চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতিভাকে আমরা হারিয়েছি অল্প কয়েকদিন আগে, যিনি ছিলেন এক নিভৃতচারী সমাজসেবক, মানবপ্রেমের অনন্য এক বাতিঘর। দুনিয়ার জীবনে তিনি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলেন- যা তাঁকে তাঁর ব্যক্তি জীবনে উন্নতির স্বর্ণশিখরে পৌঁছিয়েছেন। তিনি ছিলেন গর্বিত এক অভিভাবক, সমাজের দুস্থ মানুষের আশার উজ্জ্বল্যমান আলো, স্থাপত্য শিল্পের মহান পথিকৃৎ, মানুষ গড়ার অপরাজেয় কারিগর। আমি তাঁকে চিনেছি, জেনেছি বহুকাল ধরে। একজন সজ্জন ব্যক্তির যতগুলো গুণাগুণ থাকা দরকার- তার সবটুকুই রয়েছে এই মহান মানুষটির মাঝে। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে তাঁর নাড়ির আধার- যেখানে লুকিয়ে রয়েছে তাঁর কৈশোরের বালখিল্যতা, ডানপিঠে দুরন্তপনা-। সেখানেই তিনি আয়োজন করেছেন দুস্থ মানুষদের মিলনমেলা। খেটে খাওয়া মানুষদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল জাহানপুর জাহানারা-মমতাজ বিদ্যাঙ্গনের সবুজ দূর্বাঘাস, হৃদয়তরঙ্গে আন্দোলিত হয়েছে আটলান্টিকের উর্মিমালা। তদীয় পিতা এডভোকেট নুরুল হুদা জনকল্যাণ ট্রাস্টের সু-ব্যবস্থাপনায় ও স্থানীয় অভিযাত্রিক পরিষদের আয়োজনে ও রাউজানের জনকল্যাণমুখী সংগঠন রাউজান ক্লাবের যৌথ মহড়ায় আয়োজন করেছিলেন বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবা। এই মহান মানুষটি সুনিপুণ হাতের ইশারায় সেদিন বুনেছিলেন বাঙ্গালিয়া রমণীর নকশীকাঁথা। একে একে সব মানবতার মহান চিকিৎসকগণকে তিনি একাই বরণ করে নিলেন সহাস্য বদনে। সেদিন যেন তাঁর চোখের চাহনীতে ছিল সাহারা মরুভূমির তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির উন্মাদনা, গরীবদের ঘর্মাক্ত শরীরের লোনা জলের উত্তাল নীরবতা। মাটির মানুষেরা সেদিন চিকিৎসা পেয়ে আনন্দে যেন নেচে উঠেছিলেন এবং আয়োজক ও প্রকৌশলী আলী আশরাফের কাছে কৃতজ্ঞতার বন্যা বইয়ে দিল। মাটির ঘাসের তৈরি মহান আল্লাহর সৃষ্টির অনুপম কৌশলে ভরা ফলন তুলে দিলেন সব স্বাস্থ্যকর্মীকে, সাথে গাড়ীচালকদের- যাকে বলা হয় ক্ষেতের বেগুন। বড় ভাইতুল্য প্রকৌশলী আলী আশরাফ ভাইয়ের সাথে আমার ছিল দীর্ঘদিনের যাপিত সংসার, অকৃত্রিম বন্ধন। আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করায় লজ্জাবতীর মতন ভ্যানগগের শিল্প এঁকে যায় আমার রক্তিম বদনে। প্রিয় আশরাফ ভাই চলে গেছেন মাটির অতলান্ত গভীরে- যেখান থেকে ফেরে না কেউ, যাঁর কিয়ামতের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে এখান থেকেই, ‘তিনি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তিনি (সবার বাঁচার একটি) মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, (তেমনি তাদের মৃত্যুরও) তাঁর কাছে একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে, তারপরও তোমরা সন্দেহ করছো’ – সূরা আল আনয়াম, আয়াত-০২,। নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে তাঁর পরিচিত ছিল খুব বেশি, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাউদার্ণ ইউনিভার্সিটির সহ-উপাচার্য হিসাবে খ্যাতি ছিল শীর্ষে- সবটুকু ছাপিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে গুরুত্ব পাবে তাঁর অর্জিত নেক আমলের দিকটি। দুনিয়াতে যারা জিন্দেগীভর নেক আমল করেছেন, আল্লার বিধান প্রতিষ্ঠায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ছিলেন, নিজের জীবনকে আল-কোরানের রঙে রঙিন করেছেন, তাঁদের মর্যাদা হবে সবচেয়ে বেশি, ‘কিছুসংখ্যক চেহারা সেদিন উজ্জ্বল হবে, তারা সহাস্য ও প্রফুল্ল থাকবে, সেদিন কিছুসংখ্যক চেহারা (কুৎসিত) হবে, তার ওপর ধূলাবালি পড়ে থাকবে, মলিনতায় তা ছেয়ে যাবে-’ সূরা আবাসা- ৩৯,৩৯,৪০,৪১। দ্বীনের একজন খাঁটি দাঈ হিসাবে প্রিয় আশরাফ ভাই জিন্দেগীভর সমাজের অগুণতি মানুষের পাশে থেকেছেন, ‘তার চেয়ে উত্তম কথা আর কোন্ ব্যক্তির হতে পারে, যে মানুষদের আল্লাহতায়ালার দিকে ডাকে এবং সে (নিজেও) নেক কাজ করে এবং বলে, আমি মুসলমানদেরই একজন’- সূরা হা-মী-ম আস সাজদা ৩৩। প্রিয় আশরাফ ভাই ছিলেন আমার অনেক কাছের মানুষ। রাউজান ক্লাবের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন প্রথম সারির অতিথি। কয়েক বছর আগেও তাঁর এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছিলাম তাঁরই মরহুম পিতার ট্রাস্টের নামে। সেখানেও তাঁর বদান্যতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। তিনি চলে গেছেন, রেখে গেছেন পাহাড়সম স্মৃতিময় অবিরাম মুহূর্ত-যেগুলোর স্মরণে কষ্ট দেয়, বেদনার ভাগাড় তোলে অবিরত। হৃদয়ের সর্বত্রই রক্তক্ষরণ হয়- কাঁচা পাকা দাড়ি ভিজে যায় অবিরাম রোদনে। আমরাও সহযাত্রী হব প্রিয় আশরাফ ভাই তোমার সাথে। যেকোন মুহূর্তেই মৃত্যুর সাইরেন বেজে উঠতে পারে, ‘(কিন্তু) কারো (নির্ধারিত) সময় যখন এসে যাবে, তখন আল্লাহতায়ালা কখনোই তাকে (এক মুহূর্ত) অবকাশ দেবেন না; তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) যা কিছু করছো, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন’- সূরা আল মোনাফেকুন -১১। মহান আল্লাহতায়ালা এই মহান মানুষটিকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল