হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

ঋষি সুনাকের সামনে চ্যালেঞ্জ : পারবেন কি তিনি সামাল দিতে?

বৃটিশরা ভারতকে ২০০ বছর শাসন ও শোষণ করেছিল- এই ধরনের একটা কথার বেশ চল রয়েছে। ইংরেজরা ভারত শাসন করেছিল কথাটা সত্যি হলেও এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি নয় যে তারা ২০০ বছর শাসন করেছে। রবার্ট ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে পলাশী প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে বাংলার ‘শাসনকর্তা’ বনে গিয়েছিল। সেই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে আমরা মুক্ত হই ১৯৪৭ সালে। সেই হিসাবে মোট ১৯০ বছর। কিন্তু এই সংখ্যাও দাবি করা ঠিক হবে না। কেননা লর্ড ক্লাইভ ১৭৫৭ সালে কেবল বাংলাকে জয় করেছিলেন, যা ছিল গোটা ভারতের একটি রাজ্য মাত্র। মিসৌরী, মারাঠা এবং শিখ রাজ্য ইংরেজরা নিজ দখলে নিয়েছিল যথাক্রমে ১৭৯৯, ১৮১৮ এবং ১৮৪৯ সালে। আরো সঠিক করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, গোটা ভারতকে নিজ দখলে আনতে বৃটিশদের ১০০ বছর লেগেছিল এবং শাসন করেছে পরবর্তী ১০০ বছর। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে বৃটিশরা সর্বসাকূল্যে ৯০ বছর ভারত শাসন ও শোষণ করেছিল। তবে ইংরেজরা ক’বছর আমাদের শাসন করেছিল সেটি লেখার জন্যে আজকের এই লেখা নয়। আজকের লেখা সমপ্রতি বৃটিশ রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘নতুন ইতিহাস’ সৃষ্টি করা এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ রাজনীতিবিদ, ৪২ বছরের ঋষি সুনাককে নিয়ে, রাজনীতিতে যার প্রবেশ মাত্র সাত বছর আগে।

নানা কারণে এখন ঋষি সুনাক আলোচিত। কেবল বৃটেনে নয়, ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ সহ বিশ্বজুড়ে। তাকে নিয়ে উল্লাসের শেষ নেই ভারতে, বিশ্বজুড়ে ভারতীয়দের মধ্যে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে তাকে যুক্তরাজ্যে ভারতীয়দের ‘লিভিং ব্রিজ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। ঋষি সুনাক ভারতীয় বাবা-মার ঘরে জন্মসূত্রে বৃটিশ। তিনি অত্যধিক ধনী, এমন কী বর্তমান ইংরেজ রাজা চার্লসের চাইতেও বেশি অর্থবান। এমন এক ধনী ব্যক্তির পক্ষে বৃটেনের মত একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী কি হওয়া যায়? এমনতর প্রশ্নও উঠেছে বৃটেনের মূল ধারার রাজনীতিতে। তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে এক ‘অশেতাঙ্গ’ বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচ, নিজস্ব যোগ্যতা, কোরোনার দুঃসময়ে অর্থমন্ত্রী হিসাবে দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করার পরীক্ষিত-দক্ষতা, বারবার নেতৃত্ব বদলে সাধারণ জনগণের মাঝে টোরি দলের ইমেজ রক্ষায় আবারো দলীয় নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়া, নিজ দলের শাসনপ্রণেতাদের একটি বৃহৎ অংশের সমর্থন-আদায়, দলের মধ্যে বরিস জনসনের নেতৃত্বে অনাস্থা এবং সবশেষে সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ব্যর্থ ‘মিনি-বাজেট’ -সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে ঋষি সুনাককে আর কারো পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয়নি, ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের চাবি এলো ঋষি সুনাকের হাতে।

২) তবে বলা বাহুল্য, ঋষি সুনাকের আসন্ন দিনগুলি কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি হলেন বৃটেনের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হলেই যে পার পাওয়া যাবে তা বলা চলে না। সে আমরা সামপ্রতিক সময়ে দেখেছি সাধারণ জনগণের মাঝে অতি জনপ্রিয় বরিস জনসনকে, দেখেছি থেরেসা মে-কে, দেখেছি লিজ ট্রাসকে। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই তাদের একে একে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। ঋষি সুনাকের দল, কনজারভেটিভ পার্টি নানা শিবিরে বিভক্ত। তার প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে এই বিভক্ত দলকে এক করা। দলের এম পি-দের কারো কারো মতে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার ক্ষমতায় বসার কোন ‘ম্যান্ডেড’ নেই, কেননা তিনি দলের সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হননি। বিরোধী দলের দাবি, ঋষি সুনাক জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন, অতএব, তার উচিত নতুন করে জাতীয় নির্বাচন দেওয়া। দাবি এমনই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে অনেকেই আশংকা করেছিলেন, ঋষি সুনাককেও হয়তো লিজ ট্রাসের মত শুরুতেই শেষ করতে হবে, অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রিত্ব পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। তবে রাজা চার্লসের সাথে সাক্ষাৎ করে সরকার গঠনের অনুমতি পাবার পর ঋষি সুনাক ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে এসে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে তিনি বরিস জনসনের পদত্যাগের পর থেকে বর্তমান সময় তক টোরি পার্টি ও বৃটিশ রাজনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল তা অনেকটা প্রশমিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে রাজনীতি বোদ্ধাদের ধারণা। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া সেই ভাষণে তিনি যে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখিয়েছেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে অঙ্গীকার করেছেন তার ইতিবাচক প্রভাব উল্লেখ করার মত। ঋষি সেই ভাষণে তার পূর্বসূরি লিজ ট্রাসের প্রশংসা করলেও তিনি (লিজ) যে ভুল করেছেন সেটিও উল্লেখ করেন। রাজার সাথে সাক্ষাৎ শেষে তিনি তার স্ত্রী ও কন্যাদের উপস্থিতি ছাড়া ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে উপস্থিত হবার সিদ্ধান্তকে অনেকে সুনজরে দেখেছেন। তাদের মতে সব মিলিয়ে ঋষি সুনাক এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, যেন মনে হচ্ছিল ‘হি মিনস বিজনেস’ এবং তার উপর আস্থা রাখা যায়।

৩) ঋষি সুনাক বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন মন্ত্রী পরিষদ গঠনেও। প্রধানমন্ত্রী-লড়াইয়ে তাকে সমর্থন করেননি, তার বিরুদ্ধাচারণ করেছেন এমন কাউকে কাউকে তিনি তার মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন। এদের একজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পদে বেন ওয়ালেস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসাবে জেমস ক্লেভারলি। এই দুজন টোরি দলের নেতৃত্বের লড়াইয়ে তার বিপক্ষে গিয়ে বরিস জনসনের পক্ষে গিয়েছিলেন। এছাড়া এবারের লড়াইয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেনি মরডান্টকে তিনি হাউস অব কমন্সের নেতা হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন, যদিও বা পেনির দৃষ্টি ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদের দিকে। অন্যদিকে তার পূর্বসূরি লিজ ট্রাস কেবল সেই সমস্ত ব্যক্তিদের নিজ মন্ত্রী সভায় রেখেছিলেন যারা তার পক্ষে কাজ করেছিলেন। এই ব্যক্তির চিন্তা ও কর্ম ধারার এই যে পার্থক্য এতেই অনেকে মনে করেন, ঋষি সুনাক অনেক বিচক্ষণ এবং দলকে এক করতে সক্ষম হবেন। তবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন-উত্তর সেশনে বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনার তোপের মুখে পড়েন ঋষি সুনাক। সমালোচনার কারণ নিরাপত্তা ভঙ্গন করেছেন এমন অভিযোগে মাত্র এক সপ্তাহ আগে মন্ত্রিত্ব (স্বরাষ্ট্র) হারানো সুয়েলা ব্রেভারম্যানকে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, সুয়েলা ব্রেভারম্যান একজন হার্ড-লাইনার, যিনি কঠোর ইমিগ্রেশন আইনের পক্ষে। তিনি (সুয়েলা) বলেছিলেন, তার স্বপ্ন বৃটেনে এসাইলাম (আশ্রয়) চাইতে আসা শরণার্থীদের রুয়ান্ডায় ফেরত পাঠানো। দলের অভ্যন্তরের সমস্যা মেটানো ছাড়াও ইংল্যান্ডের ৫৭-তম প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে আরো যে কটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে তা হলো দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমানো, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করে সরকারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন, গ্যাস সমস্যা সমাধান ইত্যাদি। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম হলে ঋষি সুনাক যে তার প্রধান মন্ত্রিত্ব দু-বছর বাদে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ধরে রাখতে সক্ষম হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

৪) ঋষি সুনাককে নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার শেষ নেই। কেউ বলেন তিনি এশীয়, কেউ বলেন ভারতীয়। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি পাকিস্তানেরও। কারণ তার পিতামহ স্বাধীনতার আগে ভারতের গুজরানওয়ালা থেকে আফ্রিকায় (কেনিয়া) চলে যান। বর্তমানে গুজরানওয়ালা পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। ফলে কোন কোন পাকিস্তানি এই বলে দাবি করেন যে তিনি পাকিস্তানি, যদিও বা তা অবাস্তব। ঋষি সুনাক নিজেকে একজন ‘গর্বিত হিন্দু’ হিসাবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে তিনি তার ‘ইন্ডিয়ান রুটস’-এর কথা উল্লেখ করেন। তিনি গরুকে পূজা করা থেকে দিওয়ালী উৎসব পালন করেন নিয়মিত ভাবে এবং এমপি নির্বাচিত হবার পর তিনি হিন্দু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভগবৎ গীতায় হাত রেখে শপথ গ্রহণ করেন। বৃটিশ আদমশুমারি ফর্মে তিনি নিজেকে ‘বৃটিশ ইন্ডিয়ান’ হিসাবে উল্লেখ করেন। আগেই উল্লেখ করেছি নানা বিষয়ে ঋষি সুনাক ‘প্রথম’। তিনি বৃটেনের প্রথম অশেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী, তিনি বৃটেনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি ধর্মীয় বিশ্বাসে খৃস্টান নন, তিনি বৃটেনের আধুনিক ইতিহাসে সব চাইতে কম বয়েসী প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের এই পর্যন্ত সবচাইতে ধনী বাসিন্দা। ঋষি ও তার স্ত্রী অক্ষতা মূর্তির সম্পদের মূল্য ৮২৬ মিলিয়ন ডলার। এই প্রসঙ্গে ঋষির বক্তব্য : “আমাদের দেশে (বৃটেন) আমরা জনগণকে তাদের ব্যাংক একাউন্ট দিয়ে বিচার করি না, আমরা তাদের বিচার করি তাদের চরিত্র ও কর্ম দিয়ে। তবে হ্যাঁ, এটি ঠিক, আমি যে অবস্থানে আছি সেই অর্থে সৌভাগ্যবান, কিন্তু আমার জন্ম সেভাবে হয়নি। আমার বাবা-মাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে।” আমরাও চাই না তাকে তার অর্থের পরিমাণ দিয়ে পরিমাপ করতে। বৃটিশ জনগণ যাচাই করবেন যে লক্ষ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তা তিনি সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন কিনা। দেখা যাক তিনি কদ্দুর পারেন। এখন তো সবে শুরু।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধএম এ ওহাব : রাজনীতিতে সততা ও আদর্শনিষ্ঠার উজ্জ্বল উদাহরণ
পরবর্তী নিবন্ধসহিংসতা নয়, সহিষ্ণুতার রাজনীতিই কাম্য