অরুণ দাশগুপ্ত : সকল খেলায়
করব খেলা এই আমি – ১
“পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য-ভঙ্গ হয়। জীবন যেমন আসে জীবন তেমন যায়; মৃত্যুও যেমন আসে মৃত্যু তেমনি যায়। তাহাকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও; জীবন মৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ো না। হৃদয়ের দুই দ্বারই সমান খুলিয়া রাখো। প্রবেশের দ্বার দিয়া সকলে প্রবেশ করুক, প্রস্থানের দ্বার দিয়া সকলে প্রস্থান করিবে। সুখ এবং দুঃখ, শোক এবং উৎসব, জন্ম এবং মৃত্যু, পবিত্র সমীরণের মতো ইহার বাতায়নের মধ্যে দিয়া চিরদিন যাতায়াত করিতে থাকিবে।” রবীন্দ্রনাথ/রুদ্ধ গৃহ কথাটা ধ্রুব সত্য। তারপরও আমরা চেষ্টা করি ধরে রাখার, আপনজনকে ‘ছেড়ে’ দিতে চাইনে, যদি হয় সে চিরদিনের তরে ‘ছাড়া’। হৃদয়ের কেবল একটি দ্বার-আগমনী- খোলা রেখে ‘প্রস্থানের দ্বার’ রুদ্ধ করে রাখতে চাই। তারপরও যে যাবার, যার যখন যাবার-সময় আসে চলে যায়। তেমনি চলে গেলেন আমাদের কারো ‘দামনি’, কারো দাদামনি, কারোবা অরুণদা, যার পোশাকি নাম অরুণ দাশগুপ্ত। কতদিনের পরিচয় তার সাথে? সময়ের বিচার্যে কম করে হলেও প্রায় ৩৮ বছর। আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু থেকে। আশি সালের কথা। মাঝে মধ্যে যেতাম আন্দরকিল্লাহ দৈনিক আজাদী অফিসে। সুদর্শন, বিনয়ী, সুন্দর করে কথা বলা যা আর খুব কম জনই পারতেন- দেখে ভালো লাগতো, শ্রদ্ধা লাগতো। দেখে হাসিমুখে (পান-মুখে) ‘কেমন আছো ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। শুরুর দিকে তেমন কাছে যাওয়া হয়নি। বসে গল্প, আড্ডা দেয়া হয়নি। এমন না যে তিনি চাইতেন না, বা খুশি হতেন না। কিন্তু নিজ থেকেই নিজেকে একটু দূরে রাখতাম। এই কারণে তার সাথে কথা বলা, আড্ডা দেয়ার মত জ্ঞান তখন ছিল না। এখন যে আছে সে দাবি করিনে। অনেক পর যখন তার কাছাকাছি যাওয়া হলো, যখন তার সাথে আড্ডা দেয়ার সময় হলো, বয়সে ও অভিজ্ঞতার কারণে তখন আবিষ্কার করলাম এক নূতন মানুষকে। আপাদমস্তক ভালো মানুষটিকে। অল্পতেই কাছের হলেন, বয়সের দূরত্ব গেল ঘুঁচে। পথের দূরত্বে অনেক হলেও মনের দিক থেকে খুব কাছে ছিলেন বলেই কিনা জানিনে, তার প্রয়াণের দিন কয়েক আগ থেকে ভাবছিলাম খোঁজ নিয়ে তার সাথে কথা বলবো। ঠিক পরদিনই জানতে পেলাম তিনি ধলঘাটে, যেন জীবনের শেষ মুহূর্তের জন্যে যেন অপেক্ষা করছেন। ছবিতে দেখলাম গুটি কতক সাংবাদিক সেখানে তার পৈতৃক বাড়িতে গেছেন তাকে (অরুণদা) দেখতে। চমকে উঠলাম। প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে এলো, সারা জীবন শহরে থাকা, শহুরে-জীবনের সাথে সংসার করা এই অতি গুণী মানুষটিকে কেন এমন নির্বাসনে যেতে হলো জীবনের এই পর্যায়ে এসে, কেন এমন একটি স্থানে তাকে নির্বাসিত হতে হলো, যেখানে না আছে কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা, না আছে অন্য সুযোগ-সুবিধা, উন্নত চিকিৎসার কথা বাদই দিলাম। কেন? তার তো অর্থাভাব ছিল বলে জানা ছিল না। এমন না যে কোন নিভৃত-কোনে পড়ে ছিলেন অনেক-গুণের অধিকারী এই অশীতিপর জ্ঞানী, বিজ্ঞ সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী অরুণ দাশগুপ্ত। তার কাছের কি কেউ ছিল না? রক্তের সম্পর্কই কি সব? আমার জানা মতে তার পরিচয়ে পরিচিত হয়ে কেউ কেউ অনেক না হলেও কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন, তেমন কেউ তো ছিলেন। তার অনেক কাছের বন্ধু ছিলেন, যারা তার ‘ভালো-দিনে’ যখন তিনি শারীরিক ভাবে সক্ষম ছিলেন, যখন তিনি সাংবাদিকতার বাইরে বিভিন্ন আলোচনা সভা, অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন, অনুষ্ঠানগুলিকে আলোকিত করছিলেন, তখন এদের অনেককে দেখেছি তার কাছাকাছি থাকতে, তার আলোয় আলোকিত হতে। তারা কি কিছুই করতে পারতেন না এই আত্মপ্রচার-বিমুখী, নির্লোভ প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখককে শহরে ‘আটকে’ রাখতে, যাতে জীবনের শেষের দিনগুলিতে অন্ততঃ একটু চিকিৎসার মুখ দেখতে পেতেন? নাকি অরুণদা স্বেচ্ছায় ধলঘাটে নির্বাসনে গেছেন, নিজ বাড়িতে, যে বাড়ি বড্ড অবহেলায় পড়েছিল দীর্ঘ সময় ধরে? কোন অজানা অভিমানে? কার উপর এই অভিমান? জানি না। এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছি। বন্ধু লেখক ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্তকে লিখেছি। তিনি কিছু কিছু সংবাদ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। অরুণদা চলে গেলেন। আমার কেবল কেন জানি মনে হয় (হয়তো সে আমার ভাবনার ভুল) তিনি বড্ড অভিমানে নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে নিয়ে তার চিরদিনের চেনা শহর ছেড়ে, অনেকটা অচেনা অজ-পাড়াগায়ে চলে গেছেন। সবার থেকে নিজেকে আড়ালে রাখার জন্যে।
দেশে গেলে দৈনিক আজাদী অফিসে গিয়ে প্রথমেই যেতাম কাচ-ঘেরা তার অফিস কক্ষে। সামনের টেবিলে একগাদা লেখা, বই, ম্যাগাজিন, পত্রিকা। দেখেই বলে উঠতেন, ‘আরে কী সৌভাগ্য, কখন এলে ভাই, এসো এসো বসো’, বলেই পিয়নকে ডেকে চা-বিস্কুটের অর্ডার দিতেন। তারপর বলতেন, ‘আমার বোনটি কেমন আছে? তা, বাসায় কখন আসছো?’ কথা বলার মাঝেই বলে উঠতেন, যা যখনই দেখা হতো বলতেন, একবার নয়, বারবার, ‘ভাই, আমি তোমার কাছে চিরদিনের ঋণী। আমার জীবনের বড় সাধ ছিল ইউরোপ যাবো, প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়াম দেখবো। তুমি আমাকে সেটি দেখালে’। এরপর তার মুখে ল্যুভ মিউজিয়ামের বর্ণনা। বিব্রত হতাম, বলতাম, ‘অমন করে বলবেন না অরুণদা। আমার সুযোগ ছিল নেবার, সেটির সদ্ব্যবহার করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি’। উনি এসেছিলেন ব্রাসেলসসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে আয়োজিত এক বিশেষ সেশনে যোগ দিতে। সে-অনুষ্ঠান আয়োজনে ডাচ বন্ধু, ড. পিটার কাস্টার ও আমার ছিল মূল ভূমিকা। কথা ছিল দেশ থেকে একজন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আরো যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন এই অনুষ্ঠান আয়োজনে তারা বললেন, বাংলাদেশ থেকে যদি সাংবাদিক আনতেই হয় তাহলে ঢাকা থেকে আনা উত্তম। প্রতিবাদ জানাই এই যুক্তিতে, ঢাকার সাংবাদিকরা সব সময় দেশের বাইরে যাবার সুযোগ পান, কিন্তু চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা তেমনটি পান না। ঢাকার যে কয়েক সাংবাদিকের নাম তারা বলেছিলেন তারা দেশের দশজনের কাছে হয়তো পরিচিত, তবে জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায়, পড়াশুনায় অরুণদার ধারে কাছেও না সে বলা বাহুল্য। শেষতক আমার হলো জয়, অরুণদা এসেছিলেন এবং যে ক’দিন হল্যান্ড ছিলেন আমার হেগ শহরের বাসায় অবস্থান করেছিলেন।
তখন প্রচণ্ড শীত, বরফ পড়ছে, সাথে বৃষ্টি। সময়টা ফেব্রুয়ারি মাস, ২০১২ সাল। অরুণদার বয়স প্রায় ৭৫ পেরিয়েছে। এই বয়সে এতদূরের আকাশ-ভ্রমণ। একই অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন লেখক, মানবাধিকার নেতা শাহরিয়ার কবির, সদ্য প্রয়াত এডভোকেট জিয়াদ আল মালুম ও ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। অরুণদা আসবেন একা। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। শিফল এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি। তখন রাত প্রায় ৮টা। কিছুটা উদ্বিগ্ন এই কারণে অরুণদার বয়স হয়েছে, কখনো ইউরোপ ভ্রমণ করেননি, পারবেন তো ঠিকভাবে এসে পৌঁছাতে? তাকে জার্মানির হ্যামবুর্গ হয়ে আসতে হবে, সেখানে ট্রানজিট। এমন সময় দেখি অরুণদা, গায়ে শীত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বস্তাসম পোশাক, ট্রলি ঠেলে বেরিয়ে আসছেন ইমিগ্রেশন পেরিয়ে। সাথে এক ভদ্রলোক। কাছে গিয়ে দেখলাম এডভোকেট জিয়াদ আল মালুম। পরে জানলাম মালুম ভাইয়ের দেখা হামবুর্গ এয়ারপোর্টে, ট্রানজিটে। তাতে তার অনেকটা সুবিধা হয়েছে। রাত এগিয়ে চলেছে। পরদিন সকালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে অধিবেশন, যে কারণে তাদের আসা। কাছে এসে অরুণদা পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন। বাইরে গুড়ি গুড়ি বরফ, কখনো বা প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি। ওদের দুজনকে নিয়ে এগিয়ে যাই শিফল বিমান বন্দরের গাড়ি-পার্কিং জোনে। তারপর আমাদের গাড়িপথ চলা, বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসসের উদ্দেশ্যে। সেখানে অপেক্ষা করছেন দুপুরে ঢাকা থেকে আসা শাহরিয়ার কবির ভাই, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, হল্যান্ড থেকে পিটার কাস্টার্স ও সমাজকর্মী এম এম মনোয়ার। আবহাওয়া এমনই বৈরী ছিল যে কয়েক মিটার দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। ঘন্টা সোয়া দুয়েক প্রচন্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে যখন নির্দিষ্ট হোটেল পৌঁছি তখন রাত প্রায় দশ। সবাই অপেক্ষা করছেন আমাদের জন্যে। ডিনারের জন্যে ধারে-কাছে কোন রেস্তোরায় খেতে যেতে হবে। অরুণদা, মালুম ভাই চেক-ইন করলেন, আমিও। বয়সের ভারে ও দীর্ঘ আকাশ ভ্রমণের পর প্রায় সোয়া দুই ঘন্টা গাড়ি-পথ পেরিয়ে অরুণদা অনেকটা ক্লান্ত। তাকে বললাম, ‘আপনি হোটেলেই থাকুন, ফেরার পথে খাবার নিয়ে আসবো’। তিনি রাজি হলেন না। বললেন, আমিও যাব। তার ভারী ব্যাগটি নিয়ে তার কামরায় যাই। দেখা দেয় সমস্যা। তিনি ব্যাগের চাবি হারিয়ে ফেলেছেন। শেষে রিসেপশনে এসে হাতুড়ি ধরণের একটি যন্ত্র এনে তালা ভাঙার ব্যবস্থা হলো। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট












