হাবল টেলিস্কোপ : বিদায়ী লাল সালাম

শঙ্কর প্রসাদ দে | মঙ্গলবার , ৬ জুলাই, ২০২১ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সব’চে বেশি অবদান রেখেছেন গ্যালিলিও গ্যালিলাই। ১৬০৮ সালে চশমার কারিগর লিপেরশাইম চশমা বানাতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন টেলিস্কোপ। গ্যালিলিও লিপেরশাইমের এই টেলিস্কোপটিকে ১৬০৯ সালে নতুন ধাচে পরিমার্জিত করে আধুনিক টেলিস্কোপের জন্ম দিলেন। এরপর থেকে পদার্থবিজ্ঞান আর মহাকাশ বিজ্ঞানের দোর্দণ্ড গতিতে এগিয়ে চলার অবিশ্বাস্য গল্প। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক মানমন্দির। মানমন্দিরের মূল কাজ’ই হলো টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশে দৃশ্যমান গ্রহ, উপগ্রহ, তারা, নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ। বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত টেলিস্কোপের নব নব সংস্করণ হয়েছে। এক পর্যায়ে নতুন চিন্তা এলো বিদ্যমান প্রযুক্তিতে আরো স্বচ্ছভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কৌশল কি? পুকুরে ডুব দিয়ে ক্যামেরায়, পুকুর পাড়ে দাড়ানো কারো ছবি তোলা যায়, তবে তা ষ্পষ্ট হয় না। একই সমস্যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে, টেলিস্কোপে মহাকাশে গ্রহ, উপগ্রহ, তারা, নক্ষত্র দেখা যায় বটে। কিন্তু মেঘের সাথে বিদ্যমান ধুলাবালির কারণে তারা নক্ষত্র পরিষ্কার দেখা যায় না। ১৯৪৬ সালে মহাকাশ বিজ্ঞানী লিমন স্পিৎসার বললেন, টেলিস্কোপকে পৃথিবীর অরবিটে স্থাপন করা গেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এমন ঝকঝকে ছবি পাওয়া যাবে যা কল্পনাতীত। বহু দেনদরবারের পর নাসা মহাশূন্যে মানমন্দির নির্মাণের টাকা পেলেও নভোযান ডিসকোভারী ১৯৮৬ সালে বিধ্বস্ত হওয়ায় একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রকল্পটি থমকে যায়। বিজ্ঞানী ন্যান্সী রোমান দমার পাত্র নন। শেষ পর্যন্ত ২৪ শে এপ্রিল ১৯৯০ মহাকাশে স্থাপন করা হলো অত্যাধুনিক এক টেলিস্কোপ, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৫৯৬ কি: মি: উপরে কক্ষপথে।
এই টেলিস্কোপটি বিজ্ঞানী হাবলের নামে উৎসর্গ করার যৌক্তিক কারণ আছে। ১৮৮৯ সালে জন্ম নেয়া এই মার্কিন বিজ্ঞানী ১৯১০ সালে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯১২ সালে আইনে স্নাতক হন। এ থেকে বোঝা যায় আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু তারা, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ তাঁকে এমন উতলা করে ফেলেছিল যে, মনের অজান্তেই হয়ে উঠেন বিশ্বখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে জার্মানীতে দায়িত্ব পালনের পর নিয়োগ দেয়া হয় দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র প্রকল্পে। একবার নিজ অক্ষে ঘুরে আসার সাথে দৃশ্যমান উজ্জ্বলতার তুলনা করে পৃথিবী থেকে তারাটির দূরত্ব নির্ণয়ের পদ্ধতি বের করে ফেললেন। এরপর পেশ করলেন ‘হাবল ল’ নামে খ্যাত যুগান্তকারী ফর্মূলা। একটি ছায়াপথ পৃথিবী থেকে যতদূরে অবস্থিত তার পশ্চাদপসরণের বেগও তত বেশি। প্রমাণ হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গ্রহ, উপগ্রহ, তারা, নক্ষত্র, গ্যালাঙী ক্রমশ একে অন্যের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে। এবার উল্টো ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করা হলো নিশ্চয়’ই এরা অতীতের দিকে নিকট থেকে নিকটতর ছিল। একেবারে শুরুতে এক বিন্দুতে মিলিত ছিল। ঐ বিন্দুর মধ্যে ১৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। সৃষ্টি হতে লাগল তারা, নক্ষত্র, গ্যালাঙী এবং তা আজো সৃষ্টি হয়ে চলেছে। আজো একে অন্যের থেকে দূরে সরছেতো সরছেই। আজ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সর্বজন গ্রাহ্য তত্ত্ব হলো হাবলের ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্ব।
মহাকাশে হাবল টেলিস্কোপ যা পর্যবেক্ষণ করছে, তার ছবি আসছে পৃথিবীতে। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে ঐসব ছবিও তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে হাবলের কথাই সঠিক। গত ত্রিশ বছর ধরে হাবল টেলিস্কোপ লক্ষ লক্ষ ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। উন্মোচিত হয়েছে লক্ষ ছায়াপথের অস্তিত্ব ও গতিপথ। পৃথিবী সদৃশ গ্রহ আবিষ্কারে মানুষ বহু দূর এগিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হতে যাচ্ছে আরো অনেক পৃথিবী। মানুষের মতো উন্নত প্রাণ ঐ সব পৃথিবীতে থাকুক বা না থাকুক, প্রাণের অস্তিত্ব মিলবেই। হাবল মহাকাশ বিজ্ঞানে হয়ে উঠলেন অক্ষয় অমর।
হাবল টেলিস্কোপ অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সমাহার। মূল যন্ত্রটির নাম ‘পেলোড’। এটি যে সব ছবি সংগ্রহ করে সেগুলো অন্য যন্ত্রপাতিতে সরবরাহ করে। ঐসব যন্ত্রের মধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে মূল্যায়িত হয়ে প্রেরিত হয় পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে। গত কিছুদিন ধরে এই ‘পেলোড’ কম্পিউটার কাজ করছে না। অবশ্য হাবল টেলিস্কোপ শুরুতেই বিপত্তি ঘটিয়ে ছিল। ১৯৯০ সালে প্রেরিত প্রথম ছবিগুলো এলো ঝাপসা, অপাঠনযোগ্য। গবেষণার পর ধরা পড়েছিল, মূল লেন্সটি ছিল ডিফেকটিভ। নতুনভাবে ৭.৯ ফুট ব্যাসার্ধের আরেকটি লেন্স বানানো হলো। নভোযানে করে প্রকৌশলী পৌঁছে গেলেন মহাশূন্য মানমন্দিরে ১৯৯৩ সালে। সফলভাবে লেন্স প্রতিস্থাপন করে ফিরে এলেন পৃথিবীতে। গোটা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখলো মিশন সফল। এবার হাবল যে ছবিগুলো পাঠাতে শুরু করল, সেগুলো এক কথায় অনবদ্য, স্পষ্ট ও সাফল্যে ভরপুর। উন্মোচিত হয়ে চললো ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রহস্য।
কিন্তু ৩১ বছরের ব্যবধানে বর্তমান ত্রুটি সারানো সম্ভব নয় মর্মেই বিজ্ঞানীদের অভিমত। প্রথমেই হাবলের জীবনকাল ন্যূনতম ধরা হয়েছিল ত্রিশ বছর। যন্ত্রপাতি ঠিক থাকলে আরো দশ বছর চালিয়ে নেবার পরিকল্পনা ছিল। দেখা যাচ্ছে তা আর হবার নয়। মূল কম্পিউটার ‘পেলোড’ বিকল হওয়ার সাথে সাথে অকার্যকর হয়ে পড়ছে বিদ্যুত সহ সব ধরনের আনুষাঙ্গিক সিস্টেম। পর্যালোচনা শেষে নাসা ১৩ জুন ২০২১ মিশন পরিত্যক্ত ঘোষণা করলো এবং হাবলের মৃত্যু দিবস ২৮ সেপ্টেম্বর জানানো হবে গুড বাই বিদায় সম্ভাষণ।
হাবল টেলিস্কোপের শবদেহ কি পৃথিবীতে নিয়ে আসা হবে? না কি এটিকে ছেড়ে দেয়া হবে মহাশূন্যে? এ নিয়ে নাসা এখনো দ্বিধান্বিত। কারণ পৃথিবীতে ফেরৎ আনতে গেলে পাঠাতে হবে ডিসকভারির মতো আরেকটি নভোযান। ধারণা করা হচ্ছে এটিকে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বাইরে নিয়ে গিয়ে শূন্যে ঠেলে দেয়া হবে। মৃত হাবল ঘুরবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরের কক্ষপথে। যদি সত্যিই এলিয়েন বলে কোন প্রাণী থেকেই থাকে, তারা বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে ভাববে এমন অদ্ভুৎ যন্ত্র বানাতে পারে এরা কেমন মেধাবী প্রাণী। একটা কথা জোর দিয়ে বলা যায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও প্রাণী থাকলেও মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমত্তার প্রাণী নেই এবং থাকা প্রশ্নাতীত।
লাল সালাম পৃথিবীব্যাপী বহুল প্রচলিত একটি সম্মানসূচক রাজনৈতিক অভিবাদন। লেনিন এই অভিবাদন শব্দগুচ্ছকে দিয়েছেন বিপ্লবী চেতনা। পৃথিবীর এমন কোন প্রান্ত নেই যেখানে কমরেডরা একে অন্যকে লাল সালামে অভিষিক্ত করেনা। সতীর্থের শেষ শবযাত্রায় কমরেডরা লাল সালাম জানায়। বিপ্লবী কর্মযজ্ঞের জন্য হাবল টেলিস্কোপ রক্ত মাংসের মানুষের চেয়েও হাজারো গুন মেধাসম্পন্ন একটি যান্ত্রিক সত্তা। এই যন্ত্রটি মহাকাশ বিজ্ঞানে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, যা সহজে নিভবে না। ইতোমধ্যে নাসা ঘোষণা করেছে, শীঘ্রই পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কি:মি: দূরে বসানো হবে নতুন প্রজন্মের টেলিস্কোপ জেমস ওয়েভ। আমরা এখনো কল্পনা করতে পারিনা, এই বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের শেষ কোথায়! এজন্যই ‘বিদায়ী লাল সালাম’ জানানোই হতে পারে হাবল টেলিস্কোপের প্রতি যথোপযুক্ত শেষ শ্রদ্ধা।

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিম
পরবর্তী নিবন্ধজীববৈচিত্র্যের বিশ্ব পরিবেশ