক হয়ে গেলাম, চাইলে ওরা নিয়ে নিতে পারতো। এই ভোর বেলায় কে দেখেছে, তার পুরো মাছটি আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে। আমার ছোট মনে তাদের এই পবিত্র দেশপ্রেম গভীরভাবে রেখাপাত করলো। কী নিদারুণ সরল মানুষগুলো। আমি এখনো ভাবি কোথায় গেল সেই দিন!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী