হারিয়ে যাচ্ছে বিয়ে বাড়ির সেই পুরোনো ঐতিহ্য

মারুফ শাহ চৌধুরী | মঙ্গলবার , ১৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৪৯ পূর্বাহ্ণ

হালদা নদীর তীরে। আমার ছেলেবেলার প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠান দেখা। আমার যখন বুদ্ধি হয় মনে হয় তখন বয়স পাঁচ বছর অথবা কিছু বেশি হতে পারে। আমি আমার বাড়িতে প্রথম বিয়ে দেখেছি আমার বড় জেঠাতো ভাই মরহুম আলতাফ মিয়ার বিয়ে। ভাবির বর্তমান বয়স প্রায় ৯০ এর উর্ধ্বে।

আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে তাদের বাড়ি। আমার আব্বার প্রিয় লালু বদ্ধা আমরা তাকে জেটা বলতাম। বেশ লম্বা চওড়া দেহাতি চেহারা। উনি যখন মারা যান আমরা তখন লাকসামে। আব্বা তখন সার্কেল ইন্সপেক্টর রেভিনিউ। এখন এসি ল্যান্ড যে কাজ করে তখন সার্কেল ইন্সপেক্টর রেভিনিউ সেই কাজ করতো। আমরা সেই সময় আব্বার প্রিয় লালু বদ্ধা যার ভালো নাম লাল মিয়া তার মৃত্যু সংবাদ পাই।

আব্বা খুব কেঁদেছিলেন, তার প্রিয় লালবদ্দা কথা মাঝে মাঝে আমাদের বলতেন। তার একটি সন্তানকে আব্বা নিজে রেখেছিলেন তার সহকারী হিসাবে যখন তিনি ময়মনসিংহের জামালপুরে জমিদার রানি হেমন্ত কুমারীর স্টেটের দায়িত্বে ছিলেন। সামসু আমাদের ভাইটির নাম। সেই আমাদের ছোটবেলায় আমি আর আমার ইমিডিয়েট ছোট মামুনকে তিনি কোলে পিঠে নিয়েছেন।

যার কথা বলছিলাম এখনো এই পরিবারের প্রথম বড় ছেলের বিয়ে হচ্ছে। আমাদের কৌতুহলের সীমা নেই। বাড়িতে তাদের অন্দরমহলে চট্টগ্রামের অঁলা যার বিয়ের সময় গ্রামের কিছু মেয়ে সুর করে বর কনে কে নিয়ে গান করে। বর্তমানে এগুলো আর নেই। ওই গানগুলো হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন বাড়ি থেকে দল বেঁধে রাষ্ট্র গান গাওয়ার জন্য বিশেষ করে বিকেলে। যাদের মধ্যে ছিল আল মাসির মা, গুরামিয়া মাঝির বউ, নজনী এইগুলি মনে আছে।

কইন্যা চলে যাচ্ছে শ্বশুর বাড়ি, তাকে আবার নাই ওর যেন নিয়ে যায় সেই বিরহ গাথা এ সমস্ত গানে ফুটে উঠতো। তাদের পারিশ্রমের শুধু পান এবং চা এতেই খুশি। আমাদের একটি সামিয়ানা ছিল আমার আব্বার তৈরি। বাড়ির পাড়ার বিভিন্ন মহল্লায় বিনা পয়সায় এটা দেওয়া হতো। আমার বিভিন্ন বাড়িতে হতে চেয়ার নিয়ে আসা হতো। চেয়ারের নিচে বাড়ির কর্তার নাম লেখা থাকতো। তখন ডেকোরেটরের প্রচলন ছিল না।

আমি ৫০ দশকের কথা বলছি, বড় বড় পিতলের ডেক বিনা পয়সায় বিভিন্ন বাড়ি হতে নিয়ে আসা হতো। তার মধ্যে কাজীবাড়ি মাওলানা সিদ্দিক আহমেদ সাহেব, বক্স আলী চৌধুরী বাড়ির মরহুম ফুজুল কাদের চৌধুরীর ওনার আব্বার নামে একটি পিতলের ডেক ছিল, এবং শহীদ নাজিমুদ্দিনের তাদের একটি ছিল এগুলি নিয়ে আসা হতো স্বেচ্ছাশ্রমে। কাজ শেষ হলে আবার বাড়িতে দিয়ে আসা হতো। এভাবে চলছিল সেই সময়ের বিয়েশাদী এবং গ্রামের উৎসব সমূহ।

আমাদের বড় ভাই তাদের বাড়ির সামনে একটি বড় আমলকি গাছ ছিল। সেখানে সন্ধ্যায় একটি মাইক বাধা হলো। আমরা ছোটরা মাইকের দিকে চেয়ে রইলাম। একদম গাছে উঠে মাইকটি লাগিয়ে দিল। গ্রামোফোনে হিজ মাস্টার ভয়েস রেকর্ডিং একটি কুকুরের ছবি মাইকের পানে তাকিয়ে আছে এগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করত। এই ছোট্ট গ্রামোফোনের ভিতর মানুষ কীভাবে বাস করে এ নিয়ে রাত্রি দিন ভাবতাম। মনে মনে ভাবতাম আমি যদি সেখানে চলে যেতে পারতাম।

সকালবেলা সামিয়ানার নিচে বাড়ির মুরুব্বিরা আসলো। আলতাব বদ্দাকে দুলা সাজাতে বসালো। আমার চাচা মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মাইক নিয়ে বললেন আমরা দুলা অর্থাৎ বর সাজাতে বসেছি আপনারা সবাই তাড়াতাড়ি চলে আসেন। এর মধ্যে অনেকে আসা শুরু করেছে। একজন খাতা নিয়ে বসে আছে। সবাই ২ টাকা ৫ টাকা দিতে লাগলো। ইতিমধ্যে রাত্রিতে পঞ্চশালা নামে একটি মিটিং হয়েছে। আমরা বাচ্চারা পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। মুরুব্বীরা কোন বাড়ি থেকে কতজন যাবে বরযাত্রী তার হিসাব করতে বসলো। ইতিমধ্যে বরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রকার পিঠা দেওয়া হল। আমি একটা পেলাম এবং প্যান্টের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলাম। তাদের বাড়ির পিছনে হালদা নদী সেখান থেকে বরযাত্রী মাদারশা গ্রামে যাবে। আমরা যেতে পারলাম না। সন্ধ্যায় সবাই ফিরল। আনুষ্ঠানিকতা করে বধূকে নামানো হলো। দেখলাম নববধূর গাঁয়ের উপর একটি কাঁথা দেওয়া হল। পিঠের উপর একটি শাল কিছুক্ষণ ধরে রাখা হলো। প্রথম পানিতে পা দিয়ে নববধূ ঘরে প্রবেশ করল। এই সব রীতি এখন নাই বললেই চলে। লালসাল পড়ে আমাদের প্রথম ভাবি বসে আছেন এবং অনবরত কেঁদে চলছেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে শোনা গেল কে যেন বলছে বউ কালো। তিনি একটু শ্যামলা ছিলেন। যাক আমরা এদিকওদিক ঘুরতে লাগলাম।

এই প্রথম আমার জীবনে বিয়ে উৎসব দেখলাম। এক সপ্তাহ ধরে উৎসব চলে। সাত দিন পর নববধূ চলে গেল। আমরা দলে দলে ছোটরা হালদা নদীর পাড়ে গেলাম। সুন্দর সম্পানে করে আমার দেখা প্রথম নববধূ আমাদের ভাবি চলে গেল। নদীতে তখন জোয়ার। গোধূলি লগ্ন। হালদা নদীর কাশবন মৃদু বাতাসে দোলাতে লাগলো। নদীর মাঝে ডলফিনের হঠাৎ লাফিয়ে উঠা এইসব দেখতে দেখতে ঘরে ফিরলাম।

ভাবির ছেলে মেয়েরা অনেক বড় হয়েছে, তাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্মৃতিগুলো হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে। তবে উৎসবগুলো অন্যরূপে আসবে যেখানে থাকবে কৃত্রিমতা। থাকবে না দুলার মারে কইয়া যাইও নাইওর নিবার লাই সেই গ্রাম্য মায়ের বিরহ ব্যথা এই শোক গাথা।

লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্ঞানের পরিধি বাড়াতে বই পড়ুন
পরবর্তী নিবন্ধদক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনপদগুলোকে ঘিরে…