নামে বেগুন হলেও পুষ্টিতে রাজা, খেতে পারি তরকারিতে খেতে পারি ভাজা! বেগুনের রয়েছে হরেক রকম পুষ্টিগুণ। যদিও অনেকে রসিকতা করে বলে থাকেন, যার নাই গুণ, তার নাম বেগুন। আসলে কি তাই? উক্তিটি পুরাপুরি মিথ্যে। ভিটামিন এ, সি, ই, আর আয়রনের সমাহার এ বেগুন। এটি শক্তিশালী একটি এন্টিঅক্সিডেন্টও বটে। প্রচুর পরিমাণ আয়রন থাকায় এটি রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। ভিটামিন এ থাকায় চোখের পুষ্টি জোগায়, চোখের যাবতীয় রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। বেগুনে থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম যা দাঁত, হাড়ের জন্য বেশ উপকারী। যারা নিয়মিত বেগুন খায়, তাদের ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় কম বলে পুষ্টিবিদগণ বলে থাকেন। পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্রের ক্যানসারকে প্রতিরোধ করার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে বেগুনের। মুখ ও ঠোঁটের কোণে কিংবা জিবে ঘা দূরীকরণে এটি রিবোফ্ল্যাবিনের কাজ করে। বেগুনে আছে প্রচুর পরিমাণ ডায়াটারি ফাইবার যা খাবার হজমে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। যাদের রক্তে খারাপ ধরনের কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি, তাদের জন্য বেগুন সবজি ভালো। তবে যাদের গেঁটে বাত আছে, কিংবা অ্যাজমা ও অ্যালার্জি থাকে, তাদের বেলায় বেগুনে খানিকটা বিধিনিষেধ তো আছেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০২০ এর হিসাব মতে দেশে মোট ৮৬৪১৯ একর জমিতে বেগুনের চাষ হয়। যার মোট উৎপাদন ৫,৩০,৬১০ মেট্রিক টন। তার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪৭৮৩ একর জমিতে বেগুনের চাষ হয়। যা দেশের বেগুন চাষের আওতাধীন মোট জমির শতকরা ১৭.১ ভাগ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগে মোট বেগুন উৎপাদন ৪৬০১৬ মেট্রিক টন যা দেশের মোট বেগুন উৎপাদনের শতকরা ০.৮৬ ভাগ। দেশের আনাচে-কানাচে বহু রকমের বেগুন চাষ হতে দেখা যায়। এমন ধরনের জাতের সংখ্যা ১৮০ টি বলে কথিত আছে। এসব জাত/কালটিভার থেকে বিজ্ঞানীরা জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন জাতের উদ্ভাবন ঘটায়। অনেক ক্ষেত্রে হাইব্রিডাইজেশনও করতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিউিট (বারি) এ যাবৎ বেগুনের ১১ টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন। তার মধ্যে বারি বেগুন-৩ এবং বারি বেগুন-৪ হাইব্রিড জাতের বেগুন। বারি উদ্ভাবিত বেগুনের জাতের সুন্দর সুন্দর বাহারী নামও রয়েছে যেমন উত্তরা, তারাপুরি, কাজলা, নয়নতারা। আর পুতা বেগুনটি হলো হাটহাজারীর স্থানীয় একটি উন্নত জাতের বেগুন যা কৃষকেরা ব্যাপক আকারে চাষ করে থাকেন। স্থানীয় ভাষায় একে পুতা বাইঅন (বেগুন) বলে। পুতু থেকে পুতার উৎপত্তি বলে মুরব্বী কৃষকেরা জানান। চট্টগ্রামের মানুষ ছোট বাচ্চাকে আদর করে পুতু বা পুতুইন্না বলে ডাকে। এ বেগুনটির আকার ছোট ও দেখতে সুন্দর বিধায় একেও আদর করে পুতা বেগুন ডাকে। তবে বারি ভবিষতে এটি জাত হিসাবে বের করলে কি নাম দেয় সেটা দেখার বিষয়। তবে জাতের নামকরনের সাথে স্থানীয় অরিজিনাল নামটা যেন মুছে না যায় সেটি বিবেচনা করার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মনজুরুল হুদা বিজ্ঞানীদের বার বার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। সেটিও বিবেচনাযোগ্য।
হাটহাজারীর এ পুতা বেগুনের চাহিদা ব্যাপক। দামও বেশি। কারণ এটা রান্না করলে তরকারীর স্বাদ বহুগুণ বেড়ে যায়। একটু মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ। চট্টগ্রামের মানুষ শুঁটকি প্রিয় বেশি। ছুরি শুঁটকির সাথে এ বেগুনের জুড়ি মেলা ভার। আর খাইস্সার (সীমের বীচি) সাথে চিংড়ি আর পুতা বেগুনের মজাই আলাদা। ইলিশ মাছের সাথে পুতা বেগুনের তরকারীর ঝোল না খেলে বর্ণনায় করা যাবে না। কি সুমিষ্ট ঘ্রাণ! ঘ্রাণেই যেন অর্ধ ভোজন। এ পুতা বেগুন শুধু স্বাদ যোগায় তা নয়। এটি কৃষকের পারিবারিক আয় বাড়ানোর একটি অন্যতম হাতিয়ার। কেননা এর ফলন যেমন বেশি তেমনি বাজারে অন্যান্য বেগুনের চাইতে এর বিক্রি মূল্যও অনেক বেশি। বাজারে প্রতি কেজি পুতা বেগুনের গড় দাম প্রায় ৭০ টাকা। যা মাঝে মাঝে ১২০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা যায়। চলতি বছর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা যায় এ বেগুনের প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ১৫.৩২ টাকা। কৃষক পর্যায়ে গড় বিক্রি মূল্য ৩০.১৯ টাকা হিসাবে মোট উৎপাদন খরচ বাদ দিলে প্রতি হেক্টরে এ বেগুন চাষে নিট লাভ দাড়ায় ৮,০১৮৩০ টাকা। আয়-ব্যয় খরচের অনুপাত ২.৫৬ অর্থাৎ এক টাকা বিনিয়োগে ১.৫৬ টাকা নিট লাভ হয়। সুতরাং এটি নি:সন্দেহে একটি সম্ভাবনাময় লাভজনক অর্থকরী ফসল। এরকম একটি লাভজনক অর্থকরী ফসলকে গবেষণার মূল ধারায় নিয়ে আসা উচিত। এটির উৎপাদনশীলতা (ফলন) গড়ে প্রতি হেক্টরে ৪৩.৬১৮ মেট্্িরক টন। উক্ত পুতা বেগুনের ফলন বারি উদ্ভাবিত বেগুনের জাতের ফলনের কাছাকাছি। গবেষণার মাধ্যমে এটিকে আরো উন্নত ব্যবস্থাপনা দিলে এটি আরো অধিক উৎপাদনশীল হবে এতে কোন সন্দেহ নাই। সে সাথে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে। এ জন্য স্বল্প মেয়াদী পদক্ষেপ হিসাবে উক্ত বেগুন চাষাবাদে আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশলের প্রযৌগ ঘটাতে হবে। সে সাথে সার ও রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনার উপর কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি। এটিকে উন্নত জাত হিসাবে অবমুক্ত করা এখন সময়ের দাবী। সে লক্ষ্যে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আশার কথা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী কৃষকের চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে গবেষণা কাজ শুরু করেছেন। সম্ভাবনাময় এ ফসলটি মান-সম্মত গবেষণার মাধ্যমে কৃষকের জন্য একটি আয়-বর্ধক হিসাবে আবির্ভুত হউক সে প্রত্যাশা রাখা যায়।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।