চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সাধারণ সভায় জলাবদ্ধতা ইস্যুতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন পাঁচ কাউন্সিলর। এই ক্ষোভ কেবল পাঁচ কাউন্সিলর নয়, নগরীর সকল বাসিন্দা ভেতরে ভেতরে ঝেড়ে চলেছেন, তা হয়তো দেখা যায় না। পাঁচ কাউন্সিলর জলাবদ্ধতার জন্য পৃথক দুইটি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ’র প্রতি ইঙ্গিত করেন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা হলেই নগরবাসী মেয়র ও কাউন্সিলরদের দায় দেন, কারণ আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ায় মানুষ আমাদের চিনে। অথচ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের দায়িত্বে নেই। দ্রুততম সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সম্পন্ন করতে সিডিএ’র প্রতি আহ্বান জানান তিনি। মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা একাধিক সমন্বয় সভা করেছি। সভায় সিডিএ’র যখন যে প্রতিনিধি আসেন দ্রুততম সময়ে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। বাস্তবে সিডিএ’র প্রকল্পের কোনো সুফল এসেছে বলে নগরবাসী মনে করে না। কাউকে দোষারোপ করি না, শুধু সিডিএকে বলতে চাই নগরবাসী আর কষ্ট পেতে চায় না। আপনারা জনগণের মতামতকে মূল্যায়ন করে, জনপ্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দ্রুততম সময়ে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প সম্পন্ন করুন।
এদিকে, ২৯ আগস্ট প্রকাশিত দৈনিক আজাদীতে বলা হয়েছে, নগরের মোট আয়তনের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। অথচ চলতি মৌসুমে ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের প্রভাবে নগরের ৪০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। অর্থাৎ সাত বছরে জলাবদ্ধতার তীব্রতা বেড়েছে শহরে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। এতে বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগও।
অথচ এ সাত বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে পৃথক তিন সংস্থা ১১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকায় চারটি প্রকল্প নেয়, যেগুলোর কাজ চলমান। প্রকল্পগুলোর বিপরীতে সরকার ইতোমধ্যে ছাড় করেছে ৬ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। একইসময়ে প্রকল্পের বাইরে রাজস্ব তহবিল থেকে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন খরচ করে ৫১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠে সাত বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচের পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞ থেকে স্থানীয় লোকজনের বেশিরভাগই মোদ্দাকথায় বলেছেন, বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে হলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য বিদ্যমান খাল নিয়মিত খনন করে পরিষ্কার রাখতে হবে। জোয়ারের পানির জন্য সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষায় প্রয়োজন খালের মুখে পাম্প হাউজসহ স্লুইস গেইট নির্মাণ করে চালু করা। যার কোনোটার বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয়নি। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী করা হয় অপরিকল্পিত নগরায়নকে। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, একসময় শহরে যে পরিমাণ জলাধার ছিল তা আবাসনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কমে গেছে। এছাড়া শহরের দুই প্রান্তে যে উঁচু সড়কগুলো হয়েছে পানি প্রবাহে সেগুলো বাধাগ্রস্ত করছে। এক্ষেত্রে সেখানে পানি প্রবাহে পর্যাপ্ত জায়গা রাখলে সমস্য হতো না।
জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখগাথা হয়ে আছে। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, এই নিয়তি একপ্রকার মেনে নিয়েছে নগরবাসী। এমনকি বৃষ্টি না থাকলেও অনেক সময় জোয়ারের পানিতেও ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার, হাসপাতালসহ বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখানে নৈমিত্তিক। বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলাবদ্ধতার মূল কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সময় জলপ্রবাহের যে রাস্তা ছিল তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সে কারণেই জলাবদ্ধতার সমস্যা হচ্ছে। এর বাইরে এলাকা ভিত্তিকও নানা কারণ থাকতে পারে।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতার বাইরের খাল–নালাগুলো সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নিয়মিত পরিষ্কার করা ছিল অন্যতম কাজ। নগরীর ছোট–বড় নালাগুলোর আবর্জনা অপসারণ না করায় সামান্য বৃষ্টিতে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের। নালা পরিষ্কার না করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) দায়ী করছেন তাঁরা। যদিও চসিক মেয়র এ দায় নিতে নারাজ। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি কম হয়নি। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরামর্শ কোনোটাই যেন কাজে আসছে না। আমরা মনে করি, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামের খালগুলো ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মেগা প্রকল্পে জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন জরুরি।