নিম্নোক্ত চরণগুলি যেন মুহূর্তে ভক্তপ্রাণ হৃদয় মনকে আন্দোলিত করতে পারংগম, ‘কামের কামিনী হৈয়া বৈরাগিনী ত্যাজিলাম পুষ্পের খাট তুই বন্ধু বিহনে হৃদেরি আসনে বসাব কাহারে প্রিয়ে আয় আয় রে ( রত্ন সাগর, পৃঃ ৯, গান নং ২১)। বা ‘হইয়াছি বন্ধুর ভাবে মন তাপে বনবাসী স্বপ্ন দিয়ে গেল কোথায় মাইজভাণ্ডারি পূর্ণ শশী‘। (বই পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮, গান নং ১৬)। অথবা ‘আমার প্রাণ হরে যায় আমার দিল হরে যায় মাইজভাণ্ডারি গুণমনি মোহন বাঁশীর রায়‘। (পূর্বোক্ত, পৃঃ১৭, গান নং ৪৪)। অন্য খানে, ‘ভাণ্ডারে সে বৃন্দাবন প্রেমনিধি গাউস ধন আমিন ধন শশী হোন কহে দাস হাদি হীনে‘। (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৩, গান নং ৩০)। ‘রত্ন সাগর‘ প্রকাশক, শাহসুফী মৌলানা সৈয়দ আবু আহমদ মিয়া আল মাইজভাণ্ডারি (মঃ), সপ্তম সংস্করণ, ২৩ জানুয়ারি ২০০০ সাল,মাইজভাণ্ডারি দরবার শরীফ,বই এ লেখকের নাম উল্লেখ আছে,আরেফ কবি সুফী আল্লামা আব্দুল হাদী কান্চনপুরী (র), ডঃ সেলিম জাহাঙ্গীরের সম্পাদিত, আলোকধারা বুকস প্রকাশিত মাওলানা হাদী মাইজভাণ্ডারি গান সমগ্র‘এর মলাটে উল্লেখ আছে ‘মাইজভাণ্ডারি ত্বরীকায় প্রবর্তক গাউছুল আযম শাহছুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারির সোহবতপ্রাপ্ত খলিফা মাইজভাণ্ডারি গানের আদি রচয়িতা, সুফিকবি মাওলানা সৈয়দ আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী আর দরবারে এবং ভক্তরা এই মহান সুফী সাধককে বাহারুল উলুম হযরত মাওলানা সৈয়দ আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী নামে মাইজভাণ্ডারি গানের একজন আদি রচয়িতা হিসেবে চিনেন। আমরা জানি মাওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী। হযরত গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারি (কঃ) র শানে রচিত এবং তাঁর সম্মুখে স্বীয় কণ্ঠে গীত বহু উচ্চ মার্গীয় তাঁর এ সকল মাইজভাণ্ডারি মরমী গান। এ তরীকা ও হযরত গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর শান ও আজমত বর্ণনা করে রচিত মাধুর্যময়, অর্থবহুল ও স্পষ্ট শব্দ গাঁথুনির এ গান অন্তর্গত ভাবসম্পদের গুণে পরিপূর্ণ, মর্মার্থ ও রূহানী উরুজিয়তের অনন্য সোপান এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে তার রচিত গানগুলো দরবার শরীফ ও আশেক ভক্তদের হৃদয়ের মাঝে স্থান করে নিয়েছে কালের প্রবাহমান ধারায়। তার রচিত ৯৪ টি গান ভাবে, অর্থে ও ছন্দের গাঁথুনিতে অতুলনীয় যা দেহে, মনে, শিহরণ জাগায়। কী যেন এক অমৃতের ছোঁয়ায় আকুল করে যায়। ১৮৭০ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার অন্তর্গত কাঞ্চনপুর গ্রামের এক মৌলভী পরিবারে তার জন্ম। মাইজভাণ্ডারে কেটেছে তার যৌবনোত্তর কাল, সারা জীবন গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর হযরত শাহ সুফী মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ)এবং গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারী হযরত শাহ সুফী মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান (কঃ) এর প্রিয় সান্নিধ্যে। তিনি ফানা ফিস শাইক ছিলেন। তাঁর রচিত পদাবলী সালেকের মনে ইশক ও মহব্বতের প্রেরণায় আল্লাহর দিদার লাভের আকাঙ্ক্ষা ও নিখুঁত সোজা সরল পথের সন্ধান দেয়। হযরত গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর দর্শন ছিল উচ্চ স্তরের যোগাযোগের সোপান। ঐ স্তরে উপনীত হতে পারলে তার কোনো জাগতিক কামনা বাসনা তো থাকেই না বরঞ্চ তার আখেরাতের চির সুখের নীড় জান্নাতের আকাঙ্ক্ষাও অবদমিত হয়। তার খোদা প্রেমে মগ্ন হওয়া ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্য আর থাকে না। এটা হচ্ছে সুফিতত্বের সর্বোচ্চ মোকাম ও ফানাফিল্লার স্তর। তার পবিত্র তাৎপর্যময় ও বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাধর্মী রচিত কালাম সমূহের প্রতিটি হযরত গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর বেলায়েতে মোতলাকা বা অনর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদের পরিচয় বহন করে। যেমন দমে দমে জপরে মন লাইলাহা ইল্লাল্লা ঘটে ঘটে আছে জারী লাইলাহা ইল্লাল্লা। ঘটের সারেঙ্গী বীচে প্রেম রতনের তার লাগাইছে মাওলাজীর নাম জপ লাইলাহা ইল্লাল্লা। সপ্ত রঙি টংগী বীচে রুহুধন কামিনী নাচে প্রেমেতে বিভোর জপ লাইলাহা ইল্লাল্লা। মঞ্জিলে মঞ্জিলে মন গাউসে ধনের সিংহাসন হাদীরে তলকিন করে লাইলাহা ইল্লাল্লা। রত্ন সাগর, পৃঃ ৫, গান নং ১০)। প্রতি দমে, দেহের ভাজে, মস্তিষ্কে, চিন্তার ভাণ্ডে, আল্লাহর নাম মিশে আছে। হাদীকে মাওলা শুধু আকর্ষণ করছে। মনে, প্রাণে, ধ্যানে, প্রতি শ্বাসে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ এই কালামের মূল বাণী। আবার, বিচ্ছেদের অনলে সদা অংগ জ্বলে বিনয় করিগো প্রিয়ে আয় আয় রে তাপের তাপিনী প্রেম সোহাগিনী বিলাপী কুহরী প্রিয়ে আয় আয় রে। একেলা ঘরেতে আসিয়া স্বপ্নেতে লুটিলা যৌবন ধন সেই অবধি মন সদা উচাটন উদাসী হৈয়াছি প্রিয়ে আয় আয় রে। বই পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯, গান নং ২১)। মাওলার বিরহ, অদর্শন, দূরত্ব আর নয়, কাছে এসে দেখার দেয়ার জন্য ভক্তের ব্যথায় ব্যথিত হৃদয়ের করুণ আকুতি। সেই দুঃখ বেদনার কারণে মাওলাকে উচ্চ স্বরে কেঁদে কেঁদে কাছে ডাকছে। কোন্ স্বপনে অন্তরে প্রবেশিয়ে হৃদয় মন হরণ করে উদাসী করলো। মাইজভাণ্ডারির মিলনে অধীর হয়ে সুখ আনন্দ আজ যেন ত্যাগ। হৃদয়ে মাওলা ছাড়া অন্য কারো জায়গা নেই। তাঁর বিচ্ছেদ বেদনায় অসহ্য এ দেহ মন। তাঁর জন্য সব ত্যাগ করতে রাজি এমনকি প্রাণ ও। সেই মাওলার দরশনে তাঁকে খুঁজতে পাহাড় পর্বতের শীর্ষেও উঠতে রাজি। মন্ত্রণা জপে, এ নবীন অধমে, চঞ্চল বয়সে কালে ডাকছে। প্রিয় ভেবে ‘ আয় আয় রে। তাঁর প্রেমে মজে আর মুক্তি মিলল না। সারা জীবন প্রেমের জপনাই হবে সার। তারপরও দরশন চাহে প্রিয়ের। এ গান ভাবে, শব্দের গাঁথুনিতে, আর্থিতে অনন্যসাধারণ। বা যৌবন যুবতী, মোহন মুরতি, যেমন গগনের চান পুষ্পের বাগানে, কুরংগ নয়নে ইঙ্গিতে হরিল প্রাণ। রূপে পূর্ণ শশী, ভাবে প্রেম প্রেয়সী ফুঁকিয়ে মোহন বাঁশী দেব মুনীগণ ভুলাইতে মন হরিষে করএ গান। কামেতে কামিনী, প্রেম ভাব গুণী মুখেতে মধুর হাসি প্রেম ভুরু বানে মধুর গাহনে হরিল হাদীর প্রাণ। (বই পূর্বোক্ত,পৃঃ ২৫, গান নং ৬৮)। এই মহান মনীষী হযরতের প্রেমে এমন ফানা ছিলেন যে হযরত আক্দাসের ইহজাগতিক বিচ্ছেদ বেদনা সহ্য করতে পারবেন না এই আশঙ্কায় তিনি হযরতের ওফাতের সতেরো মাস পূর্বে ১৯০৫ সালের ২০ আগস্ট, ১৮ জমাদিউছ ছানী ১৩২৩ হিজরী মোতাবেক ১৩১৩ বাংলার ৫ ভাদ্র বেছালে হক প্রাপ্ত হন। ড. সেলিম জাহাঙ্গীর সম্পাদিত, আলোকধারা বুকস প্রকাশিত ‘মওলানা হাদী মাইজভাণ্ডারি গান সমগ্র‘ গ্রন্থের পৃঃ ৩৯ এ উল্লেখ আছে, ‘মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ এবং ফয়েজ বরকত সংগীত সাধকদের জীবনে যে কি আমূল পরিবর্তন, অত্যাশ্চর্য বিকাশ ঘটে এ উপমহাদেশে তার উৎকৃষ্ট উজ্জ্বলতম প্রমাণ কিংবদন্তীর সংগীত বিশারদ‘ আধুনিকভারতীয় সংগীতের জনক‘ হযরত আমির খসরু (১২৪৫–১৩২৪)। দিল্লির হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার হাতে বায়াত গ্রহণ আমির খসরুর জীবনে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল সেরূপ মাইজভাণ্ডারে মাওলানা আব্দুল হাদী কাঞ্চনপুরী এবং কবিয়াল রমেশ শীলের জীবনেও দেখি এর সুস্পষ্ট পুনরাবৃত্তি। শুধু তাই নয়, হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার ওফাত আমীর খসরুর জীবনে যে চরম মানসিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, মাওলানা হাদীর জীবনেও দেখি প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমির খসরু চিরতরে বাকরুদ্ধ হয়ে যান এবং মাত্র তিন মাসের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন। মাইজভাণ্ডারে মাওলানা আব্দুল হাদী কাঞ্চনপুরীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় ভিন্ন মাত্রিকতায় প্রায় একই রকম ঘটনা।
জনশ্রুতি আছে যে গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর ওফাতের পূর্বেই মাওলানা হাদীর ওফাতের বিষয়ে গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর একটি কালাম লোকমুখে প্রায় উচ্চারিত– ‘আমার হাদীকে আমার আগেই চলে যেতে হবে‘। গভীর আধ্যাত্মিক রহস্য পূর্ণ এ কালামের বাস্তব প্রতিফলনের ব্যঞ্জনাময় এক চিত্র কল্প ফুটে উঠেছে মাওলানা হাদীর একটি গান ‘আমার মরণকালে স্মরণ কর প্রাণ হরিল দূত শমনে দর্শন দানে কৃপা কর প্রাণ দিব না তুমি বিনে’। ঘটনার গভীরতা আরো বেশি আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যপূর্ণ ও ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে তখন যখন শুনি মুর্শিদ গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারীর ওফাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবেন না এ আশঙ্কায় স্বীয় মুর্শিদের ওফাতের ১৭ মাস পূর্বে তিনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে স্বীয় মৃত্যু কবুল করেন।
লেখক: সংগীতশিল্পী, গবেষক।