আনোয়ারা–কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে কেইপিজেড এলাকায় গত ৭ বছর ধরে চলছে বন্যহাতির তাণ্ডব। হাতিগুলো যেন এলাকাবাসীর সামনে ১০ নং মহাবিপদ সংকেত হয়ে এসেছে। গতকাল বিকালে কেইপিজেডের কারখানা ছুটির সময় বিশালাকৃতির চারটি হাতি সড়কে নেমে এলে শ্রমিকেরা প্রাণের ভয়ে এদিক–সেদিক দৌড়াতে থাকেন। এ সময় কারখানার শ্রমিক ও স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাতির আক্রমণে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন নারীসহ ১৬ জন। আহত হয়েছেন অনেকে। আহতদের মধ্যে একজন বিদেশি বিনিয়োগকারীও রয়েছেন। বর্তমান অবস্থা এমন যে, পথ চলতেও হাতির ভয়। শিল্প কারখানা থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে প্রাণ হাতে দৌড়াতে হয়। বাড়ি বাড়ি পাহারা বসিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন মানুষ। সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক দেখা দেয় পুরো এলাকায়।
হাতি সরাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মাঠে নেমেছেন এলাকাবাসী। মানববন্ধন মিছিল, সভা–সমাবেশ চলছে নিয়মিত। আর কত প্রাণ ঝরলে, আর সম্পদ নষ্ট হলে হাতিগুলো এখান থেকে সরানোর উদ্যোগ নেবে সরকার? এমন প্রশ্ন আনোয়ারা–কর্ণফুলীর দুই লাখ মানুষের এবং কেইপিজেডে কর্মরত ত্রিশ হাজার শ্রমিকের। এমন পরিস্থিতিতে হাতির বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে প্রধান করে ১১ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আজ রোববার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
৭ বছরে ১৬ মৃত্যু, আহত ৫০ : আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় ৭ বছরে হাতির আক্রমণে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশত।
দিনেদুপুরে হাতি : এতদিন সন্ধ্যা নামলে হাতি বের হতো। কিন্তু গতকাল বিকাল ৫টার দিকে দল বেঁধে হাতিগুলো সড়কে নেমে আসে। এ সময় কেইপিজেডের কারখানাগুলো ছুটি হয়। শ্রমিকেরা প্রাণ ভয়ে দৌড়াতে থাকেন।
দেয়াং পাহাড় নিয়ে জাইকার প্রতিবেদন : কেইপিজেড প্রতিষ্ঠার আগে দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পায়ন করতে সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরির জন্য জাপান সরকারের জাইকাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেয়াং পাহাড় নিয়ে জাইকা তাদের সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, এই প্রকল্পের স্থানটি পাহাড়ি এলাকা। এখানে খুব কম গাছ বা সবুজ আচ্ছাদন রয়েছে। এখানে মূল্যবান প্রজাতি বা স্থানীয় প্রাণী এবং গাছপালা নেই। সুতরাং শিল্পায়ন করতে গেলে এখানে পরিবেশে প্রভাব পড়বে না। এ প্রতিবেদনে তৈরির সময় জাইকা দেয়াং পাহাড়ে হাতির অস্তিত্ব বা বসবাসের কথা উল্লেখ করেনি। চট্টগ্রামের বিশেষায়িত এসব অঞ্চল নিয়ে সরকারের কাছে জাইকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তৎকালীন সরকার কেইপিজেডকে শিল্পায়নের জন্য অনুমোদন দেয়।
হাতির বিরুদ্ধে শতাধিক জিডি : হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তরা আনোয়ারা ও কর্ণফুলী থানায় শতাধিক জিডি করেছেন।
চারপাশে সাগর নদী ও খাল : ১১ ইউনিয়ন নিয়ে আনোয়ারা উপজেলা গঠিত হয়েছে। আনোয়ারার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, দক্ষিণে শঙ্খ নদী, পূর্বে চাঁনখালী ও উত্তরে কর্ণফুলী উপজেলা। কর্ণফুলী উপজেলা পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এই উপজেলার পূর্বে শিকলবাহা খাল, উত্তর ও পশ্চিমে কর্ণফুলী নদী, দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলা। তাই উপজেলার চারপাশ সাগর, নদী ও খাল দিয়ে ঘেরা।
দেয়াং পাহাড় : আনোয়ারা উপজেলার বটতলী, বারখাইন ইউনিয়নের হাজিগাঁও, বৈরাগ ইউনিয়ন ও কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে দেয়াং পাহাড় অবস্থিত। এটি একটি লালমাটির ডিবি, উপজেলা ভূমি অফিসে এটার শ্রেণি টিলা হিসেবে রয়েছে, স্থানীয়দের কাছে এটি দেয়াং পাহাড় নামে পরিচিতি হলেও আসলে এটি লাল মাটির টিলা।
দেয়াং পাহাড়ের সাথে বনাঞ্চলের সংযোগ নেই : আনোয়ারা ও কর্ণফুলী দুই উপজেলার চারপাশে সাগর, নদী আর খাল থাকায় কোনো বনাঞ্চলের সাথে এর কানেক্টিভিটি বা সংযোগ নেই। হাতিগুলো খাবারের সন্ধানে চুনতি অভয়ারণ্য থেকে এসে পাহাড়ে অবস্থান করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেইপিজেডের এক কর্মকর্তা বলেন, ৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে দেয়াং পাহাড়ে বনের কোনো কানেক্টিভিটি নেই। আনোয়ারার চারপাশে সাগর ও নদী। তাছাড়া দেয়াং পাহাড়টা ছিল লাল মাটির ডিবি। এখানে বন বিভাগের কোনো বনায়ন নেই। টানেল চালুর আগে থেকে শিল্প সম্ভাবনা বিবেচনায় এখানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। কয়েকটি হাতি এই শিল্প এলাকার মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
দুইশ বছরের ইতিহাসে হাতি দেখেনি মানুষ : স্থানীয় বাসিন্দা ও দক্ষিণ জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ওসমান গনী জানান, বিগত দুইশ বছরের ইতিহাসে দেয়াং পাহাড়ের টিলা কিংবা এই এলাকায় কখনো হাতি বসবাস করেনি। কেইপিজেড প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিগত সাত–আট বছর ধরে হাতিগুলো অবস্থান করা শুরু করেছে। কেননা আগে এখানে পানি ছিল না। এখন কেইপিজেড বড় বড় লেক তৈরি করেছে। গাছপালা রোপণ করে সবুজায়ন করায় হাতিগুলো এসে আর ফিরছে না।
দুই লাখ বাসিন্দা, ৩০ হাজার শ্রমিকের আতংক : স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী শাকিল বিন ইসলাম বলেন, বর্তমানে হাতিগুলো আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বসবাসরত দুই লক্ষাধিক মানুষ এবং কেইপিজেডে কর্মরত ত্রিশ হাজার শ্রমিকের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতিগুলো আমাদের জন্য যেন যমদূত। হাতির কারণে আমরা সারাক্ষণ ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের মধ্যে থাকি।
হাতির কারণে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত : কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানায়, হাতির কারণে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এলাকাবাসী মনে করে, হাতিগুলো কেইপিজেড লালন পালন করছে। এলাকার কোথাও হাতি হামলা করলে লোকজন কেইপিজেড অবরোধ করে, আমাদের কর্মকর্তা–কর্মচারীর ওপর চড়াও হয়। অথচ হাতির আক্রমণে কেইপিজেডের বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে শ্রমিক–কর্মচারীরা আহত হচ্ছে। কেইপিজেডের বাগান ধ্বংস করছে, স্থাপনার ক্ষতি করে যাচ্ছে। হাতির কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ বাড়ছে : হাতির আক্রমণ আর আতঙ্ক থেকে বাঁচার কোনো উপায় না দেখে এলাকাবাসী বিভিন্ন ব্যানারে আন্দোলন করছেন। ইতোমধ্যে হাতিগুলো সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে তারা সোচ্চার হয়েছেন। ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় মইনুদ্দিন বলেন, কোনো অবস্থাতেই আমরা এলাকায় আর হাতি দেখতে চাই না। নিরীহ মানুষের জীবন নিয়ে বন বিভাগ ও প্রশাসনকে ছিনিমিনি খেলতে দেব না। আমরা কঠোর কর্মসূচি দেব।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা, প্রকৃতি সংরক্ষণ ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ শুরু করেছে।