বঙ্গোপাসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় হামুনের অগ্রভাগ গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকা স্পর্শ করেছে। কিছুটা দুর্বল হয়ে ঘূর্ণিঝড়টির মূল অংশ সন্ধ্যা ৭টায় উপকূল অতিক্রম শুরু করে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
হামুন উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে পড়ায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে সংকেত কমিয়ে দিতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। গতকাল রাত সোয়া ১টায় ঘূর্ণিঝড় হামুনের সর্বশেষ বুলেটিনে বলা হয়, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় হামুন রাত ১টায় বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করেছে। উপকূল অতিক্রম করার সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হামুন স্থলভাগের ভেতরে আরো অগ্রসর হবে এবং বৃষ্টি ঝরিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকবে। ঝড়ের বিপদ কমে আসায় সংকেত কমিয়ে এনেছে আবহাওয়া অফিস। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আর মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৫ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। তবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার সব নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আজ চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ হতে পারে। ভারী বর্ষণ হলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির কোথাও কোথাও পাহাড় ধস হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়।
হামুনের প্রভাবে গতকাল দিনভর নগরে বৃষ্টি হয়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস বিকেল ৩টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২২ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং ও বহির্নোঙরের কাজও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে জারি করা ‘এলার্ট–৩’ জারি করা হয়।
আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ২৬ হাজার মানুষ : এদিকে ঘূর্ণিঝড় হামুন’র আঘাতে সৃষ্ট সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্ততি নেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও জেলা প্রশাসন। নগরে ও জেলায় সংস্থা দুটির উদ্যোগে প্রস্তুত করা হয় ১ হাজার ১৫১টি আশ্রয়কেন্দ্র। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নগরে ১৯টি–সহ পুরো জেলায় প্রস্তুত করা হয় ১ হাজার ৩৭টি আশ্রয়কেন্দ্র। এছাড়া চসিক তাদের পরিচালিত ৮১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ১১৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তুতি নেয়। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সারাদিন মাইকিং করে চসিক ও জেলা প্রশাসন। বিশেষ করে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনুরোধ করা হয় দফায় দফায়।
জানা গেছে, ৬ জন সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেতৃত্বে মহানগরে ৬টি সার্কেলের মাধ্যমে ভাগ করে পাহাড় রক্ষায় ও মানুষের জানমাল রক্ষায় জেলা প্রশাসনের কয়েকটি টিম কাজ করে। আকবর শাহ এলাকার বিজয় নগর ও ঝিল– ১, ২, ৩ বেলতলীঘোনা, টাংকির পাহাড়, মতিঝর্ণা, ষোলশহর ও পোড়াকলোনির ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে অভিযান চালিয়ে প্রায় শতাধিক পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়। গত রাত ৯টায় এ রির্পোট লেখাকালীন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২৬ হাজার ৪০৪ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়। এর মধ্যে নগরের আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন ৬৪০ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ হাজার ১৪৭টি গবাদি পশুকে নিয়ে আসে লোকজন। বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মো. ছাইফুল্লাহ মজুমদার। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুকনা খাবার পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ৫০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। গো–খাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা ও শিশু খাদ্যের জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ২ হাজার ১টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৮৭টি অ্যাক্টিভ আছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, পাহাড়ে যাতে মানুষের আর প্রাণ না দিতে হয় সে জন্যে কাজ করছি। মাইকিং থেকে শুরু করে সকলকে সচেতন করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের টিম কাজ করছে। শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। তাদের জন্যে শুকনো খাবার থেকে শুরু করে প্রতিবেলার খাবারের ব্যবস্থা করেছি।
চসিকের প্রস্তুতি : চসিকের উদ্যোগে দামপাড়াস্থ সংস্থাটির বিদ্যুৎ বিভাগে করা জরুরি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। দুর্যোগ না কাটা পর্যন্ত এ কন্ট্রোল রুম থেকে ২৪ ঘণ্টা নগরবাসীকে সেবা দেয়া হবে। কন্ট্রোল রুমের নাম্বর ০২৩৩৩৩৫৩৬৪৯। এছাড়া সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় করণীয় ঠিক করতে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় তিনি ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরত জনগণকে দ্রুত নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিজ–নিজ ওয়ার্ডের ঝুকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থানরত জনসাধারণকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার বিষয়টি আন্তরিকতার সাথে তদারক করার আহ্বান জানান।
জানা গেছে, আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে গতরাতে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে চসিকের টিম কাজ করে।
স্বাস্থ্য বিভাগের ছুটি বাতিল : হামুনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উপকূলীয় এলাকার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়। গতকাল চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘূর্ণিঝড় হামুন’র প্রভাব মোকাবিলায় সিভিল সার্জনের নিয়ন্ত্রণাধীন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়। এতে কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত করা হয়েছে ২৯০টি মেডিকেল টিম। এর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে ২০০টি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যায়ে ৭৫টি, জেনারেল হাসপাতালে ৫টি, আরবান ডিসপেনসারিতে ৯টি ও স্কুল হেলথ ক্লিনিকের একটি টিম রয়েছে।