দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে গত এক সপ্তাহে ৫টি মা মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় দেড় বছর পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে একের পর এক মা মাছের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে হালদা সংশ্লিষ্টদের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দূষণ বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নদীতে। এদিকে জুন মাস শেষ হলেও এবার কার্প মাছের এ প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রে মা মাছ এখনো ডিম ছাড়েনি। বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এ বছর সবচেয়ে কম ডিম দিয়েছে, যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি। হালদাপাড়ের বাসিন্দা এবং সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ধরে হালদা সংলগ্ন পাঁচটি খাল ও দুটি বিলের দূষণের প্রভাব এখন নদীর পানি ও মাছের ওপর পড়তে শুরু করেছে।
মা মাছের মৃত্যুকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে তুলে ধরে এর অনুসন্ধানে তদন্তের দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, সব বিষয় অনুসন্ধান শেষে এর কারণ জানা যাবে।
গতকাল নদীর রাউজান অংশের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের আজিমের ঘাট সংলগ্ন এলাকা থেকে স্থানীয়রা লোকজন মৃত মা কাতলা মাছটি উদ্ধার করেন। সকালের দিকে স্থানীয়রা কাতলা মাছটিকে নদীর দক্ষিণ দিক থেকে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসতে দেখেন। তবে ভাটার কারণে সকাল ১১টার দিকে সেটি আজিমের ঘাট এলাকায় আটকা পড়ে। পরে স্থানীয়রা সেটি উদ্ধার করেন। মাছটির শরীরে দাগ রয়েছে বলে জানান তারা।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, মাছটির দৈর্ঘ্য ১১৮ সেন্টিমিটার এবং ওজন প্রায় ১৯ কেজি ৩০০ গ্রাম। ২৮ জুন নদীর উত্তর মাদার্শার কুমারখালী ঘাটে একটি মৃত কাতলা মা মাছ ও এর কিছুটা সামনে সুলতানা বাপের ঘাটে আরেকটি মৃত কাতলা মা মাছ ভেসে ওঠে। এক সপ্তাহে হালদা নদী থেকে ৫টি মৃত মা মাছ ও ১টি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে, যা হালদা নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, শাখা খালের মাধ্যমে হালদায় সরাসরি ফেলা হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য ও অন্যান্য শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, পোল্ট্রি বর্জ্য, গৃহস্থালী ও মানববর্জ্য। হালদা ও শাখা খালে অবৈধভাবে জাল, বড়শি ও বিষ ব্যবহার করে মাছ নিধন, অবৈধ বালু উত্তোলন বেড়ে চলেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হালদার জলজ বাস্তুতন্ত্রে। এ অবস্থায় হালদা নদীকে মা মাছ, ডলফিন ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল করতে জরুরি ভিত্তিতে হালদায় দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি চট্টগ্রামের তিন উপজেলা ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। এক সপ্তাহে ৫টি মা মাছ এবং একটি বড় ডলফিন মারা যাওয়ার ঘটনাটি স্বাভাবিক নয় বলে মন্তব্য করে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ আজাদীকে বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে ৫টি মা রুই ও কাতলা মাছ এবং একটি বড় ডলফিন মারা যাওয়ার ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। বিষয়টি আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত শুক্রবার একসাথে দুটি মা মাছ মারা গেছে। আজ (গতকাল) সকালে রাউজানের আজিমের ঘাট এলাকায় একটি কাতলা মা মাছ মারা গেছে। মা মাছটি মরে ভেসে ওঠার খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছি। স্থানীয়রা মাছটি উদ্ধার করেছে। তবে মাছটির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
কী কারণে নদীতে এমন ঘটনা ঘটছে তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে চারটি কারণে চিহ্নিত করেছি। কারণগুলো হলো নদীতে দূষণ বেড়েছে, বিষ প্রয়োগের বিষয়টিও আছে। এছাড়া ভাইরাস বা রোগজনিত কিনা, অথবা বয়সজনিত কারণেও মারা যেতে পারে। বয়সেরও একটি বিষয় আছে। যেহেতু এগুলো একেকটির ওজন ২০ কেজি, ১০ কেজির ওপরে।