বাংলাদেশের সড়কের মত বিশৃঙ্খল সড়ক বিশ্বে আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। এখানে সড়কের নিয়ন্ত্রণ কারো হাতে নেই। যে যেভাবে পারে সেভাবে চলে। বিপরীত দিক থেকে চলাচল এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সড়ক মহাসড়কে চলে অতি ধীর গতির যানবাহন থেকে শুরু করে অতি দ্রুত গতির যানবাহন। সড়কের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বসে বাজার হাট ও ভ্যানের আধিক্য। আর এতে করে সড়ক সংকুচিত হয়ে তৈরি করে ভয়াবহ যানজট। ভ্যানের আধিক্য সড়ককে করেছে একটি মরণ ফাঁদ ও বিপজ্জনক একটি স্থানে। অন্যদিকে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতায় গাড়িগুলো এলোমেলো ভাবে রাখায় তৈরি হয় প্রচণ্ড যানজটের। গাড়িগুলোর মধ্যে থাকে গতির অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ড্রাইভারেরা জানে না সঠিক ট্রফিক রুল। গতি দিয়ে তারা একে অপরকে ঘায়েল করতে চায়। বেশিরভাগ ছোট গাড়ি ও মোটর সাইকেল ওভারটেক করে সড়কের বাম পাশ দিয়ে। আর এই জন্য প্রতিদিন সড়ক মহাসড়কে ঘটে প্রচুর দুর্ঘটনা, ঘটে প্রচুর প্রাণহানি। মহাসড়কে তদারকির জন্য হাইওয়ে পুলিশ থাকলেও, কোথাও জ্যাম লাগলে তারা সেখানে না গিয়ে বা রাস্তায় টহল না দিয়ে ফ্রি রাস্তায় বসে গতিমাপক যন্ত্র (স্পীড গান) দিয়ে গাড়ির গতি মেপে ব্যস্ত থাকে মামলা/ধান্দা করতে। তারা এমন জায়গায় বসে যেখানে গাড়ির গতি একটু বেশি থাকে। যেমন কোন উঁচু ব্রীজের র্যাম্পের নীচের দিকে অথবা কোন প্রশস্ত সোজা রাস্তায়।
এবার ঈদের বন্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩০ জনের অধিক। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম–কক্সবাজার সড়কে। আর সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ঈদের দিনে ২৬ জনের। ঈদের আগের দিন ৮ জনের, ঈদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন যথাক্রমে ১২ ও ১৪ জনের। ঈদের বন্ধে ১১ দিনে ২৪৯ জন মারা যায়। দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৫৭ টি। আহত ২ হাজারের বেশি। ১১৪ টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১০৬ জন।
বেসরকারি সংস্থা যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রাথমিক হিসেবে গত এক সপ্তাহে আড়াই শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় এই প্রাণহানি হয়েছে। সংস্থাটির মতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নসিমন, করিমনের মতো ধীরগতির ত্রিচক্রযানের কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
চলতি বছর ঈদুল ফিতরের দীর্ঘ ছুটিতে সড়কে তেমন ভোগান্তি না থাকলেও যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত গতি, সড়কে অযান্ত্রিক যানের বেপরোয়া চলাচল, চালক–যাত্রীদের বেখেয়ালিপনায় এতো বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে দেশে ৬,৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন ১২,০১৯ জন। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর দুর্ঘটনা বেড়েছে ০.২৩% আর প্রাণহানি বেড়েছে প্রায় ১২%। আহত বেড়েছে ৫.৩৬%।
দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে এসব দুর্ঘটনায় মানবসম্পদের ক্ষতির আর্থিক মূল্য ২১,৮৮৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম এবং সংস্থার নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
রোড সেফটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৮৯৩ জন আর শিশু ১,১৫২ জন। এতে ২,৭৬১টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয় ২,৬০৯ জন, যা মোট নিহতের প্রায় ৩৬% ও মোট দুর্ঘটনার প্রায় ৪০%। দুর্ঘটনায় ১,৫৩৫ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২১% বেশি। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৯৮৪ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি হয়েছে আঞ্চলিক সড়কে, এর সংখ্যা ২,৭৩৬টি। এটি মোট দুর্ঘটনার ৩৯% বেশি। আর ২,৩৫৭টি হয়েছে জাতীয় মহাসড়কে, ৯৭২টি গ্রামীণ সড়কে, ৭৮৪টি শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৭৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার মধ্যে সবেচয়ে বেশি হয়েছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ২,৯০৮টি। এছাড়া ১,৫২৭টি মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং ১,৫৬২টি পথচারীকে চাপা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ৭৮২টি যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৪৮টি অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
রোড সেফটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো পণ্যবাহী যানবাহন। এরপরেই আছে মোটর সাইকেল, থ্রি–হুইলার (ইজিবাইক–সিএনজি–অটোরিকশা–অটোভ্যান ইত্যাদি), যাত্রীবাহী বাস, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন–ভটভটি–আলমসাধু–মাহিন্দ্রা–টমটম) ইত্যাদি।
২০২৪ সালে দুর্ঘটনাকবলতি যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১১,৭৯৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো পণ্যবাহী যানবাহন ৩,১৪৫টি। মোটর সাইকেলের সংখ্যা ২,৯৭৮। সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে সকালে ১,৮৭৪টি। আর রাতে হয়েছে ১,৫৪৮টি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় যানজটের কারণে যানবাহনের চালকদের আচরণে অসহিষ্ণুতা ও ধৈর্যহানি দেখা যায়, যা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কাজ করছে।
২০২৪ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২,৭৬১টি, নিহত হয়েছেন ২,৬০৯ জন, আহত হয়েছেন ১,৮৩২ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১,৯৬৩ জন বা ৭৫ শতাংশের বেশি ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে বাস ও পণ্যবাহী ভারী যানবাহনের ধাক্কা বা চাপায়। এসব দ্রুতগতির যানবাহনের চালকদের অধিকাংশই অসুস্থ ও অদক্ষ। তাঁদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর কারণে দক্ষ মোটরসাইকেল চালকেরাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্তৃপক্ষের নানা প্রকার অনিয়ম ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ হতাহত হচ্ছেন। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অভাবে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হচ্ছে না। সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশের অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনাই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
রোড সেফটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সড়ক ও সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজে বিআরটিএ, ডিটিসিএ, বাংলাদেশ পুলিশ, বিআরটিসি,সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ইত্যাদি নানা প্রতিষ্ঠান জড়িত। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থাপনা এবং কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। জবাবদিহি নেই বললেই চলে। এসব কারণেই সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না, দুর্ঘটনাও কমছে না।
আসলে স্বাধীনতার পর থেকে সড়ককে নিরাপদ, গতিশীল ও দুর্ঘটনা মুক্ত করার পরিকল্পনা কোন সরকার নেয়নি। সড়ক হলো নির্বিঘ্নে চলাচলের একটি মাধ্যম। যে কোনো দূরত্বে পৌঁছার একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। সে সময়ের মধ্যে না পৌঁছালে তা যাত্রী ও গাড়ির মালিক উভয়ের জন্য ক্ষতিকর ও বেদনাদায়ক। তাই সড়কে থাকতে পারবে না কোনো প্রতিবন্ধকতা। বসবে না কোনো বাজার হাট। হতে পারবে না কোনো সমাবেশ বা মিছিল মিটিং। চলবে না কোনো ধীরগতির যানবাহন যেমন থ্রি হুইলার, অটো রিক্সা, ব্যাটারী চালিত গাড়ি অথবা দেশীয় টোটকা প্রযুক্তিতে তৈরি কোনো যানবাহন। চলতে পারবে না বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো গাড়ি। চলবে না ত্রুটিযুক্ত কোনো গাড়ি। হালনাগাদ ডক্যুমেন্ট ছাড়া কোনো গাড়ি রাস্তায় চলাচলের উপর কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ ও ড্রাইভিং নিয়ে করতে হবে কঠোর নজরদারি। সঠিক ট্রাফিক আইন না জানা কেউ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারবে না। দরকার হলে ড্রাইভারদেরকে প্রতি বছর পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে এবং আমি নিশ্চিত এতে ৮০% এর অধিক ড্রাইভার অকৃতকার্য হবে। পুরো দেশের হাইওয়েতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা বসিয়ে করতে হবে কঠোর নজরদারি। মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটারের গতিসীমা বাড়িয়ে ১০০ কিলোমিটার করতে হবে। কারণ দুর্ঘটনা কখনো শুধুমাত্র গাড়ির গতির জন্য হয় না। হয় ত্রুটিযুক্ত গাড়ি ও চালকের কন্ট্রোলিং এর জন্য। প্রতিটি মহাসড়কে লেন সংখ্যা বাড়িয়ে অন্তত ৩টি করতে হবে এবং ফাস্ট লেইনে শুধুমাত্র গাড়ি ওভারটেকিং হবে–এর প্রশিক্ষণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কঠোর ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়ককে দ্রুত চার লেইনের সড়কে রূপান্তরিত করতে হবে। হাইওয়ে পুলিশকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না রেখে সড়কে মনিটরিং ও টহলের মধ্যে থাকতে হবে। তবেই হয়ত সড়ক মহাসড়কে শৃংখলা ও স্বস্তি ফিরে আসবে!
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।