আরো দু-বছর বাদে অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট-নির্বাচন। হলে কী হবে, আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এখন থেকেই মার্কিন-রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত। যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক তা হলো- কে হতে যাচ্ছেন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের -ডেমোক্রেটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টি- প্রার্থী? আর যে দুই ব্যক্তিকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনা তারা হলেন, ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। রিপাবলিকান দলে এবং ভোটারদের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগ তক অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা থাকলেও, জো বাইডেনের সেটি ছিলনা। ছিলনা দলের ভেতর এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোট ব্যাংকেও। সমপ্রতি অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা ৪০% নিচে নেমে এসেছিল। সবাই এক প্রকার নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন যে ডেমোক্রেটিক পাটির্র ভরাডুবি হবে। তবে দল হাউজ অব রিপ্রেসেন্টেটিভসসে সামান্য ব্যবধ্যানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও সিনেট ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টি ধরে নিয়েছিল তাদের দেশ জুড়ে ‘ল্যান্ডস্লাইড ভিকট্রি’ বা ‘ভূমিধস বিজয়’ হবে, দেশজুড়ে ‘রেড ওয়েভ’ বা ‘লাল ঢেউ’ উঠবে, কিন্তু তেমনটি হয়নি। আর তাই জন্যে দলের নেতারা দুষছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, যিনি দলের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজ পছন্দমাফিক ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী মধ্যবর্তী নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছিলেন এবং তাদের প্রায় সবাই হেরেছেন। তার একগুয়েমিতা ও প্রার্থীদের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারণাভিযানে উল্টাপাল্টা বক্তব্যের কারণে এবং তার আগের অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে অনেক সুইং ভোটার বা দোদুল্যমান ভোটাররা রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থীদের ভোট দেননি। ফলে দল আশানুরূপ ফল অর্জন করতে পারেননি। মজার ব্যাপার হলো, এই যখন এই দুই ব্যক্তির অবস্থান, দুজনেই ইতিমধ্যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে তাদের ইচ্ছে পোষণ করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যে এই মর্মে ঘটা করে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখনো ঘটা করে ঘোষণা দেননি বটে তবে তিনি যে প্রার্থী হবেন সে ইচ্ছে ইতিমধ্যে নানা সময় প্রকাশ করেছেন এবং জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সিদ্ধান্তটি তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে জানাবেন।
কিন্তু এই দুজনকে তাদের নিজ নিজ দল চাইছে না যে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। বাইডেনের ব্যাপারে যে প্রশ্নটি বারবার উঠে আসছে তা হলো তার বয়স। বর্তমানে তার বয়স ৮২, যা আমেরিকার ইতিহাসে রেকর্ড। ২০২৪ সালে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হবেন তখন তার বয়স বেড়ে দাঁড়াবে ৮৪ বছর। তার অন্যান্য যোগ্যতা বা প্লাস পয়েন্টকে ছাড়িয়ে তার বয়স হয়ে দাঁড়াবে নির্বাচনী ইস্যু যা ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্যে নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও দলের নেতারা এমন কী অনেক সমর্থক-ভোটাররা তাই মনে করেন। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন বয়সের কারণে জো বাইডেন আগামী নির্বাচনে দাঁড়াবেন না এবং নেতৃত্ব দলের তরুণদের মাঝে হস্তান্তর করবেন। তেমনটি তিনি বলেছিলেন ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়িয়ে তহবিল সংগ্রহ করতে গিয়ে। তিনি বড় গলায় বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে একজন ট্রানজিশন প্রার্থী হিসাবে দেখি।’ নিজেকে তরুণ ডেমোক্র্যাটদের কাছে ‘সেতু’ তুলনা করে তিনি তাদের আগামীতে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আপনাকে আরো বেশি লোককে দলে পেতে হবে, যারা ভেতরে যেতে প্রস্তুত। আমাকে কোচে রাখুন, আমি খেলতে প্রস্তুত।’ এই প্রসঙ্গে সমপ্রতি এক মার্কিন সাংবাদিক মন্তব্য করেন, ‘হোয়াইট হাউস একবার বাড়ি হয়ে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। আর জো বাইডেন তার জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন এই অফিস (হোয়াইট হাউস) পাবার জন্য।’ আসলে চেয়ারের মায়া বড় মায়া। একবার তাতে আসীন হলে সহজে তা ছাড়তে ইচ্ছে করেনা। সে বাংলাদেশ হোক অথবা সেনেগাল। আর ‘হোয়াইট হাউস’ হলে তো কথাই আলাদা। কী না করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ধরে রাখতে? তার মারমুখী সমর্থক, গুন্ডা বাহিনী লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমেরিকার মত দেশে এমনটি, ভাবা যায়?
এদিকে নিকটজনের কাছে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ব্যক্ত করে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, তার বিশ্বাস দলের মধ্যে তিনিই একমাত্র প্রার্থী যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারাতে সক্ষম। প্রেসিডেনশিয়াল ঐতিহাসিকবিদ ডগলাস ব্রিঙ্কলে প্রশ্ন তোলেন, ‘তিনি (বাইডেন) কেন সরে দাঁড়াবেন? তার কোন স্পষ্ট উত্তরসূরি নেই। জো বাইডেনই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম হবেন এবং ডেমোক্রেটসরা মনে করেন তিনি এই কাজটি আবার করতে সক্ষম হবেন।’ উল্লেখ্য, ২০২০ সাল নির্বাচনে জো বাইডেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিওবা ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পরাজয়কে এখনো মেনে নেননি এবং সেই নির্বাচন ছিল কারচুপির নির্বাচন এমন অভিযোগ এনে এখনো সমানতালে বলে চলেছেন। তবে এই মর্মে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাইডেনের পক্ষে যারা তারা বলেন, এমন নয় যে বাইডেনই একমাত্র বয়স্ক রাজনীতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো অনেক বয়স্ক রাজনীতিবিদ সক্রিয় রয়েছেন এবং তারা তাদের দায়িত্ব খুব ভালোভাবেই পালন করছেন। তারা আরো বলেন, ওয়াশিংটনে বয়স একটি ‘নর্ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন বাইডেন হলেন দেশটির প্রথম অশীতিপর প্রেসিডেন্ট, স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির বয়স ৮২ (গেল সপ্তাহে তিনি পদত্যাগ করার কথা ঘোষণা দেন), সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককনেলের বয়স ৮০, হাউস মেজরিটি লিডার স্টেনি হোয়ারের বয়স ৮৩, সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা চাক সুমারের বয়স ৭১। অন্যদিকে, ট্রাম্পের বয়স ৭৬, আগামী প্রেসিডেন্ট-নির্বাচনের সময় তার বয়স হবে ৭৮ বছর।
এখন প্রশ্ন, এই দুই প্রার্থী- জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিকল্প প্রার্থী কে? প্রথমে আসি জো বাইডেন প্রসঙ্গে। সাধারণত দেখা যায়, যদি সিটিং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে না দাঁড়ান, সেক্ষেত্রে সিটিং ভাইস প্রেসিডেন্ট দলের প্রার্থী হন। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। ২০২০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৫৮ বছরের এই মহিলা চমকে দিয়েছিলেন সবাইকে। তিনি হলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম এশীয়-আমেরিকান। গেল বছর তিনি মাত্র ৮৫ মিনিটের জন্যে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন যখন জো বাইডেনকে শারীরিক কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘অল দেট গ্লিটারস, ইজ নট গোল্ড’, অর্থাৎ ‘চকচক করিলেই সোনা হয় না’। কমলা হ্যারিস বিগত দুই বছরে খুব একটা চমক দেখতে পারেননি এবং বর্তমানে তার জনপ্রিয়তা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চাইতেও কম। অর্থাৎ কমলা ফেইড আউট। ফেইড ইন -গেভিন নিউসম, ৫৫-বছরের ক্যালিফোর্ণিয়ার গভর্নর। তার নাম বেশ শোনা যাচ্ছে বাইডেনের বিকল্প হিসাবে। তার পেছনে ডেমোক্রেটিক ডোনারদের শক্ত সমর্থন আছে বলে ধারণা করা হয়। বের্নি স্যান্ডার্সের নামও কিছু কিছু শোনা যাচ্ছে, তবে তার পেছনে সমর্থন খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। কেননা ৮১ বছরের স্যান্ডার্স অতিমাত্রায় ‘সোসালিষ্ট’ হিসাবে পরিচিত এবং সে কারণে দলের অনেকেই তার পক্ষে নয়। যেবার (২০১৬) হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের সাথে লড়ে হেরে গেলেন, সেবার বের্নি স্যান্ডার্স দলের প্রার্থী প্রতিযোগিতায় হিলারির সাথে সামান্য ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন, সেই সময় হিলারির পরিবর্তে স্যান্ডার্স যদি প্রার্থী হতে পারতেন তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারানো যেত। সে সময় স্যান্ডার্সের যে গ্রহণযোগ্যাতা ছিল এখন তা খুব একটা নেই বলে ধারণা। তদুপুরি তার বয়সও একটি ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াবে নির্বাচনের সময়। ‘প্রগ্রেসিভ ক্যাপিটালিস্ট’ হিসাবে পরিচিত ভারতীয়-আমেরিকান রো খান্নার নামও শোনা যাচ্ছে। সিলিকন ভ্যালি থেকে নির্বাচিত এই আইন প্রণেতা অবশ্য ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘জো বাইডেন দাঁড়ালে তিনি প্রার্থী হবেন না।’
এতো গেল ডেমোক্রেটিক পার্টির পরিস্থিতি। দেখা যাক রিপাবলিকান দলের দশা। আগেই উল্লেখ করেছি, মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগেও দলের ভেতর ও বাইরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল এখন আর তা নেই। তার সম্ভাব্য বিকল্প প্রার্থী হিসাবে দি স্যান্টিসের নাম উঠে এসেছে। স্যান্টিস গত মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে সবার নজর কাড়েন। রিপাবলিকান দলের ভেতর ও বাইরে অনেকেই মনে করেন সুদর্শন এই আইন প্রণেতা (জন্ম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮) ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিকল্প হিসাবে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ালে জেতার সমূহ সম্ভাবনা। তাকে নিয়ে মার্কিন মিডিয়ারও আগ্রহ লক্ষ্যণীয় এবং তাকে রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে ধরে নেয়া হচ্ছে। অবশ্য তিনি এখনো এই ব্যাপারে তার মুখ খুলেননি। নির্বাচনে জয়ী হবার পর সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন তিনি আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াবেন কিনা। হ্যাঁ বা না সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তিনি তার বর্তমান দায়িত্বের প্রতি মনোনিবেশ করতে চান। এই উত্তরে ক্ষেপেছেন ‘ক্ষ্যাপা’ ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি (স্যান্টিস) ‘দাঁড়াবেন না’ তেমন ধরনের স্পষ্ট উত্তর না দেয়ায় অনেকের ধারণা তিনি দাঁড়াতেও পারেন। একই ধারণা বোধ করি ট্রাম্পেরও। আর সে কারণে এক হাত নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্যান্টিসের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেন, তিনি নিন্মমানের রাজনীতিবিদ ও ব্যক্তি, আনুগত্য বলে তার কিছু নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন দেখার বিষয় শেষমেশ ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টি- এই দুই দল থেকে কে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী নির্বাচিত হন। আর তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট