হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৫ জুন, ২০২১ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব রাজনীতিতে ‘বিগ ব্রাদারদের’ ভূমিকা
একটা সময় ছিল যখন কেউ কোন (অন্যায়) কাজ করলে রেখে-ঢেকে করতো। কিন্তু ইদানীং আমাদের দেশে, আশপাশ, এমন কী গোটা বিশ্বে যা অনেকটা অহরহ ঘটে চলেছে তাতে মনে হয় না ‘রাখ-ঢাক’ বলে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে। এখন যার যা খুশি তাই করে, কোন কিছুর পরোয়া না করে। সে ব্যক্তি-পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়-পর্যায়ে। সপ্তাহ দুয়েক আগে অনেকটা ফিল্মি কায়দায় ফাইটার জেট পাঠিয়ে ‘রায়ান এয়ার’ এর একটি যাত্রীবাহী প্লেনকে শূন্যে তার গতিপথ ঘুরিয়ে বেলেরুশের রাজধানী মিঙ্কসে নামতে বাধ্য করার ঘটনা দেখে এই সমস্ত কথা মনে এলো। এ যেন খোদ ‘সরকারি-উদ্যোগে’ সন্ত্রাস, যাত্রীবাহী প্লেন ‘হাইজ্যাক’ এবং তা দিনের বেলায়, গোটা পৃথিবীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। কর্মটি সঠিক হচ্ছে কিনা, বিশ্বে এর কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে তার কোন তোয়াক্কা না করে স্বৈরাচার বেলারুশ সরকার সেটিই করলো। সরকার যুক্তি দেখালো প্লেনে বোমা রয়েছে সুইজারল্যান্ড থেকে তেমন তথ্য তাদের কাছে এসেছে বিধায় যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই প্লেনটিকে তারা ‘ডাইভার্ট’ করে তাদের দেশে নামিয়েছে। যদি তাই হতো তাহলে জেট ফাইটার পাঠিয়ে গতিপথ পরিবর্তনের কী প্রয়োজন ছিল। মোদ্দা কথা, বেলেরুশের প্রয়োজন ছিল যেভাবেই হোক প্লেনটিকে তাদের দেশের মাটিতে নামানো। তাদের টার্গেট প্লেনের এক যাত্রী। তাকে ধরা চাই। সেটি জানা গেল যখন প্লেনটিকে ল্যান্ড করানো হলো বেলেরুশের রাজধানী মিনস্কের বিমানবন্দরে। শুরুতে ডগ স্কোয়াড দিয়ে কিছু লোক-দেখানো যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি করার পর সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল একজনকে গ্রেপ্তার করা হলো। পেশায় তিনি সাংবাদিক, নাম রামন প্রাতাসেভিক, বয়স ২৬। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বেলেরুশে গেল বছর যে সরকার-বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলনের মুখে যখন ক্ষমতাসীন সরকারের গদী যায়-যায় দশা, সেই আন্দোলনের তিনি ছিলেন মূল ‘উস্কানিদাতা’। গ্রেপ্তার করা হয় তার বান্ধবীকেও। তিনিও ছিলেন একই প্লেনের যাত্রী। রামনকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তিনি তার ল্যাপটপ ও হ্যান্ডব্যাগ তার বান্ধবীকে দিয়ে দেন এই ভেবে তাকে (বান্ধবী) গ্রেপ্তার করা হবে না। পুলিশ বান্ধবীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জিনিষগুলিও জব্দ করে। পরে প্লেনের এক যাত্রী আফসোস করে বলেন, রামন যদি তার ল্যাপটপ ও হাত ব্যাগ আমাকে বা অন্য কোন যাত্রীকে দিয়ে দিতেন তাহলে অন্তত তার গোপন তথ্যগুলি রক্ষা পেত।
উল্লেখ্য, গেল বছর নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে বেলেরুশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আলেঙজান্ডার লুকাসেঙ্কো নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করলে সে দেশে গণআন্দোলন গড়ে উঠে। সেই গণ অভ্যুত্থান তিনি তার পেটোয়া পুলিশ ও সেনাবাহিনী দিয়ে দমন করেন। শতশত বিরোধী দলের নেতা ও আন্দোলনে যোগ দেয়া জনগণকে জেলে ভরেন। কেবল তাই নয়, তাদের শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ শোনা যায়। পূর্ব ইউরোপের ২০৭.৭০০ বর্গ কিলোমিটারের দেশ বেলেরুশের প্রেসিডেন্ট আলেঙজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে বলা হয় ইউরোপের ‘শেষ স্বৈরাচার’। বিগত ২৭ বছর ধরে তিনি এই দেশটিকে কঠোর হস্তে শাসন ও শোষণ করছেন। বেলেরুশের একদিকে রাশিয়া, অন্যদিকে ইউক্রেন, পোল্যান্ড, লিথুনিয়া ও লাতভিয়া। গেল নির্বাচনে কারচুপি করে নিজেকে জয়ী ঘোষণা দিলে গোটা দেশ গর্জে উঠে তীব্র প্রতিবাদে। প্রেসিডেন্ট লুকাসেঙ্কোর বিরুদ্ধে জেগে উঠা সেই গণআন্দোলনে বড় ভূমিকা রাখেন এই তরুণ ও সাহসী সাংবাদিক, তার সম্পাদিত অন-লাইন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে।
এদিকে সাংবাদিক রামন প্রাটসেভিককে এইভাবে সমস্ত নিয়মনীতি বহির্ভূতভাবে গ্রেপ্তার করায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলি এবং যুক্তরাষ্ট্র তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জারি করে কড়া ‘নিষেধাজ্ঞা’। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোন প্লেন বেলেরুশের আকাশ হয়ে উড়বে না। এছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সাধারণত কোন দেশের বিরুদ্ধে যখন এই ধরনের ‘সিরিয়াস’ কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন ইউনিয়ন-সদস্যভুক্ত দেশগুলি দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা ও শলা-পরামর্শ করে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঘটনার পরপর জরুরি মিটিং তলব করে মাত্র দুই ঘণ্টার মিটিংয়ে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ বলেন, যে প্রক্রিয়ায় একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। অন্যদিকে ঘটনার তিনদিন পর মুখ খুলে প্রেসিডেন্ট লুকাসেঙ্কো বলেন, ‘এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যে যে ওই প্লেনটি জোর করে নামানো হয়েছে। প্লেনে বোমা রয়েছে সুইস কর্তৃপক্ষ থেকে এমন তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছানোর পর আমরা যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্লেনটিকে আমাদের ভূমিতে নামিয়েছি’। কিন্তু সুইস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সিবিএসকে বলে, ‘প্লেনে বোমা রয়েছে এমন কোন তথ্য তাদের জানা ছিল না, অতএব, সুইস কর্তৃপক্ষের থেকে বেলেরুশকে কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি’। বেকায়দায় পরে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো উল্টো অভিযোগ করে বলেন, পশ্চিম বিশ্ব ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করে বেলেরুশকে শাস্তি দিতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জারিকৃত ‘নিষেধাজ্ঞার’ প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে লুকাসেঙ্কোর প্রয়োজন শক্তিশালী মিত্রের সমর্থন। ঘটনার দিন কয়েক বাদে উড়ে গেলেন প্রতিবেশি ‘বিগ ব্রাদার’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে। পুতিন তাকে নিরাশ করলেন না। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাকেও পুতিনের প্রয়োজন। কেননা বেলেরুশের প্রতিবেশী দেশগুলি বড্ড পশ্চিমমুখী। বেলেরুশকে কিছুতেই সে-মুখো হতে দেয়া যাবে না। ফলে যা হবার তাই হবে। লুকাসেঙ্কো তার গদিতে বহাল তবিয়তে থাকবেন যতদিন তিনি পুতিনের কথা মত চলবেন।
বিশ্ব রাজনীতিতে যে ‘খেল’ চলছে তাতে আমরা কী দেখতে পাই? দেখতে পাই, ‘ব্যাড গাইস’ (মন্দ লোক) যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতায় থেকে নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে অত্যাচার, অনাচার করে চলেছেন, গণতন্ত্রের ‘বারোটা’ বাজাচ্ছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছেন, দেখা যায় তাদের পেছনের শক্তি হলো হাতে গোনা জনা কয়েক অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও দেশ। এই যেমন, লুকাসেঙ্কোর অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি। তাকে ‘ঠাণ্ডা’ করা সম্ভব হতো মুহূর্তেই, যদি ‘বিগ-ব্রাদার’ পুতিন তার পেছনে এসে না দাঁড়াতেন। পুতিন নিজেও নিজ দেশে তার মতের বিরুদ্ধে যারা যাবার সাহস দেখিয়েছেন, তাদের দেখেছি হয় ‘গুম’ করে দিতে, কিংবা জেলে ভরতে, কোন নিয়মের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে। পুতিনের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা আলেঙি নাভানলিকে তো আমরা দেখেছি বিমানবন্দরে কফির সাথে বিষ জাতীয় কিছু খাইয়ে ‘ফিনিশ’ করে দিতে। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও এখন তাকে রাশিয়ায় জেলের ভেতর দিন কাটাতে হচ্ছে। সৌদি আরবের ‘ব্যাড বয়’ যিনি এম বি এস নামে সবিশেষ পরিচিত অর্থাৎ সৌদি প্রিন্স। তাকে দেখা গেল সৌদি-আমেরিকান সাংবাদিক কাসোগিকে কীভাবে তুরুস্কে বিশেষ প্লেন পাঠিয়ে নিজের লোকজন দিয়ে কেবল হত্যা নয়, নিশ্চিহ্ন করে দিতে। সৌদি প্রিন্স সালমাল যখন বেকায়দায় তখন আর এক বিগ-ব্রাদার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প তাকে ‘শেল্টার’ দিলেন। বললেন, ‘কুছ পরোয়া নেই, আমি আছি’। ইসরায়েল ও এই দেশটির প্রধানমন্ত্রীরা। প্যালেস্টাইনে যুগের পর যুগ ধরে চলছে হত্যা, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশ্ব প্রতিবাদ-মুখর হলেও ইসরায়েল এই ব্যাপারে নির্বিকার এবং দেশটি প্রতিবাদ ও নিন্দাকে থোড়াই ‘কেয়ার’ করছে না। কেননা তার পেছনে শক্ত হাতে আছে ‘বিগ ব্রাদার আমেরিকা’। তাই আমরা জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আনা নিন্দা-প্রস্তাবে ‘ভীটো’ দিতে দেখি আমেরিকাকে। মিয়ানমারে চলছে নির্বিকারে গণহত্যা। করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। মারছে নিজ দেশের জনগণকে। অপরাধ ওরা সেনাবাহিনীর অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল। বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী থোড়াই কেয়ার করে! তাদের পেছনে রয়েছে আর এক ‘বিগ ব্রাদার’, চীন। এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে। এই সমস্ত হাতে-গোনা কয়েকটি অতি ক্ষমতাধর ‘বিগ-ব্রাদারদের’ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষমতায় থাকা ‘দুষ্ট শক্তিগুলিকে’ কিছুতেই দমন করা যাচ্ছে না। ফলে গণতন্ত্রকামী জনগণ অত্যাচার আর অনাচারের মুখোমুখি হচ্ছে, গণতন্ত্র আর মানবাধিকার হচ্ছে ভূলুন্ঠিত।
দেশে দেশেও এই ধরনের ‘বিগ ব্রাদারদের’ দেখা মেলে। এরা সব দেশে কমবেশি সক্রিয়, ক্ষমতাবান। বাংলাদেশে এরা ‘বড় ভাই’। এই বড় ভাইদের ক্ষমতার কারণে স্থানীয় পর্যায়েও মাস্তানদের দৌরাত্ম্য আমরা দেখতে পাই। স্থানীয় পুলিশ, প্রশাসন তাদের সমীহ করে চলে, কেননা তাদের ‘হাত’ অনেক বড়। বড় ভাইদের ক্ষমতায় এরা ক্ষমতাবান। যে ভাই যতবেশি ক্ষমতাবান এরা ততবেশি প্রভাব রাখে এলাকায়। এলাকায় সাধারণ নাগরিক এদের কাছে জিম্মি। এদের দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করার সাহস খুব কম জনেরই দেখা মেলে। এই ‘বিগ ব্রাদার’ গেম বা ‘বড় ভাই’ খেলা যতদিন না থামবে ‘ওয়ানস ফর অল’, ততদিন খাসোগির মত সাংবাদিকরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, আরো অনেক লুকাসেঙ্কোর জন্ম হবে, ফিলিস্তানীরা গৃহহারা হবে। আর গোটা বিশ্বের অসহায়ের মত অবাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু থাকবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাপ্তাই লেক ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধদেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তুলতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা রয়েছে