হাইলধরের রীনা সিকদার জীবনযুদ্ধে যেভাবে জয়ী হলেন

অপরাজিতার গল্প

ডেইজী মউদুদ | শনিবার , ১ জুন, ২০২৪ at ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ারার ১০ নম্বর হাইলধর ইউনিয়নের রীনা সিকদার যেন জীবনযুদ্ধে হার না মানা বিজয়িনী এক অপরাজিতা। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত দুরন্ত ও ডানপিটে স্বভাবের কিশোরী রীনার প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শুরু হয় রাজধানী ঢাকা থেকে। পিতা শামসুল ইসলামের ব্যবসা সূত্রে ঢাকায় বসবাস করায় রীনার পড়ালেখার হাতেখড়ি ঢাকা থেকেই শুরু হয়। বাবার বাড়ি হাইলধর হলেও রীনার মা রাবেয়া বেগমের বাড়ি পশ্চিম বঙ্গের করিমগঞ্জে। পরে তারা বাবার বাড়ি আনোয়ারার হাইলধর এলাকায় ফিরে এলে রীনা বশিরুজ্জামান স্মৃতি শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপরে তিনি আনোয়ারা কলেজে ভর্তি হলেই শুরু হয় তার জীবনের যুদ্ধ। রীনার মা রাবেয়া বেগমের স্বপ্ন মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। কিন্তু যেই জনপদে রীনার আবাসস্থল সেই জনপদে নারী শিক্ষার পথ ধরতে গেলেই নানা অবরুদ্ধতার বিষয় আসে। এলাকাটি অনেক রক্ষণশীল হওয়ায় রীনার জ্যাঠা কোনভাবেই রীনাকে কলেজে পড়তে দেবেন না। তাঁরা রীনাকে বিয়ে দেয়ার জন্য রীনার মাকে চাপ দিতে থাকেন । কিন্তু মায়ের একান্ত ইচ্ছে , তিনি মেয়েকে একাডেমিক শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন আলোকিত করবেন। মায়ের আর মেয়ের ইচ্ছা যুদ্ধ এক সময় হার মানে পাবিবারিক চাপের কাছে। এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করতেই, রীনার বিয়ে হয়ে যায় । এবং বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই রীনার কোল জুড়ে আসে এক কন্যা সন্তান। এরপরে স্বামীর ইচ্ছায় রীনা এইচএসসি পরীক্ষা দেন। কিন্তু দুরন্ত আর চপলা কিশোরী বধূর প্রবল ইচ্ছে, নিজে কিছু করা। কর্ম করে, পরিশ্রম করে অর্জিত শিক্ষা আর মেধা দিয়ে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। এখানেও স্বামীর অনিচ্ছা এবং প্রতিবন্ধকতা বিশাল বাধা ও কষ্টের জীবন হয়ে দাঁড়ায়। কিছু করতে চাইলে স্বামী রীনাকে নানান লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা দিতে থাকে। এমন কী শারীরিকভাবে মারধর করে, জখম করে। এসব বলতে বলতে রীনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। রীনা বলেন, এসব কথা কোনোদিন কাউকে বলিনি। বলার সুযোগও হয়নি। আজ সুযোগ পেলাম বলে কষ্টের কথাগুলো প্রকাশ করে মনটা হালকা করলাম। এতো অত্যাচার আর নির্যাতনের মাঝেও রীনা চার কন্যা ও এক পুত্রের জননী হলেন। রীনার রাজনীতি জীবনের সূচনা কলেজ জীবন থেকেই। রীনার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ভারতের আগরতলায় গিয়ে তিনি ট্রেনিং নিয়েছিলেন। জেনারেল ওসমানী নিজ হাতে তাঁকে সনদ প্রদান করেছিলেন। তবে দুঃখের বিষয় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নাম নেই। রীনা অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সনদ যোগাড় করতে পারেননি। রীনার নানা ব্রিটিশ আমলে ঢাকার দারোগা ছিলেন। তবে রীনার মা কোনো লেখাপড়া জানতেন না। নিজ ছেলের হাতে শুধু দস্তখত করাটা শিখেছিলেন। মেয়েকে পড়ানোর জন্য এই নারী সদা তৎপর থাকতেন। ছাত্রীজীবনে রীনার গল্পের বই পড়ার শখ ছিল। রীনার মা পেছনে গিয়ে প্রহরায় থাকতেন, মেয়ে কি বই পড়ছে, গল্পের বই না, স্কুলের বই। মায়ের অনুপ্রেরণায় রীনা শত প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে নিজেকে একটি সুদৃঢ় অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। রীনা বলেন, আমি ১৮ উপজেলায় ঘুরেছি। এই ১৮ উপজেলার মধ্যেই সবচেয়ে অনুন্নত এবং পিছিয়ে পড়া ছিল আমাদের উপজেলা। সেই পিছিয়ে পড়া এলাকায় অসম সংগ্রাম আর যুদ্ধ করে রীনা ২০২২ সালে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মাত্র ১১৬ ভোটের ব্যবধানে তিনি পরাজিত হন। এরপরেও থেমে নেই তাঁর পথচলা। তিনি ছুটে যান অবহেলিত নারীদের যে কোন সমস্যার সমাধান দিতে। বাল্যবিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত জটিলতায় আইনি সহায়তা প্রদান করাসহ সমাজের নানা কাজে রীনা ছুটে যান নিজ দায়িত্বে। রীনা বর্তমানে উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সংগঠক এবং ১০ নম্বর হাইলধর ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সম্পাদিকা। ২০১৯ সালে রীনা অপরাজিতা নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হন। বর্তমানে স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে রীনা খুবই খুশি। ত্রিশ বছরের সংসার জীবনের সংগ্রাম আর কষ্টের সুফল এখন রীনার জীবনাচরণের পরতেপরতে সমাদৃত। এক সময়ের কষ্ট আর গ্লানিকে এখন তাঁর কোনো কষ্টই মনে হয় না। নানা প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রীনা এখন একজন সফল নারী, সফল জননী। জয়িতা আর অপরাজিতার মুকুট তাই জ্বলজ্বল করে শোভা পায় রীনার ললাটে। অনেক অনেক শুভ কামনা এই বিজয়িনীর জন্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধসূর্যজ্যোতির পাখির গান