হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

মার্কিন ক্ষমতায় জো বাইডেনের ১০০ দিন : সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
যে পদক্ষেপ বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প নিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, ক্ষমতায় এসে ১০০ দিনের মাথায় সেই পদক্ষেপ নেবার ঘোষণা দিলেন ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। গত সপ্তাহে তিনি ঘোষণা দিলেন নাইন-ইলেভেন অর্থাৎ চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তান থেকে সমস্ত আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চার বছর আগে এই মর্মে নির্বাচনী-ওয়াদা দিয়েছিলেন যে আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের সমাপ্তি টানবেন ক্ষমতায় এসে, কিন্তু সেটি তিনি করেননি। তার অসমাপ্ত কর্মটি করতে চলেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আফগানিস্তানের মত অনিরাপদ এলাকা থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনা যে একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। মার্কিন সেনাবাহিনী ওই এলাকায় যাবার আগে তালেবানরা ধর্মের নামে কী নির্মম, অমানবিক সন্ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, গণতন্ত্রকে হত্যা করে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, প্রকাশ্যে মানুষকে হত্যা করেছিল এমন কী জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল, মেয়ে-নারীদের বোরখার ভেতর ঢুকতে বাধ্য করা সহ মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল সে গোটা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখেছে। কেবল তাই নয়, তারা সে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, সংগীতকে করেছে নিষিদ্ধ। এক কথায় দেশটিকে নিয়ে গিয়েছিল অন্ধকার যুগে। আজ থেকে বিশ বছর আগে নাইন-ইলেভেন-সন্ত্রাসী আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করলে ধীরে ধীরে সেখানে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে কেবল আফগানিস্তান নয়, গোটা এলাকা থেকে তালেবানরা বিতাড়িত হয়। ওই অঞ্চলে ফিরে আসে পুরোপুরি না হলে অনেকটা স্বাভাবিক জীবন। আর এই ‘অনেকটা’ স্বাভাবিক ও নিরাপত্তা জীবন ফিরিয়ে আনা যে সম্ভব হয়েছিল মার্কিন ও ন্যাটো সেনাবাহিনীর কারণে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এখন শংকা জো বাইডেনের সিদ্ধান্ত অনুয়ারি মার্কিন সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়া হলে আফগানিস্তান পুনরায় তালেবানদের দখলে যাবে না তো? যাবার সমূহ সম্ভাবনা। বর্তমান আফগানিস্তান সরকার ও তার সেনাবাহিনী দেশের ৮০% নিয়ন্ত্রণে রাখলেও তালেবানদের শক্তিকে কিছুতেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কেননা তারা তাদের অস্তিত্বের জন্যে মরিয়া এবং যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত। প্রশ্ন- তালেবানরা ক্ষমতায় এলে আফগানিস্তান কি পুনরায় সেই ‘অন্ধকারের যুগে’ ফিরে যাবে? কিংবা নারীদের প্রকাশ্যে চলাফেরা ও শিক্ষা নিষিদ্ধ করবে না? এই আশংকা প্রকাশ করেছেন খোদ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেনাবাহিনীর জেনারেলরা। হোয়াইট হাউস সূত্রে জানা যায়, বাইডেনের মিলিটারি ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা তার সাথে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার ব্যাপারে একমত নন। আশংকা প্রকাশ করেছেন বিরোধী দল, রিপাবলিকান পার্টির দক্ষিণ কেরোলিনার সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম। তিনি বলেন, “এর ফলে বাইডেন ইন্সুরেন্স-পলিসি বাতিল করলেন, যা আর একটি ‘নাইন-ইলেভেন’ প্রতিহত করতো।” কিন্তু বাইডেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তার নির্বাচনী-ওয়াদা পূরণে। নির্বাচন প্রচারাভিযানে তিনি ভোটারদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে ২০ বছর আগে আফগানিস্তানে শুরু হওয়া ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধের’ অবসান ঘটাবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পও অনুরূপ ঘোষণা দিয়েছিলেন, কিন্তু কার্যকর করেননি। ট্রাম্প আফগানিস্তানের যুদ্ধকে সম্পূর্ণ নষ্ট বা অপব্যবহার বলে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন এতে কেবল ‘যুক্তিহীন’ জীবনহানি হচ্ছে। ট্রাম্প অনেকবার এই বলে মন্তব্য করেছেন যে আফগানিস্তানে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় না করে সে অর্থ আমেরিকার উন্নয়নে ব্যয় করা উচিত। তিনি প্রায়শঃ বলতেন, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। তার এই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নির্বাচনী-ট্যাবলেট সাধারণ জনগণ বেশ গিলেছিল। কিন্তু দেখা গেল ক্ষমতায় এসে সাধারণ, খেটে-খাওয়া জনগণের চাইতে তিনি ট্যাক্স সহ তাবৎ আর্থিক সুবিধা দিলেন বিত্তশালীদের যারা তার নির্বাচনী তহবিলে বড় অংকের চাঁদা দিয়েছিলেন।
অন্যদিকে ক্ষমতায় এসে জো বাইডেনে যেটি প্রথমে করলেন তা হলো কোভিডের কারণে আর্থিক দুর্দশায় পড়া সাধারণ ও খেটে-খাওয়া নাগরিকদের উদ্ধার করার লক্ষ্যে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ‘কোভিড প্যাকেজ’ প্রবর্তন। রিপাবলিকান পার্টির নেতারা বাইডেনের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন এই অজুহাতে, এটি অর্থের অপচয়। তবে বাইডেনের এই উদ্যোগ রিপাবলিকান পার্টির সাধারণ সমর্থকরা সঙ্গত কারণে খুশি মনে গ্রহণ করেন। তবে তার অর্থ এই নয় যে তাদের সমর্থন বাইডেনের দিকে ঝুঁকছে। মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্প এমন ‘পোলারাইজেশন’ সৃষ্টি করে গেছেন এবং রাজনীতির যে ‘বিষবাষ্প’ সৃষ্টি করে গেছেন তা অদূর ভবিষ্যতে স্বাভাবিক রূপ নেবে তেমন আশা সুদূর পরাহত। বাইডেন তার দেয়া নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো অনুযায়ী এখন অভ্যন্তরিক ইস্যুর দিকে বিশেষ করে ‘কোভিড মোকাবেলা’ এবং ‘দেশের অর্থনীতি’ গড়ে তোলার দিকে নজর দিয়েছেন। আর সে কারণে আফগানিস্তান থেকে তিনি আমেরিকা ও মার্কিন সেনা সদস্যদের ফিরে আনার পদক্ষেপ নিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের যে কক্ষ (ট্রিটি রুম) থেকে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ দেশের সব চাইতে দীর্ঘ-মেয়াদি যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই একই কক্ষ থেকে গেল সপ্তাহে জো বাইডেন আফগানিস্তান ত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘২০ বছর আগে ভয়াবহ আক্রমণের কারণে আমরা আফগানিস্তান গিয়েছিলাম। ২০২১ সালে এসে সেখানে অবস্থান করার কোন যুক্তি হতে পারে না। যারা এই বলে দাবি করছেন যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার সঠিক সময় এখনো আসেনি, তাদের উদ্দেশ্যে বাইডেন বলেন, ‘ত্যাগ করার সঠিক সময় কখন? আরো এক বছর পর? আরো দুই বছর? আরো ১০ বছর? আমরা ইতিমধ্যে সেখানে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছি। এখন সময় এসেছে ফিরে আসার এবং আমেরিকাকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, আমেরিকার হৃত সম্মান, ইমেজ উদ্ধার করা। এই ব্যাপারে বাইডেনের আর্মি জেনারেলরা তার সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগণ বাইডেনের সাথে একমত। গত দুটি নির্বাচনে ভোটাররা বলেছিলেন আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের লক্ষ্য দিন দিন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। সেটি কেবল যে রিপাবলিকান সমর্থকরা মনে করতেন তা নয়, একই অভিমত ডেমোক্রাট পার্টির সমর্থকদেরও।
সবে ক্ষমতায় বসার ১০০ দিন অতিবাহিত করলেন ৭৮ বছরের জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট। কেমন গেছে তার এই ১০০টি দিন। শুরু থেকেই তার জন্যে অপেক্ষা করছিল বেশ কটি বড় চ্যালেঞ্জ। কোভিড, কোভিডের কারণে নিম্নমুখী দেশের অর্থনীতি, ঊর্ধ্বমুখী বেকার সংখ্যা ইত্যাদি। তার উপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক বিষবাষ্প, বর্ণবাদ, মেঙিকো বর্ডারে শরণার্থী সমস্যা এবং রিপাবলিকান পার্টির অসহযোগিতা। প্রথম দিন (২০ জানুয়ারি ২০২১) ক্ষমতায় বসেই তিনি ১৭টি প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডারে সই করেন এবং পরবর্তী এক সপ্তাহে আরো ৩০টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে। সব কটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ফিরে আসা, প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তিতে ফিরে আসা, বর্ডারে দেয়াল নির্মাণ বন্ধ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত কয়েকটি মুসলিম দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া এবং কানাডা ও গালফ অব মেঙিকোর পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ বন্ধ ঘোষণা। তার এই প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রির ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেয়া উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি বাতিল হয়ে যায়। এরপর জো বাইডেন দৃষ্টি দিলেন বাইরে। চীন, রাশিয়াকে এক হাত দেখে নিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অতি-ঘনিষ্ঠ ও মিত্র দেশ ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে বেশ কিছুদিন অপেক্ষায় রেখে বুঝিয়ে দিলেন তিনি (ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী) তার খুব একটা পছন্দের নন। অন্যদিকে সৌদি প্রিন্স যিনি ‘মোহাম্মদ বিন সালমান’ এম বি এস হিসাবে যিনি সমধিক পরিচিত এবং সৌদি বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক খাসোগি হত্যার সাথে সরাসরি যিনি জড়িত বলে ধারণা করা হয়, তাকেও বুঝিয়ে দিলেন, তিনি (প্রিন্স) নির্দোষ নন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত উষ্ণ আচরণ তিনি তার থেকে পাবেন না। কেউ কেউ বলেন, এতে বাইডেন তার মেয়াদের শুরু থেকে ঘরের বাইরে শত্রু বাড়িয়ে তুলছেন। এতে তার সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। জো বাইডেন ঝানু রাজনীতিবিদ। প্রেসিডেন্ট হবার আগে ক্ষমতায় থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে তিনি দীর্ঘদিন সক্রিয় বিচরণ করেছেন। অতএব তেমন কোন পরিস্থিতি এলে তিনি ঠিক সামাল দিতে পারবেন বলে ধারণা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাকালে শেষ যাত্রার সঙ্গী
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ