মুক্তিযোদ্ধা ভাষাসৈনিক সাংবাদিক কামাল লোহানীকে যেভাবে দেখেছি : ২
আমার সৌভাগ্য হয় সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কামাল লোহানীর সাহচর্যে আসার। প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে অফিস যাবার পথে এবং অফিস শেষে ফিরে যাওয়া- এই পথটুকুতে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতো। তিনি সব সময় বসতেন গাড়ির সামনের আসনে, ড্রাইভার ওয়াজিউল্লাহর বা-পাশের সীটে। অফিসে তিনি বসতেন পিআইবি-র সে সময়কার তিন তলা ভবনের দোতলার একটি কামরায়। কাজের কারণে মাঝে মধ্যে তার কাছে যেতে হতো। একবার তাঁর কামরায় তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বরেণ্য সন্তান, ইংলিশ চ্যানেল প্রথম পাড়ি দেয়া বাংলাদেশের কৃতী সন্তান ব্রজেন দাসের সাথে। এশিয়ার মধ্যে ব্রজেন দাস ছিলেন প্রথম যিনি এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন। একবার নয় ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন ছয়-ছয়বার- ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সময়ের মধ্যে। ১৯৫৮ সালের মধ্যরাত্রি শুরু করে পরদিন দুপুরে এই দূরত্ব সাঁতরে অতিক্রম করেছিলেন তিনি। লোহানী ভাইয়ের কাছে বিভিন্ন সময়ে আসতেন দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি- কেউ পরামর্শের জন্যে, কেউ তার সমর্থনের জন্যে। তাদের কেউ সংস্কৃতি কর্মী, কেউ বাম-ধারার প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, নেতা। ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের সাথে আলাপ করতেন। অফিসের কাজের বাইরেও তিনি দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঘটনাবলীর সাথে ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে এর আগে ও পরের অনেক ঘটনার সাথে তিনি সরাসরিভাবে ছিলেন জড়িত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার ছিল গৌরবোজ্জ্বল অতীত। কিন্তু এ নিয়ে তিনি কোনদিন আমাদের সাথে ‘বড়-গলায়’ গল্প করেননি। অথচ অনেককে যুদ্ধে না গিয়েও মুক্তিযোদ্ধা দাবি করতে দেখেছি আমরা। কিন্তু এই বিশাল মনের মানুষটিকে কোনদিন দেখিনি তেমনটি দাবি করতে। কেবল কী রাজনীতি! বাংলাদেশের বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন কামাল লোহানী। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের মত তিনিও ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজনের কেবল একজন নন ছিলেন অন্যতম, যিনি মানুষের সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য, পূর্ব-পুরুষদের উত্তরাধিকারকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে আজীবন যুদ্ধ করে গেছেন। উনানব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছিলেন তাতে কামাল লোহানীও জড়িত ছিলেন। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অনিশ্চিত সময়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে কামাল লোহানী নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
কামাল লোহানীর সাংবাদিকতা জীবনের শুরু ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাতে যোগ দানের মধ্য দিয়ে। তার চাচাতো ভাই বিখ্যাত টিভি উপস্থাপক ও সাংবাদিক ফজলে লোহানী তাঁকে এই চাকরি পাইয়ে দেন বলে জানা যায়। বলা চলে বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন। দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকা বেতারের পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব নেন। ১৯৭৩ সালে দৈনিক জনপদে যোগ দেন। পরবর্তী বছর ‘বঙ্গবার্তা’, তারপর ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক বার্তা’-র নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে নিয়োগ দেয়ার পর পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে তাঁকে সম্পাদক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হলে দৈনিক বার্তা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। যোগ দেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটটে। বেশ কয়েক বছর পিআইবিতে কাজ করার পর কামাল লোহানীকে ১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। নীতির প্রশ্নে আপোষ করেননি তিনি কখনো। তাই দেখা যায় প্রায় দেড় বছর পর তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি শিল্পকলা একাডেমি থেকে পদত্যাগ করেন। পুনরায় ফিরে আসেন তার আগের স্থানে, অর্থাৎ পিআইবিতে। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্যে তিনি আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক পূর্বদেশ। সাংবাদিক ইউনিয়নেরও নেতৃত্ব দেন তিনি, ছিলেন সাংবাদিকতার গৌরবময় দিনের ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি (২০১২-২০১৬) এবং ছায়ানটের সম্পাদক ছিলেন এই বরেণ্য সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। ছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা, ছিলেন ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৬৭ সালে পল্টন ময়দানে গণসংগীত ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’-র মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করা হয় ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর। এতে নাটক ‘আলোর পথযাত্রী’ পরিচালনা ও অভিনয় করেছিলেন তিনি। কী বর্ণাঢ্য না ছিল তার জীবন, অথচ কী সাধারণ ছিলেন তিনি।
আগেই বলেছি কামাল লোহানী ছিলেন সাহসী সাংবাদিক ও মনে প্রাণে বাঙালি। অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশের জন্যে তিনি লড়েছেন সেই পাকিস্তান আমল থেকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তান সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করলে ‘ছায়ানটের’ নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কামাল লোহানীর মত নির্ভীক ও মুক্তবুদ্ধি-সম্পন্ন বুদ্ধিজীবীর দেখা আজকাল আর তেমনটা মেলেনা। দেখা মেলে সুবিধাভোগী ও আপোষকামী বুদ্ধিজীবীদের। দেখিনা তাদের সাহসী পদচারণা। সবাই যেন বালির মধ্যে মাথা গুঁজে আছেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-দাবিতে দেশব্যাপী গড়ে উঠা গণজাগরণে সাহসী এই যোদ্ধা, কামাল লোহানী সামনে থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আগেই বলেছি তিনি চেয়েছিলেন এক অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে তিনি যখন ‘উদীচীর’ সভাপতি, আয়োজন করেছিলেন ‘দক্ষিণ এশীয় সাম্রাজ্যবাদ ও সামপ্রদায়িক বিরোধী সাংস্কৃতিক কনভেনশন’। তাতে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, চীন ও জাপানের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ২০১৭ সালে যখন দেশের প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়া হয়, যখন অনেকে এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলি নিশ্চুপ ছিল, তখন প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিলেন কামাল লোহানী শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। নানা মানবিক গুণের এই ব্যক্তি সম্পর্কে জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট সুলতানা কামাল এক সময় বলেছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকে তাঁকে দুলাভাই হিসাবে চিনি। খুব কাছ থেকে দেখার কারণে পরে তার গুণ গুলি সম্পর্কে জেনেছি। সে জানা থেকে বলা যায়, মানুষ হতে হলে দুলা ভাইয়ের মতোই হতে হয়।’ বাস্তবিক তাই। তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট