হারবাং ছড়া সেচ প্রকল্প লণ্ডভণ্ড

ভারী বর্ষণ ও উজানের পানির চাপ অপর্যাপ্ত বরাদ্দে ক্ষোভ, নতুন করে টেকসই প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া | শনিবার , ১৫ জুন, ২০২৪ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

চকরিয়ায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল পূর্ব ভারী বর্ষণে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন হারবাং ছড়া সেচ প্রকল্পের। মৌসুমের প্রথম এ ভারী বর্ষণে ছড়াটিতে অতিরিক্ত পানির চাপ পড়ায় বিদ্যমান স্লুইচ গেটের দক্ষিণ পাশের মাটির বাঁধ ভেঙে সেই স্থান দিয়ে বানের মতো পানি চলাচল শুরু করে। এতে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ে পাশের একমাত্র এলজিইডির সড়ক কাম বেড়িবাঁধ, ছড়াটির দক্ষিণাংশের তীরসহ আশপাশের কয়েকশ বসতবাড়ি।

অবশেষে সেই ভাঙন মেরামতের কাজ শুরু করা হয়েছে কয়েকদিন আগে থেকে। যাতে পার্বত্য অববাহিকার এই হারবাং ছড়া দিয়ে নেমে আসা মিঠা পানি ধরে রাখাসহ পানি চলাচলের গতিপথ সঠিকভাবে চলমান থাকে। এজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড বান্দরবানের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করা হয়েছে। যদিওবা জুন ক্লোজিংয়ের শেষদিকে এসে এখনো এই কাজের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এরপরও জনস্বার্থ বিবেচনায় এই কাজটি প্রাথমিকভাবে করতে একজন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বহু বছর আগে হারবাং ইউনিয়নের উত্তর হারবাং লালব্রিজ এলাকায় ছড়ার ওপর দিয়ে উপজেলার বৃহত্তর এই সেচ প্রকল্পটি তথা বিশাল একটি স্লুইচ গেট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যাতে পার্বত্য অববাহিকার উজান থেকে নেমে আসা মিঠা পানি এই স্লুইচ গেট দিয়ে আটকে রাখা যায়। ধরে রাখা সেই পানি দিয়ে হারবাং, বরইতলীসহ আশপাশের কয়েক হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদসহ রকমারী সবজির আবাদ নির্বিঘ্নে করতে পারে। দীর্ঘ কয়েকযুগ ধরে এই সেচ প্রকল্পের অধীনে প্রান্তিক কৃষকেরা তাদের জমিতে নির্বিঘ্নে চাষাবাদ করে আসলেও চলতি বছরের ৪ মে হঠাৎ ভারী বর্ষণের সময় এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপ অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় সেচ প্রকল্পের স্লুইচ গেটের দক্ষিণাংশের মাটির বাঁধ ভেঙে বানের মতো পানি ভাটির দিকে নেমে যেতে থাকে। এতে স্লুইচ গেটের দক্ষিণাংশের বিশাল অংশ, বেড়িবাঁধ কাম এলজিইডির নির্মিত সড়কটির তীর এবং কিছু বসতবাড়ি ভেঙে যায়। এরপর থেকে মূলত হারবাং ছড়া সেচ প্রকল্পটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে চরম ঝুঁকির মুখে পড়ে সড়ক, বেড়িবাঁধ ও আশপাশের কয়েকশত বসতবাড়ি।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, গত একসপ্তাহ আগে থেকে হারবাং ছড়ার এই সেচ প্রকল্পের দক্ষিণাংশের মাটির বাঁধের কাজ শুরু করা হয়েছে। সেখাকে বালুভর্তি লম্বা সাইজের জিও টিউব ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। বর্তমানে ক্ষতস্থানে প্রথমে ডাম্পিং করা হয় বালুভর্তি ১২টি লম্বা জিও টিউব। পরে দ্বিতীয় দফায় ডাম্পিংয়ের জন্য বালুভর্তি করা হচ্ছে আরও ১৬টি লম্বা জিও টিউব। এতে বৃষ্টিপাতের সময় অন্তত ছড়ার তীরের বেড়িবাঁধ কাম এলজিইডির সড়কটি রক্ষা পাবে। তবে স্থানীয় ভুক্তভোগী লোকজন জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের চলমান এই কাজের স্থায়ীত্ব থাকবে না। পানির স্রোতের কারণে এই কাজ কোনো অবস্থাতেই টিকবে না। কারণ হারবাং ছড়াটি বর্ষার সময় অসম্ভব রূদ্রমূর্তি ধারণ করে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে। তাই ছড়াটির দক্ষিণাংশের বেড়িবাঁধ, এলজিইডির সড়কসহ ছড়ার তীরে বসবাসরত কয়েকশত পরিবারকে রক্ষা করতে হলে এখানে নতুন করে এস্টিমেট করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে টেকসইভাবে কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে কোন অবস্থাতেই খরস্রোতা হারবাং ছড়ার পানি চলাচলের গতিপথ ঠিক রাখা যাবে না।

স্থানীয় কৃষক ছাবের আহমদ, দলিলুর রহমানসহ ভুক্তভোগী লোকজন আরও জানান, গেল মে মাসের ৪ তারিখে বর্ষিত ভারী বর্ষণের সময় হঠাৎ করে ছড়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন হাজার হাজার একর জমিতে পাকা ধান মাত্র গোলায় তোলার জন্য মাঠে মাঠে কৃষক ব্যস্ত সময় পার করছিল। কিন্তু হঠাৎ ভারী বর্ষণ, সেইসাথে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন শত শত প্রান্তিক কৃষক। কিন্তু ভাঙনের একমাস পরে কাজ শুরু হলেও সেই কাজ টেকসই হওয়ার মতো না হওয়ায় আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়ছে না। এতে তাদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

হারবাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন মিরাজ দৈনিক আজাদীকে বলেন, গেল মে মাসের শুরুতে অতি ভারী বর্ষণ ও হারবাং ছড়ায় নেমে আসা উজানের পাহাড়ি ঢলের পানিতে কোটি টাকার উৎপাদিত ধানসহ রকমারী সবজি পানিতে তলিয়ে গেলে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হন কৃষকেরা। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড একেবারে কম বরাদ্দ দিয়ে কাজ শুরু করায় বেশ অসন্তুষ্ট আমরা। তাই ভবিষ্যতে এই সেচ প্রকল্পটির দক্ষিণাংশের বেড়িবাঁধ কাম এলজিইডির সড়ক, তীর সংরক্ষণে টেকসইভাবে কাজ বাস্তবায়ন না করলে কিছুই রক্ষা করা যাবে না।

ভুক্তভোগী প্রান্তিক কৃষকসহ স্থানীয় জনগণের এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়োজিত ঠিকাদার আবদুল হাকিম বলেন, পার্বত্য অববাহিকার হারবাং ছড়াটি হচ্ছে খুবই খরস্রোতা। বর্ষাকালে এই ছড়া রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তাই ছড়াটির সেচ প্রকল্পের দক্ষিণাংশের ধসে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি আগের অবস্থায় ফেরাতে হলে পরিকল্পিতভাবে কাজের ডিজাইনসহ এস্টিমেট করে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। তা না হলে খুবই নগণ্য বরাদ্দ দিয়ে এই বাঁধ রক্ষা করা যাবে। তার ওপর বর্তমানে শুরু হয়েছে বর্ষা মৌসুম। এই পরিস্থিতিতে মাত্র ৯১০ লক্ষ টাকার বরাদ্দে এই কাজ কোনভাবেই টেকসই হবে না। এই সেচ প্রকল্পটিকে টেকসই করাসহ আগের অবস্থায় ফেরাতে হলে নতুন করে প্রকল্প নিতে হবে।

ঠিকাদার আবদুল হাকিম আরও জানান, এক টাকা বিল না পেলেও জরুরি বিবেচনায় নিজের পকেটের টাকা খরচ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী ভেঙে যাওয়া অংশে প্রথম দফায় বালুভর্তি লম্বা জিও টিউব ডাম্পিং করা হয়েছে। এর পর দ্বিতীয় দফায় আরও ১৬টি জিও টিউব ডাম্পিংয়ের কাজ চলমান রয়েছে। যাতে অন্তত প্রাথমিকভাবে হলে ভেঙে যাওয়া অংশটি আপাতত রক্ষা পায়।

কাজ তদারকের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে জুন ক্লোজিংয়ের কারণে নতুন করে কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই পূর্বের বাস্তবায়িত কিছু প্রকল্প থেকে বেঁচে যাওয়া সামান্য টাকায় বিল প্রদানের বিপরীতে আপাতত এই কাজটি সম্পাদন করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী দৈনিক আজাদীকে বলেন, পার্বত্য অববাহিকার হারবাং ছড়ার ওপর বিদ্যমান হারবাং ছড়া সেচ প্রকল্পটি যেকোনোভাবেই রক্ষা করতে হবে। এজন্য ছড়ার দক্ষিণাংশের মাটির বাঁধ তথা এলজিইডির সড়কটিও যাতে ঝুঁকির মুখে না পড়ে সেজন্য জনস্বার্থ বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে কিছু কাজ করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। যাতে বেড়িবাঁধ কাম সড়ক, ছড়ার তীরসহ মানুষের ঘরবাড়ি রক্ষা পায়। ইতোমধ্যে সেই পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে এবারও সাড়ে ৩ লাখ চামড়া সংগ্রহের টার্গেট
পরবর্তী নিবন্ধবাজারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেল দুটি গরু