ক’দিন ধরে আকাশটা মেঘলা। মাঝে মাঝে গুড়িগুড়ি অহল্যা বৃষ্টি। ঘরের বাইরে যাবার তাগিদ না থাকলে কোন সমস্যা নেই। তখন মনের মধ্যে গুন গুন করে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়/ এমন দিনে মন খোলা যায়’। কিন্তু কাজে কিংবা প্রয়োজনে ঘর হতে বাইরে পা দিতে গেলে তখন মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায়। এমনিতেই প্রকৃতির সাথে মনের একটা যোগসাজশ আছে। ফুরফুরে রৌদ্রস্নাত দিন হলে মনটাও থাকে ফুরফুরে। গতকাল সারাটা দিন ছিল মেঘলা আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আজ সকালে হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্ট ছিল চোখের ডাক্তারের সাথে। রাতেই মোবাইলে চেক করে নিয়েছিলাম আজকের সকালে আবহাওয়া কেমন থাকবে, তা জানার জন্য। বলা হলো বৃষ্টি থাকবেনা। দুপুরের দিকে কিছুটা রৌদ্রের দেখা মিলতে পারে। হাসপাতাল থেকে বাসা খুব দূরে নয়। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়। গতকাল রাতে ঠিক করে রেখেছিলাম বৃষ্টি না হলে হেঁটে বা সাইকেলে যাবো। গাড়ি নিয়ে গেলে পার্কিং সমস্যা। এপয়েন্টমেন্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। দিন কয়েক আগে হাসপাতাল থেকে মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছিল আজকের এপয়েন্টমেন্টের কথা। এপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছিল সপ্তাহ দুয়েক আগে। বিষয়টি এমন, আপনার মনে না থাকলেও হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফোন করে বা এসএমএস পাঠিয়ে আপনাকে আপনার এপয়েন্টমেন্টের কথা মনে করিয়ে দেবে। যদি কোন কারণে নির্দিষ্ট দিন-সময়ে যেতে অপারগ হন, তাহলে তার আগের দিন ফোন করে তা বাতিল করতে পারেন এবং নতুন তারিখ ঠিক করতে পারেন। কেনা-কাটার দোকানে কাস্টমার যেমন ‘রাজা’, রোগীরা সেই অর্থে এ দেশে রাজা। তাদের প্রাধান্য বেশি। আর তাদের এই প্রাধান্যটা নিশ্চিত করেছে দেশের শাসনতন্ত্র – সবার জন্যে সুষ্ঠূ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ধনী-মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিব সবার জন্য সমান চিকিৎসা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত। তবে তারজন্যে প্রত্যেকটি নাগরিকের স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক। হল্যান্ডে স্বাস্থ্য খাতে জনপ্রতি ব্যয়ের পরিমাণ হলো বাংলাদেশী মুদ্রায় বছরে চার লক্ষ টাকার কিছু বেশি, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। ইউরোপে এই ব্যয়ের পরিমাণ জনপ্রতি দুই লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। এটি হল্যান্ডের জিডিপির ১০,৭%। এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে হল্যান্ড মানুষের গড় আয়ু ৮১,৬ বছর (২০১৫), ২০০০ সালে এটি ছিল ৭৮,২ বছর। মহিলার চাইতে ডাচ পুরুষরা বেশিদিন বাঁচে বলে স্বাস্থ্য বিভাগের এক প্রতিবেদনে জানা যায়। হৃদরোগের কারণের অকালে মৃত্যু প্রতিরোধ করার কারণে এই আয়ু বৃদ্ধি বলে জানা যায়, তবে ইদানিং হল্যান্ডে ফুসফুসের ক্যান্সার ও ডিমেনশিয়ার কারণে মৃত্যুহার বাড়ছে।
হল্যান্ডের অনেক ভালো দিকের অন্যতম হলো চমৎকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আপনার স্বাস্থ্য আপনার হতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের চিন্তা যে আপনার চাইতেও বেশি। এ যেন অনেকটা যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শীর ঘুম নাই ধাঁচের। যেমন ধরুন এক ডায়াবেটিস রোগী। ওনার কখন চেক আপ করাতে হবে, কিংবা কখন ব্লাড টেস্ট করতে হবে, তা সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দেবে হাসপাতাল বা ডাক্তারের চেম্বার থেকে। আপনাকে কেবল নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত থাকতে হবে। বয়স বেশি, সাথে যাবার কেউ নেই। নো প্রবলেম। আছে বিশেষ ট্যাক্সি ব্যবস্থা। আপনি কেবল ফোন করেই খালাস। টেক্সি আপনার দোরগোড়ায় এসে আপনাকে নিয়ে যাবে, কাজ শেষে বাসায় পৌঁছে দেবে। আপনি অপেক্ষা করবেন ওয়েটিং রুমে। নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার নিজে এসে আপনার নাম ধরে ডেকে, আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার কামরায় নিয়ে যাবেন। আপনার সমস্যা ধীরে-সুস্থে, সময় নিয়ে শুনবেন এবং আপনি তাকে তাবৎ প্রশ্ন করতে পারেন, যদি আপনার তা থেকে থাকে। ডাক্তার কোনভাবেই, কোন সময়ে বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। বিগত ৩১ বছর অতি উন্নত এই দেশটিতে থেকে এ আমার অভিজ্ঞতা। ডাক্তারের ব্যবহার রোগীর অর্ধেক রোগ সারিয়ে দেয়। আমাদের কেউ কেউ বলেন, ‘এই ব্যবহার আমাদের দেশে তো বটেই, ইংল্যান্ডেও বিশেষ করে লন্ডন এবং যে সমস্ত এলাকায় বাংলাদেশী, ভারতীয় ও এশীয় ডাক্তার রয়েছেন সেখানে পাবেন না’। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো আছে। তবে তা হাতে গোনা। বাংলাদেশের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু লন্ডনে এমনটি হবে কেন? সেখানে আছেন প্রচুর এশীয় (ভারতীয়, বাংলাদেশী, পাকিস্তানী) ডাক্তার। তাদের অনেকের কাছে জোটে অনুরূপ আচরণ। এ আমার শোনা কথা নয়। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী বুলবুল জামান নিয়মিত আমস্টারডাম-লন্ডন আসা-যাওয়া করেন। ওনার স্ত্রী কন্যা থাকেন সেখানে। বুলবুল জামানের মুখের কথায় বলি, ‘একবার লন্ডনে শরীরের অবস্থা খুব খারাপ হলে ডাক্তার দেখাই। গিয়ে দেখি সেখানকার ডাক্তারের আচরণ আমাদের দেশের মত। অথচ হল্যান্ডে এমনটি নয়। ঠিক করলাম, এখানে নয়, হল্যান্ডে বাকি চিকিৎসা করবো। আমস্টারডাম এলাম, কদিনের মাথায় অপারেশন হলো। কোন ঝামেলা নেই, ডাক্তারের সুন্দর আচরণ। অল্পদিনে ভালো হয়ে উঠলাম।’ সমাজকর্মী, নিজের ক্ষতি করে অন্যের উপকার করে বেড়ানো এম এম মনোয়ার দীর্ঘ ৩২ বছর হল্যান্ড থাকার পর বছর কয়েক আগে চলে গেলেন লন্ডন, গোটা পরিবার সহ। মাঝে মধ্যে ফিরে আসেন। তার স্ত্রী অসুস্থ, অপারেশন প্রয়োজন। ভরসা পেলেন না পূর্ব লন্ডনের হাসপাতালে করতে। সেখানে এশীয় ডাক্তারই বেশি। চলে এলেন হল্যান্ড, হেগ শহরের এক হাসপাতালে অপারেশন হলো। এই দুজনের বক্তব্য, ওখানকার এশীয় ডাক্তারদের আচরণ আর ইউরোপীয় ডাক্তারদের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের অভিমত, আমাদের ‘জিনের’ মধ্যে কোন সমস্যা আছে মনে হয়।
হল্যান্ডের যে শহরে আমি থাকি অর্থাৎ হেগে, সেখানকার একটি হাসপাতালে আজ আমার এপয়েন্টমেন্ট ছিল। এপয়েন্টমেন্ট ছিল সকাল পৌনে ন’টায়। পাঁচ মিনিট আগে হাসপাতাল পৌঁছাই। ঢুকতেই হল ঘরে পাশাপাশি দশ/বারটা মেশিন, দেখতে এটিএম মেশিনের মত। মেশিনে ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখতেই স্ক্রিনে ভেসে আসে নির্দেশাবলী- ‘আপনার এপয়েন্টমেন্ট পৌনে নটায়, আপনি অমুক কামরার সামনে অপেক্ষা করুন’। আমার কেবল এক চোখে ইনজেকশন দেয়া হবে। বসার মিনিট দুয়েকের মধ্যে প্যারা মেডিকসের এক মহিলা দরোজা খুলে নাম ধরে ডাকলেন। উভয়ে উভয়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভেতরে ঢুকি। মহিলা দরোজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, আপনার কোটটা হ্যাঙারের রাখতে পারেন। যিনি ইনজেকশন দেবেন, হ্যালো বলে আমার নাম, জন্মতারিখ, কোন চোখে ইনজেকশন- এই তিনটি বিষয় জানতে চাইলেন। কম্পিউটারে চেক করে দেখলেন ঠিক রোগীকে উনি দেখছেন কিনা, কিংবা ঠিক ঔষধটি প্রয়োগ করছেন কিনা। নিশ্চিত হয়ে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করলেন, কী করা হবে, ব্যথা যাতে না পাই, সে জন্যে চোখের কোণায় বাড়তি-ড্রপ দিয়ে ওই স্থানটুকু সেন্সলেস করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বললেন, আমি প্রথমে টেস্ট করবো, ব্যথা পেলে জানাবেন। এর পর ইনজেকশন দেব। পুরো ব্যাপারটি শেষ করতে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। চলে এলাম বাসায়। এই কাজটুকু দেশে করতে গিয়ে কত বেগ পেতে হতো। প্রথমে আমাকে খুঁজতে হতো আমার কাছের কোন বন্ধু ডাক্তার বা কারো রেফারেন্সে কোন ডাক্তার। না হলে একে ধরো, ওকে ধরো। আমাদের দেশে যে ব্যবস্থা নেই, তা নয়। আমাদের দেশে সব আছে, কিন্তু কোন কিছু করতে গেলে আপনাকে কারো না কারো রেফারেন্সে যেতে হবে। দিন কয়েক আগে ভাইপোর ১০/১২ বয়েসী ছেলের ডেঙ্গু হয়ে উত্তরা বাড়ির কাছে এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ব্লাড টেস্ট করা হলো। রিপোর্ট আসে না, রোগীরা দশা মন্দের দিকে। তড়িঘড়ি করে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতাল। রোগীর বাবার আর্থিক দশা ভাল জেনে বলা হলো, আইসিইউতে ভর্তি করাতে হবে। কেউ কেউ বলেন, প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আইসিইউতে ভর্তি করানো মানে গলা-কাটা। যাই হোক ভর্তি করা হলো। তারপর খোঁজ পাওয়া গেল রেফারেন্স। এখন ভাল নজরদারিতে রয়েছে, কেননা সেখানকার ডাক্তারের রেফারেন্স রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এমনটি কেন হবে- রোগী আসলে ডাক্তার রোগীকে দেখবে, চিকিৎসা করবে প্রয়োজন অনুযায়ী। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রায় ক্ষেত্রে তেমনটি হয়না।
সবশেষে একটি ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করবো আজকের এই লেখা। দেশের বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, লেখক ও সাংবাদিক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেন্ডারিয়ার কোন এক শুনেছি ভালো হাসপাতালে (ক্যান্সার) গেলেন, সাথে স্ত্রী ঝর্ণা। বেশ রাত। রোগী এটেন্ড করার তেমন কেউ নেই। ডাক্তার আসে আসে করে অনেকটা সময় কেটে গেল। রোগীর দশা মন্দের দিকে।
শেষে বাধ্য হয়ে ঝর্ণা ফোনে ব্যাপরটা বললেন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মেজদা, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে হুলুস্থল, একের পরিবর্তে কয়েক ডাক্তার এলেন। তাদের একজন বলেন, ‘আগে বলেননি কেন যে আপনি ওনার ভাই’, ইত্যাদি ইত্যাদি। নো কমেন্ট! সময়ের সাথে বয়স বাড়ছে। বয়স যত বাড়ছে, শরীরও তত বেঁকে বসছে। আমার তো আর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস নেই। একটা সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশে ফিরে যাবো জীবনের একটি সময়ে এসে। এখন আগেকার সেই মনের জোর পাইনে। তবে কি মনের মধ্যে কোন এক ভীতি বাসা বেঁধেছে?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট