হালখাতা

রেজাউল করিম | বুধবার , ৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির চিরায়ত উৎসব পহেলা বৈশাখ। এদিন নতুন বাংলা বছরকে করে নেয়া হয়। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ এই দিনকে ঘিরে সব বাঙালিদের আনন্দ উৎসব। এক কথায় পয়লা বৈশাখ হল অনেক রঙের মিশ্রণ। এই একটি দিন আমরা সব বাঙালিরা নিজেদের ধর্ম ভুলে একসঙ্গে আনন্দ উৎসব করি। সবাই রঙিন কাপড় পরে নিজেদের সাজিয়ে তুলি। একদিকে যেমন সবাই সাজগোজে ব্যস্ত থাকে অন্যদিকে তেমনি বাহারি খাবারের ছড়াছড়ি থাকে। এই দিনকে বর্ননা করার জন্য গানে গানে বলতে ইচ্ছে করে -‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, শাখে শাখে পাখি ডাকে, কত শোভা চারিপাশে’। সত্যি সত্যি এই দিনটিতে রং এবং খাবারের শোভা চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে।

নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হালখাতা। গ্রামেগঞ্জে এখনও ঐতিহ্য মেনে অনেক ব্যবসায়ীই হালখাতার আয়োজন করেন বছরের প্রথম দিন।

অতীতে জমিদারকে খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পূণ্যাহ’ প্রচলিত ছিলো। বছরের প্রথম দিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাকআশাক পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় ‘পূণ্যাহ’ বিলুপ্ত হয়েছে। তবে রয়ে গেছে হালখাতা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ থেকে ১১ মার্চ মোগল সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর তৎকালীন ভারতবর্ষে ‘হালখাতার’ প্রচলন শুরু হয়। মূলত হালখাতা উৎসব উদযাপন করা হতো রাজাদের খাজনা প্রদানের ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠানের রীতি ধরে। কালের পরিক্রমায় ‘পুণ্যাহ’ উৎসব হারিয়ে গেলেও হালখাতা চলছে এখন পর্যন্ত। মোঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকে পয়লা বৈশাখের উদযাপনের প্রথা শুরু হয়। সেই সময় থেকেই দোকানে দোকানে ব্যবসার হিসাব করার জন্য শুরু হয় হালখাতার প্রথা। হাল মানে নতুন, হালখাতা অর্থাৎ নতুন খাতা। পুরনো বছরের সব হিসাব মিটিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় নতুন খাতায় হিসাবনিকেশ করা। এই খাতা তৈরি করা হয় লম্বা সাদা কাগজ বাঁধাই করে আর লাল সালু কাপড়ের মলাটে মুড়িয়ে। হিসাবের এই খাতার প্রতি পাতায় চারটি করে সমান ভাঁজ থাকে। বাম পাশে জমা ও ডান পাশে খরচের হিসাব। লালখাতাকে টালিখাতা নামেও ডাকা হয়।

বাংলা সনের প্রথম দিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার এ প্রক্রিয়া পালন করা হয়। ব্যবসায়ীরা এদিন তাদের দেনাপাওনার হিসাব সমন্বয় করে হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য ক্রেতাদের আগের বছরের সকল পাওনা পরিশোধ করার কথা বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন তাদের মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি থাকতো সুগন্ধি পানের আয়োজন।

একসময় বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটির মলাট লাল। হালখাতার ‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত ও ফারসি উভয় ভাষার সমন্বয় বলে মনে করা হয়। সংস্কৃত ভাষায় হাল শব্দের অর্থ ‘লাঙল’। অপরদিকে ফারসি ভাষায় হাল অর্থ ‘নতুন’। লাঙল বা হালের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর কৃষকেরা উৎপাদিত দ্রব্য বিনিময়ের হিসাব যে খাতায় হিসাব লিখে রাখতো সেটাই হালখাতা হিসেবে পরিচিত ছিল। হালখাতা মানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ। ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধখোকার আঁকাআঁকি
পরবর্তী নিবন্ধঅটুট বন্ধনের ঈদ পুনর্মিলনী