ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট-নির্বাচনে সিটিং প্রেসিডেন্ট কট্টর ডান নেতা জইর বলসোনারো তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বামঘেঁষা রাজনীতিবিদ লুলা দা সিলভারের কাছে হেরে গেলে গোটা বিশ্ব যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কেননা এই নির্বাচন কেবল দুটি দল বা ব্যক্তির রাজনৈতিক যুদ্ধ নয়। এর সাথে ছিল গোটা বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ভবিষ্যত ও গণতন্ত্রের পুনঃযাত্রা। আর সে কারণে গোটা বিশ্ব অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিল ব্রাজিলের নির্বাচনের দিকে। নির্বাচনের দিন কয়েক আগ থেকে আমিও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম ঘটনা কোন দিকে গড়ায় তা দেখার জন্যে। দুজনের মধ্যে হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ভোটের ব্যবধানও তেমন বেশি ছিল না, দুই শতাংশের কিছু কম। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার আগ থেকে বলসোনারো নির্বাচন-পদ্ধতির সমালোচনা করেন এবং কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেন, এই নির্বাচনে কারচুপি হবে। এক পর্যায়ে তিনি নির্বাচন বাতিল করার দাবিও করেন, যদিও বা সে দাবি প্রধান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। গেল রোববার নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বলসোনারো একেবারে নীরব থাকেন। তার এই নীরবতাকে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা অশনি সংকেত ধরে নিয়ে আগামী দিনে দেশে সহিংসতার সম্ভাবনা খুঁজে পান। কেননা নির্বাচনের আগ থেকেই বলসোনারো বলতে থাকেন যে, একমাত্র সৃষ্টিকর্তা চাইলে তিনি পরাজিত হবেন, তিনি আশাবাদী যে তিনি এই নির্বাচনে জিতবেন, যদি হারেন ধরে নিতে হবে ভোটে কারচুপি হয়েছে। সবাই ধরে নিয়েছিল বলসোনারো এই পরাজয় মেনে নেবেন না, সেই কারণে মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার সমর্থকরা রাস্তা ব্লক করে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। তারা ভারী যানবাহন দিয়ে সড়ক অবরোধ করে। গোটা ব্রাজিল রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে থাকে কখন বলসোনারো জনসমক্ষে আসবেন এবং কী বলেন। গতকাল (১ নভেম্বর) বলা হলো, উনি আজ তার বক্তব্য রাখবেন। অধীর আগ্রহে টিভির সামনে অপেক্ষা করছি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তিনি এলেন, চোখে-মুখে বিরক্তি ভাব, কোনো হাসি নেই, যেন রাগান্বিত-তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তাই মনে হলো। মাত্র দুই-মিনিটের বক্তব্যে তিনি সরাসরি নির্বাচনে পরাজয়ের কথা উল্লেখ না করলেও বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা বলেছি। স্বস্তির নিঃস্বাস পড়লো, আমার এবং ব্রাজিলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যারা ব্রাজিলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন তাদের। তবে তিনি তার সমর্থকদের রাস্তা অবরোধ থেকে সরে আসার কোনো আহবান রাখেননি। উল্টো বলেন, এই সমস্ত বিক্ষোভ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের ক্ষোভের ফসল। তিনি অভিনন্দন জানাননি নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলাকে, এমন কী তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিনি বলেন, আমাকে বরাবর অগণতান্ত্রিক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অথচ আমি বরাবর দেশের শাসনতন্ত্র মোতাবেক কাজ করেছি। অনেকেই আশংকা করেছিলেন ট্রাম্পের মত বলসোনারো তার পরাজয়কে মেনে নেবেন না এবং জনগণকে উস্কে দেবেন দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে ও উত্তপ্ত করে তুলতে। সেটি হয়নি, সেখানেই স্বস্তি।
২) শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম বলসোনারোর পরাজয়ে গোটা বিশ্ব হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কেন? প্রধান কারণ-‘জলবায়ু পরিবর্তন’। বৈশ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় ব্রাজিলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমাজন রেইন ফরেস্ট’ বা আমাজন জঙ্গলের কথা কে না শুনেছে! পৃথিবীর ফুসফুস হিসাবে খ্যাত আমাজন ফরেস্টের আয়তন প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার। ব্রাজিলের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেশির ভাগ এলাকা, পেরু, কলম্বিয়া সহ দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশ জুড়ে বিস্তৃত এই ‘আমাজন জঙ্গল’। এই বনাঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ ব্রাজিলের মধ্যে। প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছরের এই বিশাল বনাঞ্চল বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। কিন্তু এই বনাঞ্চল অনেক বছর ধরে হুমকীর মুখে। নির্বিচারে বন কেটে, আগুন লাগিয়ে বন উজাড় করা হয়েছে। বলসোনারোর বিগত চার বছরের শাসনামলে এই ধংসযজ্ঞ আরো বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট বলসোনারো স্থানীয় কৃষকদের আমাজন জঙ্গলে আগুন দিতে উৎসাহ দিয়েছেন- এমন অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলির। এই ব্যক্তি যদি আবার ক্ষমতায় আসেন তাহলে আগামী চার বছরে যে এই ধংসযজ্ঞ আরো চলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ এবং বন উজাড় করার উদ্যোগ বন্ধ করার ডাক দিলেও তিনি কারো কথায় কর্ণপাত করেননি। দেশটির শাসক যদি পরিবেশ-বান্ধব না হন, বন রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম না হন এবং পরিবর্তে বন উজাড় করার মত পদক্ষেপ নেন, তখন একজন সাধারণ বিশ্ব-নাগরিক হিসাবে আমারও শংকিত হবার কথা। আর সে কারণে কদিন ধরে বেশ টেনশনে ছিলাম। টেনশনে ছিলাম ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে। পারবেন তো লুলা দা সিলভার তার প্রতিপক্ষ কট্টর ডানপন্থী নেতা জইর বলসোনারোকে হারাতে? জইর বলসোনারো হারুক সেটি মনে প্রাণে চেয়েছিলাম। তাকে হারানো খুব জরুরি। তাতে বিশ্বের মঙ্গল, গণতন্ত্রের মঙ্গল।
সামরিক কর্মকর্তা (মেজর) থেকে রাজনীতিতে আসা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারো প্রেসিডেন্ট হয়ে এমন আচরণ শুরু করেন যা কেবল একজন স্বৈরাচারের পক্ষেই সম্ভব। গণতন্ত্রের প্রতি তার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই, অন্যের মতামতের ধার ধরেন না। কোভিডের সময় গোটা দেশ, এমন কী গোটা বিশ্ব যখন একদিকে তখন তিনি তার নিজ পথে চলেছেন। তিনি বলে বেড়িয়েছেন এই সমস্ত মিথ্যে। কোভিডকে ঘিরে তার নেয়া হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে ব্রাজিলে সাত লক্ষ নাগরিকের মৃত্যু হয়। কোভিডকে তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন শুরু থেকে এবং জনগণকে উৎসাহিত করেছেন কোন স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলতে। কোভিডকে ঠেকানোর জন্যে নেয়া সমস্ত পদক্ষপকে তিনি খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড- ঠেকানোর সমস্ত উদ্যোগকে ‘স্যাবোঁজ’ করেছেন। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে বলেছিলেন। বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে তিনি বলেছিলেন, ষাটোর্ধ ব্যক্তিরা কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে, অতএব স্কুল বন্ধ রাখার কোনো যুক্তি নেই। এমন ব্যক্তি কেবল তার নিজ দেশের জন্যে নয়, গোটা বিশ্বের জন্যে যে ক্ষতিকর ও ভয়ংকর তা বলা বাহুল্য।
৩) তার তাবৎ কার্যকলাপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দারুণ মিল লক্ষ্যণীয়। ট্রাম্প যা যা করেন বা বলেন, ঠিক তাই বলতে ও করতে দেখা গেছে গত চার বছর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বলসোনারোকে। শুরু থেকে ট্রাম্প কোভিডকে অস্বীকার করেছেন, বলসোনারোও তাই করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন এই সব ‘ফেইক’, একই কথা বলেছেন বলসোনারোও। জলবায়ু নিয়ে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগকে ডোনাল্ড ট্রাম্প উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সরে এসেছিলেন গ্লোবাল ক্লাইমেট সামিট থেকে। বলসোনারোও বারোটা বাজিয়েছেন আমাজন ফরেস্টের। ট্রাম্প ও বলসোনারো- দুজনের চেহারা ও সুরতে মিল না থাকলেও দুজনের আদর্শ, কার্যক্রমে বেশ মিল লক্ষ্য করা যায়। গণতন্ত্রের প্রতি কারো বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাবার পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজয়কে মেনে নেননি এবং এক নাগাড়ে মিথ্যাচার করে গেছেন এবং এখনো তা চালিয়ে যাচ্ছেন। জনগণকে উস্কে দিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালিয়েছেন তিনি। জনগণের রায়কে অশ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি চেয়েছিলেন ‘ক্যু’ ঘটাতে। মোট কথা আমেরিকার গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বারোটা বাজিয়েছেন এই এক ব্যক্তি, ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর ট্রাম্পের পদাংক অনুসরণ করে বলসোনারো নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, এই নির্বাচনে তিনি জিতবেন, যদি হারেন সেটি হবে ষড়যন্ত্রের কারণে এবং তিনি তা মেনে নেবেন না। রিওর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থমাস ট্রুম্যানের মতে, ‘ট্রাম্প হচ্ছেন তার আইডল এবং মডেল। বলসোনারো প্রকাশ্যে স্বৈরাচারকে নিয়ে উল্লাস করেছেন এবং মহিলাদের অপমান করেছেন’। এই ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থান সবার জানা, কোনো পার্থক্য নেই। এই ধরনের স্বৈরাচার মনোবৃত্তির ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে যত দূরে রাখা যায় তত ভালো। কথায় আছে দুষ্টু গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভালো।
৪) নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুলার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তার কাছে অনেক প্রত্যাশা। গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে তার দিকে। ব্রাজিলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইমাজনের রিসার্চার ব্রেন্ডা ব্রিতো বলেন, লুলার বিজয় আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। গত কয়েক বছরে যা কিছু ঘটেছে, তা খুব মর্মান্তিক। আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাজন ফরেস্ট সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝেন লুলা। কেননা এর আগে তিনি যখন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি তা করে প্রমাণ করেছেন। আমাজনকে রক্ষার দায়িত্বে সোচ্চার সংগঠন, আমাজন ওয়াচের প্রকল্প পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান পয়রিয়ের বলেন, ‘লুলা যা বলছেন এবং তার আগের যে রেকর্ড রয়েছে তাতে আশা করা যায় তিনি বলসোনারো সরকারের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের প্রভাব দূর করতে পারবেন’। এখন আমাদের দেখার পালা তার উপর যে আস্থা তার কতটুকু লুলা পূরণ করতে সক্ষম হবেন।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট