ভারত–চীনের ভূ–রাজনৈতিক কৌশলের মাঝে বাংলাদেশের নির্বাচন–২০২৬ গণতন্ত্রের জন্য অগ্নি পরীক্ষা। নির্বাচন মানে উৎসব। নাকি রক্তের হলিখেলা। যার নমুনা দেখতে পেয়েছি ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ড এবং প্রথম আলো অফিসে নারকীয় অগ্নিকাণ্ড। বাংলাদেশ আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখেমুখি হতে যাচ্ছে। যার প্রতিধ্বনি আমরা দেশের ভেতরে–বাইরে সবখান একই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
১১ ডিসেম্বর নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। ১২ডিসেম্বর দিনদুপুরে ঢাকার রাজপথে সত্যবাক–অদম্য সাহসী সর্বসাম্প্রতিক একজন দেশপ্রেমিক শরীফ ওসমান হাদীর মাথায় গুলি ঠেকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে দেশী–বিদেশী হায়ানার দল। শহীদ হাদি গণতন্ত্রকে বুকে ধারণ করে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠতে চেয়েছিলেন। হয়তো তাই হাদি (স্বতন্ত্র প্রার্থী) কে নির্বাচনের আগে প্রাণ দিতে হলো। সেনাবাহিনী–পুলিশ, র্যাব–বিজিপি, গোয়েন্দাদের হাজারো চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘কিলার’ নাই হয়ে গেল। কীভাবে এতো দ্রুত হায়ানার দল বীরদর্পে সীমান্ত পাড়ি দিল। স্বয়ং জানাযায় লাখো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে হাদির ভাই এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গেলো। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিস্থিতি স্থিতিশীল করা। বিশেষ করে যখন দেশ শোকাহত। এর পরপরই বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বহু প্রতীক্ষিত দেশে প্রত্যাবর্তন। এ অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বাড়তি চাপ সামলানো। বেসামরিক নাগরিকদের আইনি সুরক্ষা এবং ঝুঁকিমুক্ত গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়া তৈরী। এ সময়ে বাংলাদেশের সরকারি–বেসরকারি প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর একসঙ্গে এগিয়ে এসে শান্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং উত্তরণ প্রক্রিয়াকে সুরক্ষিত করা অত্যন্ত জরুরি। পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকি না কেন দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে– সোস্যাল মিডিয়ার যুগে মুহূর্তে সব খবর মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। ভারত– চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে আসন্ন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ–অংশগ্রহণ ও উৎসবমুখর দেখতে চায়। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নির্বাচনে যত ভালোভাবে প্রতিনিধিত্ব করবে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। অন্যথায় বাংলাদেশ বড় সুযোগ হাতছাড়া করবে। যদিও নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আয়োজনের দিক থেকে দেশের প্রধান দল (বর্তমানে) বিএনপি– জামায়াত ইসলামী থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বাকী দলগুলো নির্বাচনী ট্রেনে উঠতে স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ১৬ ডিসেম্বর– বিশ্বের পরাশক্তিধর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইটে জানান দিলেন– ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ছিল ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়। যেখানে তিনি বাংলাদেশের নাম একবারও উচ্চারণ করেননি। যার প্রভাব আগুনে ঘি ঢালার মত। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৬ বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। যা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে ভূমিকা রাখবে। দি ওয়ার্ল্ড এহেইড –২০২৬ শিরোনামে– দি ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিনে বাংলাদেশ নিয়ে– ‘নিউ ডাইরেকশন’ নামে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন–২০২৬ নবযুগের হাতছানি বলে আখ্যায়িত করেছেন। রিপোর্টে পতিত আওয়ামী সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে– ১৫ বছর ধরে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশকে ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারের মধ্য দিয়ে পরিচালনা করেছিলেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং রিজার্ভ হ্রাস করেছিলেন। বাঙালি জাতির পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নোবেল জয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে টেকনোক্রোটিক অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন পুরো জাতি ড.মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশে উদ্বেগজনক রাজনৈতিক প্রতিশোধের চক্রটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একটি বিজয়ের দিন।
২০২৪ সালের আগে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল জাল নির্বাচন বলে মনে করেছিলেন। এতে প্রায় কোনও বিরোধী প্রার্থী ছিল না এবং ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৪০%। স্বাধীনতাত্তোর কাল এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশের মানুষ দেখতে পেয়েছেন। যারমধ্যে কিছু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এবং কিছু দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেশিরভাগ নির্বাচনের পরেই কারচুপির ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশিরা আশা করছেন যে, আসন্ন নির্বাচন স্থিতিশীলতার একটি সময়কালের সূচনা করবে। এবার ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তরুণ–প্রজন্ম জ্যান–জি ’র ঢেউ আঁছড়ে পড়তে পারে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ভয়াবহ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কেমন হবে? আমেরিকান শুল্কের কারণে ক্রমবর্ধমান পোশাক খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব একটি বড় সমস্যা।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ড. ইউনূসের অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার–বাংলাদেশ চায়নার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, বাণিজ্য, অবকাঠামো এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এতে ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র ভারত ক্ষুব্ধ হয়েছে। মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ থেকে দক্ষিণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায়– নতুন সরকার তাদের দেশের কাছাকাছি একটি মানবিক সংকট মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে আমেরিকার সাহায্য বন্ধের পর–তাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা এবং ধৈর্য ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনের নানা প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের কাজ করেছে। যা আইএমএফ ঋণ বিতরণের গতিকে প্রভাবিত করবে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের চাপে কঠোরতা ব্যবস্থাকে অজনপ্রিয় করে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশীরা আশা করছে যে– এ দ্বিতীয় জন্মের আশাবাদ এবং প্রতিশ্রুতি তার চেয়ে অনেক বেশি সময় স্থায়ী হবে।
লেখক: প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী।








