বাংলাদেশের সৌন্দর্য নানারকমভাবে ফুটে উঠছে বিভিন্ন অঞ্চলভেদে। সেখানে সিলেটের সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। সমগ্র সিলেটই সবুজে ঘেরা। প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকছে পর্যটকদের। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই প্রকৃতি অপরূপে সৌন্দর্যের সঙ্গে মিল রেখে নিজেকে ফুটিয়ে তোলে। সিলেটের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বছর জুড়েই সিলেটে পর্যটকদের ঢল নামে।
হাওর–নদী–পাহাড়ের দেশ সিলেটে আছে অপরূপ অরণ্যানীও। দেখতে গেলে চোখ জুড়িয়ে দেবে সবুজের সমারোহ। সারিবদ্ধ চা বাগান, উঁচু–নিচু পাহাড়–টিলা, গহীন অরণ্য আর ঝরনাধারা।
আরও এমন জায়গা আছে হৃদয়হরণকারী হাওরাঞ্চল।
বাংলাদেশের উত্তর–পূর্বে অবস্থিত এই প্রাচীন জনপদ বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত। সিলেটে বসবাসকারী বিভিন্ন আদিবাসীর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি। সিলেটে আদিবাসীদের মধ্যে মনিপুরী সমপ্রদায়ের নাচ বিশ্ববিখ্যাত।
চা–বাগান, জাফলং, রাতারগুল জলাবন, হাকালুকি হাওর, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, বিছানাকান্দি, তামাবিল, পাহাড়–ঝরনা সব মিলিয়ে নানা বৈচিত্র্যের সম্ভার এই সিলেট দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী এখন। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও সিলেটের রয়েছে প্রসিদ্ধ ইতিহাস।
সিলেট বিভাগ উত্তর ও দক্ষিণ হতে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। অভ্যন্তরীণ সীমানার ভূমি বেশিরভাগ সমতল। বৈশাখ হতে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। বৃহৎ জলপাতের কারণে পাহাড় হতে ঢল নেমে ক্ষুদ্র নদীগুলোর ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে প্রতি বছরই মৌসুমি বন্যায় কবলিত হয় বেশিরভাগ নিম্নাঞ্চল।
সিলেট বিভাগে প্রায় ৪৬টি হাওর রয়েছে। বড় বড় হাওরগুলো হেমন্তকালে অনেকাংশে জল জমাট থাকে।
সিলেটের এই অপরূপ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য অনেকবার হয়েছে। তবে প্রতিবারই তার সৌন্দর্য ভিন্নভাবে সামনে আসে।
হঠাৎ ডাক পড়লো একটা সংগঠনের কাজে সিলেট যাওয়ার। ভ্রুক্ষেপ না করেই রাজি হয়ে গেলাম দিনক্ষণ ঠিক করার কথা বলে। যেই বলা সেই ব্যাগ গোছানো শুরু আমার। চার বান্ধবী আর ভারত থেকে আসা এক দিদিসহ ভ্রমণের সঙ্গী হলাম। সিলেট অনেকবার যাওয়া হয়েছে আমার। তবুও যাবার একটা টান অনুভব করি খুব।
এবারের ভ্রমণের সৌন্দর্য হাওর। বর্ষার জলে কলকলতানে ছাপিয়ে বেড়ানো দেশের একমাত্র জলাবন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। সে যেন এক অনাবিল প্রশান্তির নাম। নানারঙ্গে, নানাঢঙ্গে ভালোবাসা লুকিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে দিলো। রাতারগুল জলাবন সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন। পৃথিবীতে মিঠাপানির যে ২২টি মাত্র জলাবন আছে, ‘রাতারগুল জলাবন’ তার মধ্যে একটি। এই জলাবনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর। এর ৫০৪ একর এলাকাকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
এই এলাকাকে বিশেষ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। চিরসবুজ এই বন গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত। গোয়াইন নদীর সাথে মিলিত হয়ে চেঙ্গির খালের সাথে একে সংযুক্ত করেছে। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ। এখানকার গাছপালা বছরে ৪ থেকে ৭ মাস পানির নিচে থাকে। বর্ষাকালে এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে।
এখানে বৈঠা নৌকা করে রাতারগুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়। সাঁতার জানি না বলে প্রথমে যেতে অনিহা প্রকাশ করেছি। এত্তো বড় হাওর আমার দেখা এই প্রথম। বর্ষার জলে টইটম্বুর একেবারে। সাহস করে নৌকায় চড়লাম সেও অনেক বছর পর। এমন ডিঙি নৌকায় আজকাল চড়া হয় না। সবখানেই ইঞ্জিনচালিত নৌকা হয়েছে। নৌকা যেতে যেতে বনের গহীনে ঢুকে গেলাম। দুইপাশে গাছের সারি। লতাপাতায় ডুবে যাওয়া জলের ভারে এর সুন্দর দেখার মতে। সাপের ভয় বেড়ানোর সময়ে ছিলো না। পরে সবার কথায় মনে পড়ল সাপেরই অরণ্য হয়তো।
আমাদের বন্ধুরা গান ধরলো, কেউ নৌকায় নাচ শুরু করে দিলো। আমার ভয় ধীরে ধীরে সুন্দরের হাতছানিতে উড়ে গেলো। দূর নৌকা থেকে গান ভেসে আসছে। আমাদের সিলেট ভ্রমণের সহযাত্রী সিলেটের এডভোকেট শহীদুল ইসলাম ভাই সার্বক্ষণিক আমাদের সহযোগিতা করেছেন নানানভাবে। তার দরাজ কণ্ঠ আমাদের দূর কোন গ্রামের টানে উজানের স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। এমন প্রাণোচ্ছল মানুষের দেখা কম পাওয়া যায়।
হাওরের বড় গাছের ডালে পাখির সাথে বসলাম, পানিতে পা ডুবালাম সবাই। প্রায় দুই ঘন্টার আনন্দ নিয়েই কখন যে কুলে ভিড়লাম টেরই পেলাম না।
জাফলং এর সৌন্দর্য যেন প্রকৃতি নিজ হাতে সব সৌন্দর্য একসাথে ঢেলে সাজিয়ে রেখেছে। একপাশে বিশালাকৃতির পাহাড় আর হিম ছড়ানো পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলরাশি। সিলেট থেকে জাফলং যাওয়ার পথে তামাবিল এ পাহাড়ি ঝরনা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। অসম্ভব সুন্দর সেই দৃশ্য। দূর দূরান্তে বিশাল আকৃতির পাহাড় আর সরু ঝরনার জলধারা।
পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়ে। ধলাই নদীর উজানে এ–রাজ্যের অবস্থান। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেরা এ–রাজ্যের দৃশ্য বড়ই মনোরম। যা মন ভালো করিয়ে দেবে যে কাউকে।
বর্ষায় সিলেটের চা–বাগানের সবুজপাতাগুলো নিজেদেরকে বিকশিত করে তোলে। চা–বাগানের সবুজ যেন সব ভালো লাগাকে ছাপিয়ে তোলে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি’র সৌন্দর্য পরতে–পরতে সাজিয়ে রাখা। ছায়াবৃক্ষগুলো একপায়ে দাঁড়িয়ে থেকে যেন সবুজ চা–বাগানের সৌন্দর্যকেই পাহারা দিচ্ছে। এ যেন প্রকৃতির অনাবিল প্রশান্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে সারা সিলেট জুড়ে। আঁকাবাঁকা পথে পুরো সিলেট জুড়েই রয়েছে এই চা বাগান। এবার মালনীছড়া চা বাগান ঘুরলাম। যা ১৮৫৪ সালে যাত্রা শুরু করে।
বর্ষায় সমগ্র সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কতভাবে নয়নাভিরাম হয়ে উঠতে পারে তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝার উপায় থাকে না। হাওরগুলো পুরো যৌবনা হয়ে ওঠে। চারিদিকে কুল উপচে পানিতে টইটম্বুর থাকে।
সিলেটে বেড়ানোর উপযুক্ত সময় এই বর্ষাকাল। যদি ঝরনা আর হাওর বাওর দেখার ইচ্ছে থাকে।
ওই যে বললাম আমার একটা টান থাকেই সিলেট যাবার। আমার মায়ের দেশ এই সিলেটে। ছোটবেলা থেকেই একটা মোহ কাজ করতো মামার বাড়ি যাওয়ার। এখনও মামাদের কাছ থেকে আদর, আব্দার , সাথে অঝোর বৃষ্টি নিয়েই ফিরে আসি আমার শহরে, চট্টগ্রামে।
‘তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই
পুরনো ভেঙ্গে যাওয়া ছাতা সারাই
তোমার হাসি ফোটা রোদ্দুরে
মেঘ সফর হোক ঘুরে ঘুরে’