হাতির বিরুদ্ধে শতাধিক অভিযোগ!

আনোয়ারা-কর্ণফুলীতে দেয়াং পাহাড়ের হাতি আতংক, অর্ধশতের বেশি মৃত্যু

এম নুরুল ইসলাম, আনোয়ারা | শনিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ারায় দুই লাখ মানুষের সামনে সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে দাঁড়িয়েছে হাতি। দেয়াং পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া হাতিগুলো লোকালয়ে এসে প্রায়শ মানুষের উপর হামলা ছাড়াও ফসল, ঘর বসতির ক্ষতি সাধন করছে। হাতিগুলো সরাতে প্রায় এক দশক ধরে স্থানীয়রা প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের আকুতি জানালেও এখন পর্যন্ত বাস্তব কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। শুধু তাই নয় হাতির কারণে কেইপিজেড এর ৩০ হাজার শ্রমিক কর্মচারীর দিন কাটে আতঙ্কে। বর্তমানে হাতিগুলো এই শিল্পজোনে অবস্থান নিয়ে নানান স্থাপনা, মাঠের ফসল ও কারখানার সবুজ বনায়নের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কেইপিজেড এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. মুশফিকুর রহমান বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রাম সরকারের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে ২০টিরও বেশি আবেদন করেছেন বলে জানিয়েছেন।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, হাতির বিরুদ্ধে আনোয়ারাকর্ণফুলী থানায় একশতের বেশি জিডি ও অভিযোগ দায়ের করে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে হাতিগুলো সরানোর বিষয়ে বন বিভাগ উদাসীন। এতে আনোয়ারাকর্ণফুলী উপজেলার হাজারো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। বর্তমানে সকালসন্ধ্যা হাতিগুলোর আতংকে দিন কাটে এলাকাবাসীর।

স্থানীয় বৈরাগ ইউনিয়নের গুয়াপঞ্চক গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সাকিল বিন ইসলাম জানান, বিগত ১০১২ বছর ধরে হঠাৎ করে দেয়াং পাহাড়ে বাঁশখালীর বনাঞ্চল থেকে ৩৪টি দলছুট বন্য হাতির আগমন ঘটে দেয়াং পাহাড়ে। হাতিগুলো কিছুদিন দেয়াং পাহাড়ে থেকে আবার বাঁশখালীর পাহাড়ে চলে যেত। এসময় আসা যাওয়ার পথে ক্ষেতের ফসল ও বসতবাড়িতে হামলা করতো। পরবর্তীতে কেইপিজেড শিল্পজোনে ব্যাপক গাছপালা রোপণ করে বাগান তৈরী করার পর বিগত ৫৭ বছর ধরে হাতিগুলো স্থায়ীভাবে কেইপিজেড এর শিল্পজোনের বাগানে অবস্থান করে। দিনে এখানে অবস্থান নিলেও সন্ধ্যা নামলেই এরা লোকালয়ে নেমে আসে এমন কি ভোর আর সকালেও এলাকার গ্রামে গ্রামে বিচরণ করে স্থানীয়দের প্রাণহানি ঘটানোর পাশাপাশি স্থানীয়দের বসতবাড়ি, দোকানপাট, ক্ষেতের ফসল কোনো কিছুই রক্ষা পাচ্ছে না। বর্তমানে হাতিগুলোর কাছে আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ, বারশত, বটতলী, বারখাইন, বরুমচড়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন ও কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ও জুলধা ইউনিযনসহ এ দুই উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ নানাভাবে হাতিগুলোর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। হাতির আক্রমণে দুই উপজেলার অর্ধ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, শত মানুষ পঙ্গু হয়েছেন, এলাকার বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাঠের ফসল কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছে না।

সর্বশেষ গত বুধবার রাত ১১টার দিকে কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের সওদাগর বাড়িতে হাতির আক্রমণে মোহাম্মদ ছৈয়দ প্রকাশ লুতু মিয়া (৫৭) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) হাতির আক্রমণে শিকার হয়েছেন ডে হাই উন কং নামের এক কোরিয়ান বিনিয়োগকারী। তিনি ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে সিসিইউতে চিকিৎসা নিলেও তার শরীরের বিভিন্ন হাড় ভেঙে গেছে বলে জানা গেছে।

তার আগে বন্য হাতির আক্রমণে ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি বরুমচড়ার বাসিন্দা বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম, ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি মাসে বটতলীর ইউনিয়নের মোহাম্মদ সোলায়মান সর্দার (৭৫), ২০২৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর বটতলী ইউনিয়নের বদরুদ্দীন (২৯), ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট বারখাইন ইউনিয়নের তৈলারদ্বীপ বটতল এলাকায় আবু তালেব বাবুল (৬৮), ২০২১ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি বটতলী চাঁপাতলী এলাকায় আজিজ ফকির, ২০২৩ সালের ৫ জুলাই হাজিগাঁও এলাকায় মোহাম্মদ ছাবের আহম্মেদ রেনু (৭৮), ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গুয়াপঞ্চক গ্রামে দেবী রানী (৪৫), ২০২০ সালের ১৫ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের আবদুর রহমান (৭০), ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর বৈরাগ ইউনিয়নে অজ্ঞাত ভারসাম্যহীন ব্যক্তিসহ আনোয়ারা কর্ণফুলীতে আরো অনেক লোক প্রাণ হারান বলে জানা গেছে। সেই সাথে পঙ্গু ও আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক ব্যক্তি।

কেইপিজেডের সহকারীমহাব্যবস্থাপক মো. মুশফিকুর রহমান জানান, হাতির কারণে পুরো কেইজেড এর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মারাত্মভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ শিল্পজোনে হাতিগুলোর কারণে কি কি সমস্যা তৈরী হয়েছে এবং ক্ষতির পরিমাণ ও সমস্যার ঝুঁকির কথা তুলে ধরে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রাম সরকারের উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে ২০টিরও বেশি লিখিত আবেদন করেছি। হাতিগুলো নিয়ে কারখানার ৩০ হাজার শ্রমিক কর্মচারীদের মাঝে আতঙ্ক রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে গত ৬ সেপ্টেম্বর একজন কোরিয়ান বিনিয়োগকারী হামলার শিকার হয়ে অনেকটা জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। হাতিগুলো কখন কোন দিক থেকে আক্রমণ করে তা বুঝে উঠা মুশকিল।

বৈরাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নোযাব আলী বলেন, হাতির কারণে এলাকার মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। চোখের সামনে সাধারণ মানুষ হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছে। বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাঠের ফসল ক্ষতি সাধন করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকবার অবহিত করেছি।

এ ব্যাপারে বনবিভাগের বাঁশখালী জলদি রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জান জানান, বন্যহাতিগুলো তাড়ানো সম্ভব না। আনোয়ারাকর্ণফুলীতে বন্যহাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তদের থানায় অভিযোগের মাধ্যমে তদন্ত করে বনবিভাগ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপানি ঢুকে নষ্ট ১০৬ কোটি টাকার পণ্য
পরবর্তী নিবন্ধ‘পাহাড় ভাঙি পড়লেও এ্যানেই আরার থাকতে হইবো’