হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

হাওড়া টু বোলপুর এবং ফেরা -এই পথ ধরেই রবির প্রথম ও শেষ রেল ভ্রমণ-২
সাঁওতাল মহিলাটির কাছে খেজুর রস থেকে বানানো গুড় যা আছে তাই গাড়িতে ভরে আমাদের শুরু হলো কলকাতা ফেরা। রবি ঠাকুরও কলকাতায় ফিরেছিলেন, গাড়িতে নয়, ট্রেনে চেপে, শেষ বারের মত। সেই ট্রেনটি এখন শান্তিনিকেতনের বোলপুর রেল স্টেশনের কাছাকাছি একটি মিউজিয়ামে রাখা আছে। দুর্ভাগ্য, সময়ের কারণে তা দেখা হয়ে উঠেনি। আসলে সময় নয়, সেটি জানা ছিল না। কেউ বলেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম রেল ভ্রমণও ছিল হাওড়া স্টেশন টু শান্তিনিকেতনের বোলপুর। কী কাকতালীয় ঘটনা। রবি ঠাকুর তার আশি বছরের জীবনে ৬৮ বছর রেলগাড়ি চড়েছেন। বোধকরি একবার প্লেনে চড়েছেন শেষ বয়সে। তখন সবে প্লেন আকাশে উড়তে শুরু করেছে। প্রথম রেলে চড়ার অভিজ্ঞতাও তার খুব মজার। তখনও তার বয়স বারো পৌঁছায়নি, সবে এগার বছর নয় মাস। তিনি যখন প্রথম রেল গাড়ি চড়েন, তার মাত্র বিশ বছর আগে কলকাতায় রেলগাড়ির পত্তন হয়েছিল। সেই আমলে রেলগাড়ি চড়াও ছিল বিরাট ব্যাপার, যা আজকের দিনে হাস্যকর ঠেকে আমাদের কাছে। তার বাবা যখন জানতে চাইলেন তার সাথে ভ্রমণে যাবেন কিনা তখন সানন্দে রাজি হন বালক রবি। রবির ভাগ্নে সত্যাপ্রসাদ, ইতিমধ্যে রেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি রবিকে বললেন, ”বিশেষ দক্ষতা না থাকিলে রেলগাড়িতে চড়া এক ভয়ংকর সংকট। পা ফসকাইয়া গেলেই আর রক্ষা নাই। তারপর গাড়ি যখন চলিতে আরম্ভ করে তখন শরীরের সমস্ত শক্তিকে আশ্রয় করিয়া খুব জোর করিয়া বসা চাই, নহিলে এমন ভয়ংকর ধাক্কা দেয় যে মানুষ কে কোথায় ছিটকাইয়া পড়ে তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না”। বালক রবি মনের মধ্যে রেলগাড়ি সম্পর্কে এক ধরনের ভীতিকর ধারণা নিয়ে বাবার সাথে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছলেন। বাঁশি বাজার সাথে সাথে গাড়ি ছাড়লো। এই ব্যাপারে তিনি লেখেন, ”যখন অত্যন্ত সহজে গাড়ি ছাড়িয়া দিল, তখন কোথাও বিপদের একটুও আভাস না পাইয়া মনটা বিমর্ষ হইয়া গেল”। এই রেল ভ্রমণ নিয়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা স্মরণীয় হয়ে আছে। বোলপুর থেকে বাবার সাথে গেলেন অমৃতসর। যেহেতু তখনও তার বয়স বারর নিচে বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তার জন্যে হাফ-টিকেট কিনলেন। তারা ভ্রমণ করছিলেন প্রথম শ্রেণীতে যা ইউরোপীয় সাহেব আর খুব ধনীদের মাঝে সীমিত থাকতো সে সময়। মাঝপথে টিকেট চেকার এলেন, হাফ টিকেট দেখে রবির দিকে তাকিয়ে তার সন্দেহ হলে তিনি নেমে পড়লেন। এলেন আর এক চেকার। বালক রবি বয়সের তুলনায় দেখতে বাড়ন্ত। দ্বিতীয় চেকারের দ্বিধা ছিল রবির বয়স নিয়ে। এলেন খোদ স্টেশন মাস্টার। তিনি বিশ্বাস করলেন না, বললেন, এই বালক বার বছরের ঊর্ধ্বে। মহর্ষি বিরক্তের সাথে বলেন, যদি তাই হতো তাহলে হাফ-টিকিট কাটব কেন? স্টেশন মাস্টারের বিশ্বাস হলো না। বললেন, এর পুরো ভাড়া দিতে হবে। অপমানে রেগে ক্ষিপ্ত হয়ে দেবেন্দ্রনাথ বাঙ থেকে একখানা নোট বের করে টিকিট চেকারের হাতে দিলেন। চেকার রশিদ দিয়ে বাকি টাকা ফেরত দিলে, মহর্ষি জানালা দিয়ে প্লাটফর্মে ছুঁড়ে মারলেন। স্টেশন মাস্টার তার ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে কামরা থেকে নেমে গেলেন। প্লাটফর্ম জুড়ে ছুঁড়ে খুচরো টাকাগুলি তখনও বাতাসে উড়ছিল।
শেষ করবো রবি ঠাকুরের শেষ রেলভ্রমণের কথা দিয়ে। কবি গুরুতর অসুস্থ। শান্তিনিকেতন থেকে তাকে কলকাতা নিয়ে যেতে হবে। সেখানে তার অপারেশনের সব ব্যবস্থা তৈরি। কিন্তু গাড়িপথে বা সাধারণ রেলে যাবার মত শারীরিক অবস্থা তখন তার নেই। সে জন্যে বোলপুর রেল স্টেশনে কবির জন্যে আনা হলো বিশেষ ট্রেন, ‘সেলুনকার’। কবিকে সকালে তাতে তোলার পর সেটিকে যাত্রী-গাড়ির সাথে লাগলো হয়। সেদিন ছিল ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই। এর আগে ড. বিধান চন্দ্র রায় এবং আরো জনা কয়েক চিকিৎসক শান্তিনিকেতনে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যান। কবি কোনভাবেই এই অপারেশনের জন্যে সম্মত ছিলেন না। তিনি হয়তো টের পেয়েছিলেন তার প্রাণের আশ্রম, শান্তিনিকেতনে তিনি আর ফিরে আসতে পারবেন না, এই হবে তার শেষ যাত্রা। কবির শেষ যাত্রা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের এক সময়কার ছাত্রী, যার বর্তমান বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি, শ্রীমতি সুদর্শনা বাজপেয়ী কলকাতার দূরদর্শনকে বলেন,”সেদিন ছিল শ্রাবণের দিন। বৃষ্টি পড়ছে, যেন গুরুদেবকে শেষ বিদায় দিতে প্রকৃতিও কাঁদছে আমাদের মত, আমরা যেমন আশ্রমের সমস্ত বাসিন্দা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই কাঁদছিলাম। গুরুদেবের মাথায় কালো টুপি। তখন তিনি কোন কথা বলতে পারেননি, শারীরিক এতই অসুস্থ ছিলেন। আমরা যেন ভগবানকে দেখছি, সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছি করজোড় করে আর প্রার্থনা করছি। যে বাসে তিনি জানালার ধারে বসেছিলেন এক সময় চলে গেল। গুরুদেব একবার ফিরে তাকালেন, যেন তিনি টের পেয়েছিলেন এই তার শেষ যাত্রা”। খুব ছোট বয়সে সুদর্শনা তার ছোট ভাই সহ আশ্রমে আসেন। সুদর্শনা জানান, তার মাও শান্তিনিকেতনে ছিলেন। মায়ের ইচ্ছেতেই তাদের আসা। ”প্রথম প্রথম কান্না পেতো। সবকিছু নিজেকেই করতে হতো। কিন্তু অল্পদিনেই ভালো লাগতে শুরু করে। মনে মনে অপেক্ষায় থাকি কী করে ওর অর্থাৎ গুরুদেবের কাছে যাবো। একবার ডাক পড়লো। গুরুদেব জানতে পারলেন একটি অবাঙালি মেয়ে আশ্রমে এসেছে, গানও গাইতে পারে। আমি ভয়ে অস্থির। গান গাইতে বললে আমি গুরুদেবকে বললাম, ‘তোমার গান তো আমি শিখিনি, কী করে গাইবো’। এই বলে চমৎকার বাঙালি-ধাঁচে শাড়ি পরা এই বৃদ্ধা বললেন, ”তখন আমরা তাকে (গুরুদেবকে) ‘তুমি’ বলে ডাকতাম। হেসে গুরুদেব বললেন, ‘ঠিক আছে তুমি তোমার মতো করে গাও, দেখি কেমন লাগে’। তিনি গাইলেন। সুদর্শনাকে কবি ডাকতেন রানী সুদর্শনা বলে। শিখ পরিবারে তার জন্ম, বাবা করতেন ব্যবসা, সেই সূত্রে থাকতেন কলকাতা। এদিকে এর পরে গুরুদেবের কাছে কী করে যাবেন এই নিয়ে সুদর্শনা ভাবতে থাকেন। তিনি শুনেছিলেন, গুরুদেব ফুল খুব পছন্দ করেন। বর্ষার দিনে প্রথম ফোটা কদম ফুল নিয়ে তিনি উপস্থিত হলে কবির ঘরে। তখন কবি অসুস্থ। কিন্তু দরজায় যিনি পাহারায় তিনি তাকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর একটু হেসে মহিলা বললেন, ‘আমিও দমবার পাত্র নই। এক ফাঁকে চুপিসারে পেছন দিক দিয়ে গুরুদেব যে ঘরে শুয়ে আছেন তার জানালা টপকিয়ে তার কামরায় ঢুকে পড়ি। গুরুদেব তখন চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন। ‘টুক’ করে লাফ দিয়ে পড়ার শব্দে তিনি চোখ খুলে দেখলেন। জানতে চাইলেন, এইভাবে কেন এলাম। তার হাতে কদম ফুলটি দিয়ে বলি, আমাকে যে ঢুকতে দিলোনা, তাই। শুনে গুরুদেব বললেন, ‘ওরা আমায় বুঝলোনা, কে আসলে যে আমি খুশি হই তা ওরা জানলো না’। এমনই ছিলেন গুরুদেব। সবাইকে আপনার করে নিয়েছিলেন তিনি। আমার পরম সৌভাগ্য তার কিছুটা সান্নিধ্য পেয়েছি। মা, বাবা চলে গেলে যেমন লাগে, গুরুদেব যখন চলে গেলেন, চিরদিনের জন্যে তখন ঠিক তেমনটি লেগেছিল, এখনো লাগে”, বলে হেঁটে এগিয়ে চলেন বাংলাকে ভালোবেসে পুরোপুরি বাঙালি বনে যাওয়া এই বৃদ্ধা। বিয়েও করেছেন তার চাইতেও বয়সেও অনেক বড় শান্তিনিকেতনের এক শিক্ষককে। বিয়ের ব্যাপারে বলেন, ভালোবাসার চাইতেও তার (স্বামী) প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকে বিয়ে।
বোলপুর রেল স্টেশন। কবি আঁধশোয়া অবস্থায় আছেন সেলুনকারের জানালার ধারে। তাঁর সাথে মেয়ে মীরা দেবী, নাতনি নন্দিতা ও নির্মলকুমারী। ভাবি জীবন কী ! কবিগুরু তার জীবনের প্রথম রেলগাড়ি চড়ে বাবার সাথে কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে বোলপুর গেলেন, আর সেই একই পথ ধরে হলো তার জীবনের শেষ রেল ভ্রমণ। এই রেল ভ্রমণের সময় একবার তিনি লিখেছিলেন, ”রেলগাড়ির মত আমাদের প্রত্যেকের জীবন ছুটে চলেছে, কিন্তু তার মধ্যে থেকে যেটুকু পাচ্ছি সে ক্ষণকালীন নয়, সে চিরকালীন”।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামলেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিযায়ী পাখির বিচরণ ক্ষেত্র
পরবর্তী নিবন্ধপতেঙ্গা সৈকতে পর্যটকদের মাঝে সিএমপির মাস্ক বিতরণ