তিন মাসের শিশু আরমান জাওয়াদের নিথর দেহ নিয়ে রাস্তায় বসে আছেন পিতা মোহাম্মদ ইব্রাহিম। একবার আকাশের দিকে তাকান, আরেকবার সন্তানের মুখের দিকে। হাতির থাবায় শিশুটির তুলতুলে শরীরের এক পাশে জমে আছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কার কাছে বিচার দেবেন অভাগা পিতা? কী জবাব দেবেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) বেডে কাতরানো স্ত্রীকে?
গত শুক্রবার রাত ১টার দিকে কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ৫ নং ওয়ার্ডের শাহমীরপুর জমাদার পাড়া এলাকায় হাতির আক্রমণে মারা গেছে মো. আরমান জাওয়াদ। সন্তানকে বুকে নিয়ে পালানোর সময় হাতির শুঁড়ের আঘাতে মা খজিমা বেগমের (৩০) কোল থেকে ছিটকে পড়ে শিশুটি। ঘটনাস্থলেই মারা যায় শিশুটি। সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে হাতির আক্রমণে আহত হন খদিজা। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন আনোয়ারা–কর্ণফুলী দুই উপজেলার মানুষ। বিচার দাবিতে সন্তানের নিথর দেহ নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েন বাবা। তার সাথে রাস্তায় নেমে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী পিএবি সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
বিক্ষোভকারীরা দায়িত্ব অবহেলার জন্য বন বিভাগের কর্মকর্তাদের বদলিসহ শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সকাল ৬টা থেকে দৌলতপুর কেইপিজেড গেটের সামনে টানেল সংযোগ সড়ক (পিএবি) অবরোধ করলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। টানা সাড়ে ৬ ঘণ্টা অবরোধ শেষে ৪ দিনের মধ্যে হাতিগুলো সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের লিখিত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে দুপুর সাড়ে ১২টায় অবরোধ তুলে নেন এলাকাবাসী। এর আগে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী কর্ণফুলী সহকারী কমিশনার ভূমি ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের অবরোধ করে রাখেন।
সড়কে লাশ নিয়ে পিতা : তিন মাস আগে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে সুন্দর শিশুপুত্র আরমান জাওয়াদের নিথর দেহ নিয়ে পিতা মোহাম্মদ ইব্রাহীম বিক্ষোভে সামিল হন। এ সময় এলাকাজুড়ে হৃদয় বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়। শিশুটিকে দেখতে শত শত মানুষ ভিড় করেন। এ সময় এলাকাবাসী কান্না ধরে রাখতে পারেননি। ইব্রাহীমের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
মা দেখলেন না সন্তানের মুখ : শুক্ররার মধ্যরাতে বসতঘরে হাতি আক্রমণ করার পর হাতির ভয়ে আরমানকে বুকে নিয়ে পালানোর সময় হাতির আক্রমণে শিশু আরমান ঘটনাস্থলে নিহত হয়। আর মা খাদিজা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাই তিনি দাফনের আগে প্রিয় সন্তানের মুখটি দেখতে পারেননি।
আরমানের বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, শুক্রবার রাতে আমার ঘরে হঠাৎ বন্যহাতি আক্রমণ করে দরজা ভেঙে ফেলে। আমরা প্রাণ বঁাঁচাতে ঘর থেকে পালিয়ে পাশের ঘরে যাওয়ার পথে হাতির আক্রমণে আমার স্ত্রীর কোল থেকে আরমান পড়ে যায়। সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়। হাতির আক্রমণে আমার স্ত্রী গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
রাস্তায় জানাজা : কেইপিজেডের উত্তর গেটে অবরোধকারীরা গতকাল সকাল ১০টায় সড়কে শিশুটির জানাজার নামাজ আদায় করেন। সকাল থেকে চলতে থাকা অবরোধের ফলে বন্ধ হয়ে যায় এই রোডে আনোয়ারা, বাঁশখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, পেকুয়া, মহেশখালীর যানবাহনসহ কেপিজেডে কর্মরত হাজার হাজার কর্মচারী দুর্ভোগে পড়েন। পরে উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ ৪ দিনের মধ্যে হাতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেন স্থানীয়রা। এরপর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
হাতি সরিয়ে নিতে আবার আল্টিমেটাম : হাতি সরিয়ে নেওয়ার আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল আজিম জানান, রমজান মাসেও আনোয়ারা–কর্ণফুলীর দুই লাখ মানুষ হাতির ভয়ে ঘুমাতে পারে না। হাতির আক্রমণে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারালেও বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার ভূমিকা এলাকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসনের লিখিত আশ্বাসের পর আমরা অবরোধ তুলে নিয়েছি। আগামী চার দিনের মধ্যে বন বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তর কথা বলে হাতি অপসারণের জন্য বৈঠক করবে এবং হাতি অপসারণে একাত্ম হয়ে কাজ করবে। যদি আমাদের দাবি পূরণ করা না হয় তাহলে আমরা আনোয়ারা ও কর্ণফুলীবাসী এক হয়ে ঈদের পর বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেব।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. ওয়াসিম আকরাম বলেন, মানুষকে কষ্ট দেওয়া, দুর্ভোগ সৃষ্টি করা আমাদের লক্ষ্য নয়। দীর্ঘদিন ধরে হাতি সরিয়ে নিতে এলাকাবাসীর ব্যানারে আন্দোলন করে যাচ্ছি। সরকারের সব অফিসে ধর্ণা দিয়ে হতাশ হয়ে শেষমেশ এই পথ বেচে নিয়েছি।
কর্ণফুলী থানার ওসি (তদন্ত) শাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, অবরোধকারীদের বুঝানোর পরে প্রশাসন ও বন বিভাগের আশ্বাসে তারা অবরোধ তুলে নিয়েছে।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরা বলেন, হাতির ইস্যু নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে ৪ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
ঘটনার সময় বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরা, কর্ণফুলী থানার ওসি তদন্ত শাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী ও জামতলা শাহমীরপুর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি আবদুল গফুর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
হাতি–মানুষ দ্বন্দ্বের শেষ নেই : আনোয়ারা–কর্ণফুলী দুই উপজেলায় হাতি–মানুষ দ্বন্দ্বের শেষ নেই। হিংস্র হয়ে ওঠা কয়েকটি হাতি থেকে বাঁচতে থানায় শতাধিক জিডি ও অভিযোগ হয়েছে। হাতি নিয়মিত তছনছ করেছে খামার, ফসলের ক্ষেত ও কেইপিজেড শিল্প জোনের বিভিন্ন স্থাপনা। আতংকের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে কেইপিজেডের ৪৭ কারখানার ৩০ হাজার শ্রমিককে। এক দশক ধরে স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে কার্যকর পদক্ষেপের আকুতি জানালেও এখন পর্যন্ত বাস্তব কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক যুগ আগে থেকে বন্যহাতির দল আনোয়ারার কেইপিজেড এলাকায় আসতে শুরু করে। সে সময় কয়েকদিন ঘুরে হাতিগুলো চলে গেলেও বছর পাঁচেক ধরে হাতিগুলো কেইপিজেড, দেয়াং পাহাড়ের বটতলী এলাকায় বসবাস শুরু করে। পাহাড় থেকে হাতিগুলো কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে নেমে তিন শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর ও শত শত একর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি করেছে। সন্ধ্যা হলে হাতিগুলো সড়কে নেমে এসে এলাকায় ঘোরাঘুরি করে। এতে দুই উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ হাতি আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছে।
১৫ ইআরটি সদস্য এখন নেই : কেইপিজেডের ভিতরে নিরাপত্তার জন্য গত অক্টোবর থেকে ১৫ জন ইআরটি সদস্য কাজ করছিল। ৮ মার্চ থেকে তাদের বাদ দিয়েছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বকেয়া রেখেছে তাদের বেতনও। তাদের বেতন পরিশোধ করতে চিঠি দিয়েছেন বাঁশখালী জলদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ। চিঠিতে তিনি পরবর্তী কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে এর দায়–দায়িত্বও তাদেরকে নিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন।
জলদি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, কেইপিজেড পাহারায় ইআরটির ১৫ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করত। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে হাতির জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবক তাদের রয়েছে। এছাড়া বনবিভাগের ৫০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইআরটি সদস্য কাজ করছে প্রতিনিয়ত।
কেইপিজেডের এজিএম মুশফিকুর রহমান জানান, তাদের ভিতরে নিরাপত্তার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০০ জন স্বেচ্ছসেবক রয়েছে। সেজন্য বনবিভাগের ১৫ জন ইআরটি সদস্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা তাদের ৭ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকা বেতন দিয়েছি।