হাটহাজারী মাদরাসার পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হচ্ছে

হেফাজতের ভবিষ্যৎ নিয়েও চলছে আলোচনা

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা বা হাটহাজারী মাদরাসায় বড় ধরনের রদবদল আসার পর সেখানকার পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হচ্ছে? এ প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের কওমি অঙ্গনে। একইসঙ্গে কওমি মাদারাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।
কেউ কেউ বলছেন, ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাদরাসার সর্বোচ্চ পদ মুহতামিম (মহাপরিচালক) থেকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তিনি ১৯৮৪ সাল থেকে টানা ৩৪ বছর পদটিতে ছিলেন। তাঁর পদত্যাগের ফলে শিথিল হয় আন্দোলন এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও এড়ানো সম্ভব হয়। যদিও উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাঁকে পদত্যাগের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় বলে মনে করেন তাঁর ভক্তরা। বিষয়টি নিয়ে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ আছে একটি অংশের। একইসঙ্গে পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর মৃত্যু এ ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দেয়। বিষয়টি আন্দাজ করে অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে হাটহাজারীসহ চার উপজেলায় নজরদারি বাড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে ৫ দফা দাবি আদায়ে মাদরাসার ছাত্ররা টানা দুদিন যে বিক্ষোভ করে, তার পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ, ছাত্রদের অন্যতম দাবি ছিল শাহ আহমদ শফীর ছেলে ও মাদরাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা। আনাস মাদানীর বহিষ্কারের দাবিকে ঘিরে একটি পক্ষ বলছে, দৃশ্যত ছাত্র আন্দোলন হলেও এর পেছনে আছে কর্তৃত্বের লড়াই। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে আনাস মাদানীর সঙ্গে দূরত্ব ছিল হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীর। তাই আনাস মাদানীর সমর্থকরা এ আন্দোলনের জন্য বাবুনগরীর সমর্থকদের দায়ী করেন। অবশ্য আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করে মাদরাসার সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী কমিটি মজলিশে শূরা। যা বাবুনগরীর সঙ্গে তার দূরত্ব আরো বৃদ্ধি করল।
এদিকে গত শনিবার অনুষ্ঠিত মজলিশে শূরায় পূরণ করা হয়নি মুহতামিমের পদটি। এর অন্যতম দাবিদার ছিলেন জুনাইদ বাবুনগরী। অবশ্য ওইদিন অনুষ্ঠিত মজলিশে শূরায় তাকে মাদরাসার শিক্ষা সচিব ও প্রধান শায়খুল হাদিস নিয়োগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে মাদরাসার নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনায় তিন সদস্যের পরিচালনা বোর্ড গঠন করা হয়। ফলে শূন্য মুহতামিম পদে কে আসছেন সেটা নিয়েও কর্তৃত্বের লড়াই থাকবে।
কর্তৃত্বের লড়াই থাকবে হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ নিয়েও। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির সর্বোচ্চ পদ ‘আমির’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তাঁর অনুপস্থিতিতে এ পদে আসা নিয়েও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকবে। কারণ, মাদরাসার মুহতামিম থাকা অবস্থায় আমির মনোনীত হন শাহ আহমদ শফী। এখন মুহতামিম পদ শূন্য। তাই আমির নির্বাচন নিয়ে থাকবে জটিলতা।
যদিও মাদরাসা এবং সংগঠন ভিন্ন নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। হেফাজত ইসলামের কর্মকাণ্ড সাংগঠনিক সভায় এবং মাদরাসার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শূরা কমিটির বৈঠকে গৃহীত হয়। তবে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগই হাটহাজারী মাদরাসার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে সম্পৃক্ত আছেন। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানের কওমি মাদরাসাগুলোর ওপরও হাটহাজারী মাদরাসার প্রভাব আছে। কারণ, শাহ আহমদ শফী ছিলেন কওমি মাদরাসা বোর্ড বেফাকের সভাপতি। আবার কওমি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই মূলত হেফাজতে ইসলামের কর্মী ও সমর্থক। ফলে হাটহাজারী মাদরাসা এবং হেফাজত ইসলাম দৃশ্যত আলাদা হলেও দুটোর মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় আছে। তাছাড়া হেফাজতে ইসলামের কেউ কেউ মনে করেন, হাটহাজারী মাদরাসার যিনি মুহতামিম থাকবেন তিনিই সংগঠনের আমির হবেন।
এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী আজাদীকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে, শূরা আছে। তারাই ঠিক করবে পরবর্তী আমির কে হবেন। তিনি বলেন, মাদরাসার যিনি প্রধান হবেন তিনিই হেফাজতে ইসলামের আমির হবেন, এমন কোনো বিধান নেই। সংগঠনের গঠনতন্ত্রেও এমন কিছু উল্লেখ নেই। তবে মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে হুজুরকে আমির বানানো হয়েছিল।
এদিকে গত শুক্রবার গণমাধ্যমকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী বলেছিলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমেই সবকিছু ঠিক করা হবে।
জানা গেছে, শাপলা চত্বরের ঘটনায় ২০১৩ সালের ৬ মে গ্রেপ্তার হন সংগঠনটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। পরে মুক্তি পেলেও তার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় শাহ আহমদ শফীর। সংগঠনটির একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন বাবুনগরী। এরই মধ্যে শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর নেতৃত্বে আরেকটি বলয় গড়ে ওঠে। এছাড়া বছর দেড়েক ধরে সিনিয়র নায়েবে আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমির মুফতি ইজহার এবং দলের দুই যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ও মাঈনউদ্দিন রুহীর নেতৃত্বেও আলাদা বলয় তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ইস্যুতে তারা পৃথক পৃথক বিবৃতিও দিয়েছেন। তবে শাহ আহমদ শফী জীবিত থাকায় দূরত্ব থাকলেও সাংগঠনিক নেতৃত্ব নিয়ে বড় ধরনের কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়াননি বিভক্ত নেতাদের অনুসারীরা। এখন শাহ আহমদ শফীর অনুপস্থিতিতে শীর্ষ নেতাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ না কমলে সংগঠনটিতে সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে জুনাইদ বাবুনগরীর সাথে জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়েও নানা গুঞ্জন চলছে। জামায়াত ও শিবিরের নেতাদের শাহ আহমদ শফীর লাশের খাটিয়া বহনকে কেন্দ্র করে এ গুঞ্জন আরো জোরালো হয়। জামায়াতের চট্টগ্রামের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, সাবেক এমপি ও জামায়াতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার মিয়া ও ছাত্র শিবিরের বর্তমান কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল সালাহউদ্দিন আয়ুবী তার লাশ বহন করেছেন। এছাড়া জানাজায় অংশ নেন জামায়াতের বহু নেতাকর্মী।
গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে হেফাজতে ইসলামের। বিষয়টিকে সংগঠনটির অনেকে ইতিবাচক হিসেবে নেন। জামায়াতের হাতে কর্তৃত্ব যাওয়ার গুঞ্জনে ক্ষুদ্ধ তারা। যা সংগঠনটিকে আরো সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লামা শফীকে নিয়ে কটূক্তি, আলাউদ্দিন জিহাদী গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর নোবেলের আরো পৌনে দুই কোটি টাকার জমি দুদকের মামলায় সম্পৃক্ত