হাওড়া টু বোলপুর এবং ফেরা- এই পথ ধরেই কবিগুরুর প্রথম ও শেষ রেল ভ্রমণ
মাঝখানে বড্ড অনিয়ম হয়ে গেছে। কিছুদিনের জন্যে ‘ডিরেইল্ড’ অর্থাৎ লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিলাম। লিখছিলাম ধারাবাহিকভাবে আমার ক্ষণিক দেখার ‘শান্তিনিকেতন’ নিয়ে। লিখছিলাম এই আশ্রমকে ঘিরে রবি ঠাকুরের নানা স্মৃতিঘেরা মুহূর্ত, ঘটনা, এমন সময় এলো যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, একে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা, ট্রাম্পের নাটক। নির্বাচনকে ঘিরে কখনও যা ঘটেনি তেমন ঘটনাও একটির পর একটি ঘটতে থাকে আমেরিকায়, গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে। ফলে লেখার বিষয় গেল বদলে। নির্বাচনকে ঘিরে আমার এতগুলো লেখা হতোনা যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পরাজয়কে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে মেনে নিতেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতেন। ‘গাধা ঘোলা করে জল খায়’ বলে একটি প্রবাদ আছে। অবশেষে তাকে (ট্রাম্প) তো নমনীয় হতেই হলো। না করে যাবে কোথায়! এটি তো তার ‘ট্রাম্প সাম্রাজ্য’ নয়, যদিও বা গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে তিনি নিজের সাম্রাজ্য হিসাবে চালিয়েছেন। যখন যা খুশি, যা ইচ্ছে তাই করেছেন, বলেছেন সামান্যতম সভ্যতা, ভব্যতার কেয়ার না করে। এই একটি ব্যক্তি কেবল আমেরিকাকে নয় গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বকে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এই ব্যক্তি আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে সব চাইতে বিতর্কিত ও ঘৃণিত, যার দেশের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি, জনগণের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহানুভূতি নেই। যিনি নারীকে ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না, যিনি নারীকে প্রকাশ্যে অশ্রদ্ধা জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। এই সমস্ত কারণে তার প্রতি অনেকের মত আমারও প্রচণ্ড ঘৃণা, আর সেটি প্রকাশ্যে জানান দিতে আমার কোন দ্বিধা নেই। এমন ব্যক্তির প্রতি এমন মনোভাব থাকবে- সেটি কোন অবাক-করা ব্যাপার নয়। যেটি অবাক-করা তা হলো, তাকে প্রচণ্ডভাবে, অন্ধভাবে ভালোবাসেন, তার কথায়, তার নীতিতে বিশ্বাস করেন তেমন মানুষের সংখ্যাও যুক্তরাষ্ট্রে কম নয়। তার জন্যে এমনকী অনেকে জান কোরবান করতেও প্রস্তুত। তাকে যে অনেকে অন্ধভাবে ভালোবাসেন তার প্রমাণ আমরা পাই এবারের ভোটের ফলাফলে। প্রায় সাড়ে ছ’কোটির বেশি ভোটার তাকে ভোট দিয়েছেন যা গোটা আমেরিকার মোট-দেয়া ভোটের প্রায় অর্ধেক। আমেরিকা তো তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ নয়, আফ্রিকার কোন অঞ্চল নয়। আমেরিকার জনগণের কাছে আরো উন্নত কিছু আশা করে বিশ্ব। গোটা বিশ্ব তাকিয়েছিল, এখনো আছে আমেরিকার দিকে। এই কারণে শান্ত, ছায়াঘেরা শান্তির নীড় শান্তিনিকেতন থেকে আমার দৃষ্টিও সেদিকে ধাবিত হয়। ফিরে আসি বাঙালির প্রাণের আশ্রয়স্থল, শান্তিনিকেতনে।
যেদিন কলকাতা ফিরবো সেদিন গিয়েছিলাম সেই ‘হাঁটু-জল’ থাকা নদীর ধারে। সেই কবে ছোটবেলায় পড়া, মুখস্থ করা কবিতা- “আমাদের ছোট নদী/ চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার/ হাঁটুজল থাকে। পার হয়ে যায় গরু, /পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার,/ ঢালু তার পাড়ি। চিকচিক করে বালি/ কোথা নাই কাদা,/ একধারে কাঁশবন/ ফুলে ফুলে সাদা”। কবিতাটি এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে। যে নদীকে নিয়ে এই কবিতা সেই খোয়াই নদী না দেখে ফিরি কী করে। রবি ঠাকুর প্রায়শ বৈকালিক ভ্রমণে হেঁটে এগিয়ে যেতেন সেদিকে। এক সময় ছিল স্রোতস্বিনী খোয়াই নদী। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হলো। এখন আর আগের সে স্রোত নেই। গরু, গরুগাড়িকে হাঁটুজল পেরিয়ে নদী পার হতে হয় না। এই নদী এঁকেবেঁকে সামনে কোথায় গেছে জানা নেই আমার। চোখে পড়ে কোথায়ও কোথায়ও নদীর উপর দাঁড়িয়ে আছে ছোট সাইজের পাকা সাঁকো। রবি ঠাকুরের সময় তা নিশ্চয় ছিল না। সাঁকোর পিলারগুলোর গায়ে মমতার রং, সাদা-নীল, পশ্চিম বংগের মুখ্যমন্ত্রী, শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর পরনের শাড়ির রঙে রং। তার শাড়ির গায়ের রঙ সাদা, পাড় নীল। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতন আসার পথে যে ক’টা ব্রিজ পেয়েছি, এমন কী সড়কের দু’ধারে যে ক’টি সরকারি ভবন চোখে পড়েছে, তার গায়েও চাপানো হয়েছে এই ‘মমতা রঙ’। বিষয়টা আমার মোটেই ভালো লাগেনি। এ যেন অনেকটা জোর করে চাপিয়ে দেয়া। যাই হোক, ফেরার দিন সকালে বেরিয়ে পড়ি খোয়াই নদীর উদ্দেশ্য। আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, সঙ্গীনি সুমনার খেজুর গাছ অতি কাছ থেকে দেখার শখ। যদিও বা তাতে লেখকের ইচ্ছের তীব্রতা ছিল না। তার অনেক শখ, মেটানোর সামর্থ্য নেই বিধায়, অপূরণ থেকে গেছে, ভাবলাম বিনে পয়সায় যদি আর একটা শখ মেটানো যায় মন্দ কী। আঁকাবাঁকা কংক্রিটের রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। শীত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তারপরও দূর থেকে চোখে পড়ে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ। চালক বাঙালি, নাম বাচ্চু। তার আগ্রহ দেখে মনে হলো আমার চাইতে সুমনার ইচ্ছে পূরণ করার তাগিদ তার বেশি। বেশি দূর যেতে হলোনা। একটা জায়গায় এসে বাচ্চু রাস্তার ধারেই গাড়ি দাঁড় করালো। গাড়ি থামতেই আমরা হেঁটে ধানি জমির আইল ধরে এগিয়ে যাই। বড় একটু পুকুর, তার দুই ধারে অনেকগুলো খেজুর গাছ, তাতে মাটির হাঁড়ি টাঙানো। কোন কোন গাছ এত নিচু যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। দেখে খুব ভালো লাগলো। এতক্ষণ যে ইচ্ছেটা ছিল না, তা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। চাটগাঁ শহরে বাবা ও পরে দাদার সরকারি যে বাসায় বড় হয়েছি, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বছর কয়েক থেকেছি, সেই বাড়ির সামনে নিজস্ব বড় মাঠে ছিল একটি খেজুর গাছ। শীতের বিকেলে ‘গাছি’ এসে কোমড়ে দড়ি বেঁধে তরতর করে গাছের মাথায় উঠে ধারালো ছুরি দিয়ে কয়েক প্রস্থ ছাল কেটে সেখানে বসিয়ে দিত কোমরের একপাশে বাঁধা মাটির হাঁড়ি। আমাদের সেই গাছটি ছিল বেশ পয়মন্ত। সন্ধ্যে নাগাদ হাঁড়ি বসালে রাত দশটা/ এগারটার মধ্যে কলসি ভরে যেত। আমরা বেশ ক’ভাই থাকলেও কেউ গাছ বাইতে অর্থাৎ গাছে উঠতে পারতাম না। সে সময় আমাদের বাসায় থাকতো ভিন্ন গ্রামের এক ছেলে। বাবা তাকে দিয়েছিলেন আমাদের বাসায় আশ্রয়। এক পর্যায়ে তাকে অফিসে (রেলওয়ে) পিয়নের চাকরি দেন। সেই থেকে সে আমাদের বাসায়। মাকে সন্ধের সময় রান্নাঘরে সাহায্য করতো। মাঝে মধ্যে বাজারে যেত। আমাদের ছিল ভূষির চুলা। ইলেকট্রিক চুলার পাশাপাশি ভূষির চুলা। সে কখনো রিকশা করে, কখনো ঠেলা-গাড়ি করে ভূষির বস্তা নিয়ে আসতো। গ্রামের ছেলে, গাছ বাইতে জানে। সে তরতর করে রাত দশটা/ এগারটার দিকে খেজুর গাছে উঠে কলসি নামিয়ে তা অন্য পাত্রে ঢেলে আবার বসিয়ে দিত। পরদিন ভোরে কলসি রসে ভরে যেত। শান্তিনিকেতন এসে, খোয়াই নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ দেখে, ফেলে আসা সেই কয়েক যুগ আগের কথা মনে পড়লো। কেমন যেন ‘নস্টালজিক’ হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাই। যে দিকে দৃষ্টি মেলে দেই চোখে পড়ে খেজুর গাছ। ড্রাইভার বাচ্চু বলে, সামনেই খাঁটি খেজুর গুড় পাবেন। সুমনার উৎসাহ বাড়ে। দেখি সামান্য দূরে গাড়ি-রাস্তার ধারেই চুলা জ্বালিয়ে খেজুর গুড় তৈরি করছে শীর্ণকায় এক সাঁওতাল মহিলা, পাশে দাঁড়ানো সাত/ আট বছরের একটি ছেলে। সেখানেই রাস্তার ধারে টঙের মত একটি বাঁশের ছাউনি দেয়া ছোট্ট ঘর। (চলবে)
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক