হাছন রাজার ভাব জগত

ইকবাল হায়দার | শনিবার , ২২ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

হাছন রাজার (১৮৫৪১৯২২) অভ্যুদয় হয়েছিল আধুনিক কালের শুরুতে। ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক কালের শুরু হয় ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এ সময় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ) প্রতিষ্ঠিত হয়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ প্রকাশিত হয় (১৮৬০) ও বংগীয় রেনেসাঁসের উদ্ভব হয়।

বাংলার ধনাঢ্য অভিজাত পরিবার সমূহ ও জমিদারদের নানা তৎপরতা এ সময় লক্ষণীয়। একই ধারায় সিলেটের অভিজাত পরিবার সমূহ আসামে তাদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে।

অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লক্ষ্য করেন যে, ‘সিলেট ও সুনামগঞ্জে তিন লক্ষ বিঘা জমির মালিক হাছন রাজা বাংলার অভিজাত ও সম্পদশালী পরিবার সমূহের ধারা থেকে ব্যতিক্রমী জীবন যাপন করেছিলেন।’

হাছন রাজার জীবন তথ্যের আদি লেখক প্রভাত কুমার শর্মা লিখেছেন,”বাংলার সেই মধ্যযুগে এদেশে শিক্ষার বহুল প্রচার না হওয়ায় তাঁহার শিক্ষার প্রতি কোন মনোযোগই দেওয়া হয় নাই। কিন্তু বনের ফুল যেমন মালীর হাতের সেবার অপেক্ষা না রাখিয়াই আপনার মত বর্ণে গন্ধে ভরিয়া উঠে, শিক্ষার অভাবের মধ্যেও তেমনি এই বাউল কবির চিত্ত বৈরাগ্য ও প্রেমের আলোকে এক রমণীয় বণ্য সৌন্দর্যে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। তাই বিকশিত হইলেও সেই বনফুলের মর্যাদা নগরের রাজোদ্যানে যে হয় নাই, তাহাতে বিস্মিত হইবার কোন কারণ নাই। হাছন রাজা সাহেব যে সমাজ, যে রীতি নীতি, যে প্রকার আবেষ্টনের মধ্যে লালিত পালিত হইয়া উঠিয়াছিলেন বিংশ শতাব্দীর সমাজের সাথে তাহার সুর মিলে না।’

জমিদার হিসেবে কখনো কঠোর, কখনো নির্মম হলেও চিন্তা চেতনায় হাছন রাজা আজীবন ছিলেন উদার ও পরমতসহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী। তার মত উদার, পরধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল অসামপ্রদায়িক মানুষ একালেও বিরল।

হাছন রাজার স্বল্প শিক্ষা (মতান্তরে নিরক্ষর) সত্ত্বেও তাঁর লেখা গান কবিতায় অসাধারণ দূরদর্শিতাপূর্বক, তিনি দেশীয় সংস্কৃতির রূপ ও চেতনা অবলোকন ও অনুধাবনে, বাংলার লৌকিক সংস্কৃতির সহস্র বছরের গঠন কাঠামো ও তার আঁকাবাঁকা বিকাশ প্রক্রিয়ার ধারার মধ্যে আদিম সমাজের উপাদানসমূহের সংগে পরবর্তীকালের অসংখ্য পথ, পন্থা, ধর্ম, উপধর্ম, দর্শন, ভাবধারারএত বিরোধী ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়েছেন যে, তা অতুলনীয়। সিলেটের লোক কবি ও সাধকেরা তাই বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, সুফি, বাউল প্রভৃতি চিন্তা চেতনার পন্থাকে মিলিয়ে মিশিয়ে গ্রহণ করেছেন।

হাছন রাজার গানের ভাব ও অসামান্য বিষয়ের সাথে সুফিপন্থার মারিফত বা মরমী ভাবধারার মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম প্রভাবিত বাউল ধর্ম এক নতুনতর প্রকাশের পথ পেয়েছে। ফলে তত্ত্বজ্ঞানমূলক বাউল ধর্মেরও মিশ্রণ ঘটে গেছে। তার সংগে যুক্ত হয়েছে বৌদ্ধ নাথ পন্থীদের দেহাত্মবাদী তান্ত্রিক সাধনার ধারা।

হাছন রাজার ভাব জগত, দর্শন ও সাধনা নিয়ে বিখ্যাত দার্শনিক সুরেন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত, আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, প্রভাতকুমার শর্মা, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, রণজিত্‌ কুমার সেন প্রমুখ এ বিষয়ে নানাভাবে আলোচনা করেছেন।

হাছন রাজার উত্তর পুরুষ ও বিশিষ্ট দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন,‘আমি তাঁর কাব্য সাহিত্যের আলোচনা করে দেখেছি তিনি প্রথমে শরিয়তের আইন কানুন বাস্তব জীবনে রূপায়ণের জন্য মুমিন মুসলমানদের আহ্বান জানিয়েছেন। পরবর্তী স্তরে তিনি প্রেমের মাধ্যমে তাঁর প্রিয়তমকে লাভ করার চেষ্টা করেছেন। সর্বশেষ স্থরে তিনি দার্শনিক রূপে তাঁর নিজের মধ্যেই সেই প্রিয়তমের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তবে তাঁর মানসবিকাশের এ পর্যায়গুলো বিশ্লষণ করলে।

স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ইসলামী সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ইসলামী সংস্কৃতির গোড়ার কথা– ‘মন আরেফা নফসহু ফকদ আরাফা রব্বাহু’যে আপনাকে জেনেছে সে তার রবকে জেনেছে। সর্বস্থানে ইসলামী সংস্কৃতি এ উক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।

হাছন রাজা আত্মমুখী সংস্কৃতির সর্বশেষ পর্যায়ে আরোহণ করে বলেছিলেন -‘মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন’। কাজেই হাছন রাজা ইসলামী ভাবাপন্ন ছিলেন এবং রাধাকৃষ্ণ, কালী, দুর্গা প্রভৃতি দেব দেবীকে কখনও কখনও তাঁর প্রত্যয় প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে রূপকের আকারে ব্যবহার করেছেন। তবে তিনি হিন্দু সংস্কৃতি বা মুসলিম সংস্কৃতির ঊর্ধ্বে একটি অভিনব সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছেন’ (পৃ: ৪ প্রসংগ হাছন রাজা )

ক্ষিতি মোহন সেন বলেন ‘হাছন রাজা বাউল ছিলেন’।

আজরফ সাহেব অন্য এক জায়গায় বলেন, ‘হাছন রাজা চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন’।

. এনামুল হক তার ‘বংগে সুফী প্রভাব গ্রন্থেও হাছন রাজা চিশতিয়া ত্বরীকার বলে উল্লেখ করেছেন।

হাছন রাজা সিলেটের পূর্বোক্ত লোককবি ও সাধকদের মতো সুফি ও বৈষ্ণব ভাবনাকে আত্মস্থ করেছিলেন। বাউল সাধনার সাথে এর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ‘ময়না পাখী’, ‘শুঁয়াপাখী’, ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে’ প্রভৃতি গানে তাই তিনি বাউল সাধক।

আসলে তিনি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল কবি ও মরমীয়া সাধক। তার ভাব সাধনায় বহু মত পথ ও পন্থার সংযোগ ও সমন্বয় ঘটেছে। তার চিন্তার মৌলিকতা ও ভাবগভীরতা অসাধারণ। তিনি বাঙালির দার্শনিক ও মরমীবাদী ধারায় নিজস্ব ভাবনাকে বিন্যস্ত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সমন্বয়বাদী ভাবুক। গভীরতর মানবিক ও আধ্যাত্ম ভাবনায় নিমগ্ন হয়ে তিনি শাস্ত্রীয় ধর্মের অগভীর ও যান্ত্রিক অনুসারীদের তীব্র বাক্যবাণ ছুড়েছেন,

চোখ থাকিতে দিনের কানার মত নাই লই

সাক্ষাতে যে বন্ধু খাড়া মুল্লায় বলে কই

হাছন রাজার বন্ধু কে মুল্লায় নাহি দেখে

আজলের আন্ধি লাইগাছে কট মুল্লার আঁখে।

কোথাও কোথাও তিনি শরীয়ত ও মারিফতের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে স্রষ্টার সংগে একাত্ম হতে চেয়েছেন। তিনি শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে সুফি ধর্মীয় মতবাদকে তার কাব্যের কেন্দ্রীয় ভাব হিসেবে এনেছেন : তাত্ত্বিকভাবে দেখলে ওখানেই তার ভাবনার কেন্দ্র।

তাঁর লেখার মধ্যে আমরা ইসলামী বিষয়, হিন্দুধর্মের বিশ্বাস সংস্কার পুরাণ, সুফিবাদ, বৈষ্ণব ধর্মীয় অনুসংগ, বাউল পন্থা প্রভৃতির মিশ্রণ দেখি।

সুফিবাদের কেন্দ্রীয় ধারণায় মানুষ ও আল্লাহর মধ্যে যে সম্পর্ক নির্মিত হয়েছে তা প্রেমের। এই ধারা ও প্রেম সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে মানুষের আমিত্বের বিলোপ ঘটেসুফি সাধনায় এরই অভিধা ‘ফানা’। এ পর্যায়ে মানুষ সৃষ্টিকর্তার সাথে একাত্ম তথা লীন হয়ে যায়।

হাছন রাজার গানে আল্লাহ্‌ বা ভগবানকে আমরা প্রিয়া ও প্রিয় দু ভাবেই পাই। তিনি জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার অস্তিত্ব দেখেন। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর দর্শনে বড় তত্ত্ব পান। সেটি এই যে, ‘ব্যক্তি স্বরূপের সহিত সম্বন্ধসূত্রেই বিশ্ব সত্য।’

এই সাধক দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাহার ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাহার নয়ন পথে আবির্ভূত হইলেন।

দেওয়ান মোহাম্মদ তাছাওয়ার রাজা সংগৃহীত, গবেষণাকৃত, গ্রন্থিত ও সম্পাদিত বই ‘হাছন রাজা সমগ্র পৃঃ ৩৬ এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে লেখক গবেষক জনাব শামসুজ্জামান খান ( সাবেক মহাপরিচালক বাংলা একাডেমী) সবশেষে লিখেন, ‘হাছন রাজা এক অসামান্য সাধক হিসেবে দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন। তাঁকে ঘিরে আমাদের সাংস্কৃতিক চিন্তা এক নুতন শক্তি ও সম্ভাবনা অর্জন করছে।’

লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী, লোক গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে