হাউজ-ই-শামসির কান্না

এজাজ মাহমুদ | সোমবার , ৩ জুলাই, ২০২৩ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

উর্দু ‘হোজ’ বা হাউজমানে জলাধার‘ (বা হ্রদ/দিঘি), আরবি শামসির অর্থ সূর্য বা সৌর। সে আক্ষরিক অর্থে হাউজশামসি ‘রৌদ্রোজ্জ্বল জলাশয়’। মধ্য আগস্টের এক দুপুরে দিল্লির প্রাচীন শহর মেহরৌলিতে ঐতিহাসিক ও পবিত্র নিদর্শনটির সামনে দাঁড়িয়ে নামের যথার্থতা মিলাতে পারলেও জৌলুস খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। এক সময়ের জলটলমল দিঘিটি আগাছা ও বর্জ্যে ভরা, নোংরা সবুজ জলের ওপর ভাসমান কচুরিপানা। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, বোঝা যাচ্ছে পানি অনেক দূষিত। দিঘির আকারও পুকুরে নেমেছে। চারপাশে লোহার গ্রিলের বেস্টনি, পশ্চিমপাড়ের দিকে ইতিহাস আর স্থাপত্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেলেপাথরের গম্বুজযুক্ত দ্বিতল কাঠামোর প্যাভিলিয়ন বা মণ্ডপ। একটি ফুট ব্র্রিজে যুক্ত মণ্ডপটির দরজা তালামারা। প্রায় ৮০০ বছর আগে দিল্লি সালতানাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সুলতান শামসুউদ্দিন ইলতুৎমিশের (রা. ১২১১১২৩৬) বানানো হাউজশামসি, মহানবী মুহাম্মদ (.)-এর স্বপ্ননির্দেশনার কারণে পবিত্রতার পরশ জড়ায়। বছরের পর বছর তীব্র পানি সংকটে থাকা মেহরৌলিবাসীর কাছে ঈশ্বরের উপহার হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল স্থানীয়ভাবে ‘শামশি তালাব’ নামে পরিচিত জলধারটি, যার ওপর লম্বা সময় নির্ভর ছিলেন তারা।

ডায়মন্ড সিমেন্টের কাফেলা সঙ্গী হয়ে দেখার সুযোগ হয় দিল্লির কুতুব মিনারের কাছে মেহরৌলি শহরের হাউজশামসি। প্রখ্যাত সাধক খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা.) এর দরগাহ থেকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথ হাউজশামসি । দিনটি ছিল ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন, দলনেতা লায়ন হাকিম আলীসহ (ডায়মন্ড সিমেন্টের পরিচালক) কাফেলার সবাই যখন মাওলানা মোকতারের বয়ানে হাউজশামসির পবিত্রতার ইতিহাসে মনোযোগী, অন্যমনস্ক আমার ভাবনা, কর্তৃপক্ষসমপ্রদায়, অবহেলার দায়টা কার? উত্তর খুঁজতে আশেপাশে উপযুক্ত স্থানীয় কাউকে পেলাম না, পার্কে অলস দুপুর কাঠানো ভবঘুরে টাইপের কয়েকজন ছাড়া। অবশ্য পরিবেশপ্রতিবেশে বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, অবহেলা আর দূষণদখলের নির্মম শিকার হাউজশামসি। পরে পত্রপত্রিকা ঘেঁটে পরিষ্কার বুঝলাম, ঐতিহাসিক নিদর্শনটি অস্তিত্ব আর সম্মান রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে মনোযোগের জন্য কান্না করছে! গত ৪ বছরে তেমন পরিবর্তন হয়নি, এমনটি জানা যায় কাফেলার অন্যতম পথপ্রদর্শক মাওলানা এডভোকেট মোকতার আহমেদের কাছ থেকে, যিনি সম্প্রতি গিয়েছিলেন আবারও।

গ্রন্থ সূত্রে জানা যায় যে, পানির অভাব মেটাতে ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে জলাধার হিসেবে হাউজশামসি নির্মাণ করেন সুলতান ইলতুৎমিশ। জনপ্রিয় কিংবদন্তি হল, অত্যন্ত ধার্মিক ইলতুৎমিশকে স্বপ্নে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (.) ওই স্থানে জলাধার নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত সাধক শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশেখরের ফাওয়ায়েদুস সালেকিনতে হাউসে শামসির বর্ণনায় আছে, রাসুলে পাক (.) বুরাককে (ডানাওয়ালা ঘোড়া যার উপরে চড়ে নবীজী মি’রাজে গিয়েছিলেন) নিজের গোড়ালী দিয়ে আঘাত করেন। বোরাক লাফিয়ে উঠে, খুর মাটিতে পড়তেই সেখান থেকে পানি বেরিয়ে আসে। নবীজী (.) বললেন, ’হে শামস্‌, এ জায়গায় হাউজ তৈরি কর, এখানকার মতো সুস্বাদু ও মিষ্টি পানীয় পৃথিবীর আর কোথাও নেই’। পরের দিন ইলতুৎমিশ ওই জায়গাটিতে গিয়ে বোরাকের খুরের ছাপ ও পানির নহর পান। তিনি পবিত্র স্থান হিসেবে বোরাকের খুরের ছাপের জায়গায় গম্বুজযুক্ত মণ্ডপটি বানানো পর বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে চারপাশে জলাধারটি খনন করেন। যার নাম হয় হাউজশামসি। বোরাকযুক্ত হওয়ায় পবিত্র বিবেচনায় হাউজশামসির পানি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পান করতেন, তীর্থযাত্রীরা বোতল ভরে নিয়েও যেতেন। জলাধারের চারপাশে অনেক মুসলিম শাসক ও সাধকের বেশ কয়েকটি কবর রয়েছে। এর মধ্যে দুইজন সুফির কথা জানা যায় জগতখ্যাত আলেম শায়ক আব্দুল হক মোহাদ্দিছ দেহলভির বিখ্যাত গ্রন্থ আখবারুল আখইয়ারের সূত্রে। একজন ইলতুৎমিশের শাসনামলের শায়কউলইসলামহিসেবে নিযুক্ত শায়ক নুরুদ্দিন (মৃত্যু ৬৩২ হিজরি), যাকে দিল্লিবাসী মীরদিল্লি‘ (দিল্লির প্রভু) বলে ডাকতেন। অন্যজন, খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর বন্ধু শায়খ মাহমুদ মুয়িনা দুজ। শায়ক আব্দুল হক দেহলভির সমাধিও হাউজশামসির কাছাকাছি ইসলাম কলোনিতে, যেটি ছিল আমাদের পরের গন্তব্য।

ইতিহাস বলছে, হাউজশামসি মূলত ৪.৯ একর এলাকাজুড়ে ছিল। বছরের পর বছর এটি কেবল সঙ্কুচিতই হয়নি, অববাহিকা এলাকায়ও দ্রুত নির্মাণ দেখা গেছে। গম্বুজযুক্ত দ্বিতল মণ্ডপটি আগে জলাধারের মাঝখানে ছিল, যেখানে কেবল নৌকাতে যাওয়া যেত। ১৩৩৪ সালে বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা দিল্লি সফরে এসে হাউজশামসির বিশালতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনায়, ‘জলাধারটি প্রায় দুই মাইল লম্বা ও এক মাইল চওড়া। মাঝখানে একটি বড় গম্বুজ, ভাস্কর্য পাথরের তৈরি দুই তলা। পানি বাড়লে শুধু নৌকা দিয়েই গম্বুজে পৌঁছানো যায়। গম্বুজের ভেতরে বেশিরভাগ সময় ফকিরদের দেখা মেলে’। ‘দিল্লি এন্ড ইটস্‌ নেইবারহুড’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, মণ্ডপে থাকা বোরাকের খুরের ছাপযুক্ত আসল পাথরটি সরানো হয়, বর্তমান পাথরটি পরে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। ইতিহাসউৎসাহী লেখক অঞ্জনার এক নিবন্ধে বলা হয়, ১৩১১ সালে আলাউদ্দিন খিলজি হাউজশামসি সংস্কার করেন। সুলতান জলাধারের তলা থেকে বালি ও কাদা অপসারণের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে, সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক জলাধারটি মেরামত করেন। স্মৃতিকথায় তিনি বলেন, ‘কিছু অসৎ লোক ছিল হাউজশামসির পানি সরবরাহকারী চ্যানেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় পানি প্রবাহ বাধা পায়। আমি সেইসব নির্লজ্জ ও মূর্খ লোকদের কঠোর শাস্তি দিয়েছিলাম এবং সরবরাহের চ্যানেলগুলি আবার খুলে দিয়েছিলাম। হাউজশামসি পূর্ণ হয়ে উঠে মিষ্টি পানির নদীর মতো’।

বেহাল অবস্থার পিছনে, ‘দখল আর পলির স্তরে অববাহিকার ক্ষতি, বর্জ্যের ডাম্পিং, পয়ঃনিষ্কাশন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব’ কারণ হিসেবে দেখার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, শামসি তালাব রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। ইসলাম সম্পর্কিত এক ব্লগে প্রাবন্ধিক ড. মাজহার নকভির লিখেছেন, ’জায়গাটি দীর্ঘ সময়ের জন্য ভূমিদস্যুদের নাগালের বাইরে ছিল, কিন্তু ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমসের পরে যখন দক্ষিণ দিল্লি বাড়তে শুরু করে, তখন পবিত্র স্থানটির অনেক ক্ষতি হয়। জমি দখল করে স্থাপনা করা আশপাশের বাড়িঘর থেকে ময়লা ফেলার একটি ডাম্পিং পয়েন্টে পরিণত হয়। পবিত্র স্থান থেকে একটি নোংরা পুকুরে পরিণত হয় হাউজশামসি’। শেষ পর্যন্ত পাশে দাঁড়ায় দিল্লি হাইকোর্ট। এএসআইর সংরক্ষিত স্থাপনার তালিকায় স্থান পায় হাউজশামসি। নয়াদিল্লিভিত্তিক এনজিও তাপস’র মামলায় দিল্লি হাইকোর্টের আদেশে চারপাশে গ্রিলসহ সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়। তবে এটিও আবর্জনা আটকাতে ব্যর্থ হয়, কারণ স্থানীয়রা বেষ্টনির উপর দিয়ে ময়লা ছুঁড়ে, গ্রিলের কিছু অংশ ভেঙেও ফেলে। এ ছাড়া আদালতের আদেশ অনুযায়ী নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিষ্কার করা হয়নি জানিয়ে তাপসএর চেয়ারম্যান বিনোদ জৈন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শুরুতে দুইতিন বছর করা হলেও পরিচ্ছন্নতার ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রাখা হয়নি। উদ্বেগের বিষয়, পানির স্তর কমছে। সচেতনতার পাশাপাশি পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা ও নিষ্কাশন করা জরুরি। না হলে, এটি হারিয়ে যাবে এবং শুকনো ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত হবে।’

হাউজশামসির পরিধিতে আরও দুটি ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে, জাহাজমহল ও ঝর্ণাদুটিই ধ্বংসপ্রায়। আমরা হাউজশামসিতে ঢুকেছিলাম জাহাজ মহলদিয়ে। জলাধারে ভাসমান প্রাসাদএমন প্রতিফলন থেকে নামকরণ, যেখানে এটিকে একটি জাহাজের মতো দেখায়। ১৪৫১১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লোদি যুগে নির্মিত, প্রাসাদটি মধ্য ও দূরপ্রাচ্যের তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি সরাই (বিশ্রামাগার) ছিল। দেখেই বোঝা যায়, সভ্যতার চাপের কাছে নতি স্বীকার করেও, যুগের অনেক সুন্দর উপাদান ধরে রেখেছে লাল বেলেপাথরের প্রাসাদটি। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ছত্রীর চোখ ধাঁধাঁনো নীল টাইলসগুলো, বিশেষ করে কেন্দ্রের গম্বুজে। নিচতলার পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাবছোট মসজিদের উপস্থিতির জানান দেয়। জাহাজ মহলের পূর্বপাশে ঝর্ণা কমপ্লেক্স, মুঘলদের আনন্দ উদ্যান। আংশিকভাবে ধ্বংসস্তূপে, আশপাশ দখলে চলে গেছে। বর্ষাকালে হাউজশামসি থেকে উদ্বৃত্ত পানি নিষ্কাশনে কৃত্রিম ঝর্ণাটির সৃষ্টি। ভূগর্ভস্থ পাইপে (এখনও ধ্বংসাবশেষ দৃশ্যমান) পানি আসতো ঝর্ণায়। এখানে আছে দুটি জলাধারএকটি বর্গাকার, অন্যটি আয়তাকার। ফলকের তথ্য আর গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৭০০ সালের দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সামরিক জেনারেল নবাব গাজিউদ্দিন খান ফিরোজ জং ঝর্ণা এবং এর সামনের জলাধার সম্বলিত স্তম্ভশ্রেণির দালান নিয়ে আনন্দ উদ্যানটি গড়েন। পরে সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ উত্তরের প্যাভিলিয়নটি এবং তার ছেলে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ দুটি জলাধারের মাঝখানে একটি বারাদারি (বারো দরজার খোলা কাঠামো) যুক্ত করেন।

হাউজশামসিকে ঘিরে জাহাজমহল ও ঝর্ণা কমপ্লেক্স বিখ্যাত ফুলওয়ালন কি সাইর (ফুল বিক্রেতাদের উৎসব) উৎসবের উজ্জ্বলতম স্থান, যে আয়োজন স্পষ্টভাবে হিন্দু ও মুসলিম সমপ্রদায়কে একত্রিত করে। ১৮১২ সালে শুরু হওয়া এ প্রথা এখন দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃধর্মীয় উৎসব। এ সময় হিন্দু ধর্মালম্বীরা কুতুব সাহেবের সমাধিতে ফুলের চাদর জড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান আর মুসলিম সমপ্রদায় যোগমায়া মন্দিরে ফুলের পাখা নিবেদন করেন। জাহাজ মহলে সাংস্কৃতিক আয়োজনে অংশ নেয় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক দল। এক কাতারে উৎসবে মেতে ওঠেন হিন্দুমুসলিম সমপ্রদায়ের হাজারো মানুষ। উৎসব সংগঠকদের মতে, ‘একসময় উৎসবের জন্য জাতীয় সামপ্রদায়িক সম্প্রীতির পুরস্কারে ভূষিত হলেও এখন জায়গাটি বর্জ্যের স্তুুপ। এটা অপমানজনক’।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদিনের আলোয় রাতের অন্ধকার
পরবর্তী নিবন্ধটেকসই উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আবশ্যক