হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১০ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

এ যাত্রায় কি মার্ক রুতে বেঁচে গেলেন? চলছে ডাচ কোয়ালিশন সরকার গঠন প্রক্রিয়া
পড়তে পড়তে রক্ষা পেলেন ডান-লিবারেল রাজনৈতিক দল, পার্টি ফর ফ্রিডম এন্ড ডেমোক্রেসি (ভেই ভেই ডে) নেতা, একটানা চতুর্থ বারের মত প্রধানমন্ত্রী হতে যাওয়া মার্ক রুতে। চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি হল্যান্ডে জাতীয় নির্বাচন হবার মাত্র সপ্তাহ দেড়েকের মাথায় তার বিরুদ্ধে আনীত এক ‘অনাস্থা ভোটে’ কোনভাবে বেঁচে গেলেন। তবে বিপদ এখনো সম্পূর্ণভাবে কাটেনি। প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে তাকে একেবারে বিরোধী দলীয় আসনে গিয়েও বসতে হতে পারে শেষতক। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কোন কথা নেই। অথচ এমনটি হবার কথা ছিল না। নির্বাচনের পর খুব আনন্দে ছিলেন তিনি এবং তার দল। তিনদিন (১৫-১৭ মার্চ) ব্যাপী অনুষ্ঠিত ১৫০ আসনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল ৩৪ আসন পেয়ে শীর্ষে অবস্থান করছিল এবং প্রথা অনুযায়ী নির্বাচনের পর পর সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা প্রক্রিয়া চলছিল। সরকার গঠনের জন্যে নিদেনপক্ষে ৭৬ আসন প্রয়োজন। যেহেতু বরাবরের মত কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, সে কারণে ‘কোয়ালিশন সরকার’ গঠনের জন্যে এই আলোচনা। কিন্তু সেখানেই ঘটে যত বিপত্তি। মার্ক রুতে যে আবারো প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন সে সময় তা এক প্রকার ধরে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আলোচনার এক পর্যায়ে একটি ‘গোপন ও সেনসিটিভ’ তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়লে ‘গণেশ’ উল্টে যায়। ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’- বেরিয়ে পড়ে সেই গোপন কথাটি। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন মার্ক রুতে। কিন্তু তিনি সরাসরি বলেন এই ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। চাপের মুখে পরে বললেন, কী আলোচনা হয়েছিল তার ঠিক মনে পড়ছে না। এই কথাটি বলেই সোজা বাংলায় যাকেই বলে তিনি ‘ধরা’ খেলেন। কেয়ার-টেকার সংসদ সদস্যরা বললেন, এটি কিছুতেই গ্রহণীয় ও বিশ্বাসযোগ্য নয় যে এক সপ্তাহ আগের এই মিটিং-এ কী আলোচনা হয়েছিল তা মার্ক রুতের মনে পড়ছে না। এটি নিশ্চিত যে তিনি বিষয়টি গোপন করছেন। বিরোধী দলগুলি এমন কি গত কোয়ালিশন সরকারের থাকা বাকি তিনটি দলও তার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলো। প্রধান বিরোধীদলগুলো রুতের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তুলে তার পদত্যাগ দাবি করে বলে, মার্ক রুতে সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন এবং পরবর্তী সরকার গঠনে তার কোন অধিকার নেই, সে যোগ্যতা তিনি আর রাখেন না। তার দলের ভেতরেও মৃদু সমালোচনার রব শোনা গেল। কিন্তু দলের মধ্যে দ্বিতীয় শক্তিশালী নেতা তেমন কেউ নেই বিধায় দলের সে মৃদু ‘রব’ তেমন ‘সরব’ হতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন- কী ছিল ওই ‘গোপন কথাটি’?
গোপন কথাটি হলো, গত কোয়ালিশন সরকারে থাকা ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স (সিডিএ) এম পি পিটার অমজিগটকে তার অবস্থান থেকে সরানোর একটি গোপন সরকারি সিদ্ধান্ত। আগামী সরকারে যেন তার (পিটার) গুরুত্বপূর্ণ কোন অবস্থানে থাকা না হয় তার জন্যে এই নোট, নথিতে কেবল ক’টি শব্দ ছিল, তা হলো ‘পিটারের বদল’। দলের মধ্যে জনপ্রিয় পিটার এবারের নির্বাচনে সবচাইতে বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ‘চাইল্ড বেনিফিট’ নিয়ে সরকারি কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছিলেন পিটার। তারই ফলশ্রুতিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে মার্ক রুতের কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে। পিটারকে শায়েস্তা করতে বা ‘শিক্ষা’ দিতে এই গোপন ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী রুতে তেমনটি ধারণা করা হয়। কিন্তু বিধি বাম। কথায় আছে ‘ম্যান প্রোপোজেস গড ডিসপোজেস’, ‘মানুষ চায় এক, সৃষ্টিকর্তা করেন ভিন্ন’। আমাদের দেশের তুলনায় এই বিষয়টি নিতান্তই ‘তুচ্ছ। এর চাইতে কত হিমালয়-সমান ভুল করে সরকার, মন্ত্রীরা, অহরহ। কোন ‘খবরই’ হয় না, অথচ কত একটি ‘তুচ্ছ’ বিষয়কে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী তার আসন প্রায় হারাতে যাচ্ছিলেন এবং এখনো শতভাগ নিশ্চিত না তার গদী থাকছে কি থাকছে না। একেই বলে গণতন্ত্র, জনগণের কাছে অ্যাকাউন্টেবিলিটি বা জবাবদিহিতা। সপ্তাহ ধরে দেখেছি সংসদে অপমানিত ও লাঞ্ছিত মার্ক রুতে। সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে। অকৃতদার ও সৎ হিসাবে পরিচিত মার্ক রুতে বসে আছেন নির্লিপ্তভাবে। শেষে ক্ষমা চেয়ে আপাতত রক্ষা কোনভাবে। অনাস্থা প্রস্তাব আনার কথা ছিল তার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু ‘রাজনৈতিক শূন্যতা’ দেখা দেবে দেশে এবং কয়েক সপ্তাহের মাথায় আবারো নির্বাচন হতে হবে, সে কারণে কোয়ালিশন সরকারে থাকা বাকি তিনটি দল রুতের নেতৃত্বে সরকারের উপর ‘অনাস্থা’ প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিলো না। তবে তার আচরণ ও জনগণের প্রতি বিশ্বাস ভঙ্গ এবং সত্যি কথা না বলার জন্যে সংসদ সদস্যদের আনীত প্রস্তাব গৃহীত হয়।
২০১০ থেকে পর পর তিনবার সরকার প্রধান হওয়া মার্ক রুতে এ যাত্রায় হয়তো রক্ষা পেলেন, তবে শুরুতেই বলেছি এখনো বিপদ সম্পূর্ণ কাটেনি। সামনে যে তার ‘বন্ধুর’ পথ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, এই ঘটনার পর তার উপর কেবল তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের নয়, সাধারণ জনগণেরও আস্থা কমে গেছে। তবে সে যে কেবল সামপ্রতিক এই কেলেঙ্কারির কারণে তা নয়, এরও আগে তিনি বার কয়েক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে জড়ান এবং তার সরকার সমালোচিত ও নিন্দিত হয়। প্রতিবারই তিনি একটি কথা বলে পার পেয়ে গেছেন, তা হলো, ‘তখনকার কথা আমার মনে পড়ছে না কিংবা স্মরণ করতে পারছি না’। এই একই কথা যখন এইবারও বললেন, তখন বিরোধী দলের নেতারা যুক্তি তুলে ধরে বললেন, ‘যে ব্যক্তি এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত মিটিং-এ কী আলোচনা হয়েছিল মনে করতে পারেন না, তখন ধরে নিতে হবে তার স্মৃতিশক্তি সমস্যা আছে এবং এমতাবস্থায় তার পক্ষে দেশ পরিচালনা করা বিপদজনক’। পার্লামেন্টে ‘ম্যারাথন বিতর্ক’ শেষে রক্ষা পাবার পর মার্ক রুতে বলেন, ‘পার্লামেন্ট আমাকে একটি সিরিয়াস বার্তা দিয়েছে এবং সবার বিশ্বাস ফিরে পাবার জন্য আমি আমার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমি এই বার্তা শুনেছি এবং আমার অন্তরে গ্রহণ করেছি’। তাতেও কিন্তু চিড়ে ভেজেনি। কোন কোন দলনেতা বলছেন, তারা রুতের দলের সাথে কোয়ালিশনে যাবেন, তবে রুতের নেতৃত্বে নয়, তাকে সরে দাঁড়াতে হবে।
কথায় আছে কারো সর্বনাশ, কারো পৌষমাস। বেচারা রুতের যখন এই বেহাল দশা তখন ওলন্দাজ রাজনৈতিক মঞ্চে সামনে চলে এলেন ডি -৬৬ দলের নতুন নেত্রী সিগ্রিড কাগ। গেল নির্বাচনে এই দলটি বেশ ভালো করে এবং আসন সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণে (২৪) গিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। এটি সম্ভব হয়েছে এই মহিলার ক্যারিশমার কারণে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। মার্ক রুতেকে নিয়ে অনেকে যখন অনিশ্চয়তায় ছিলেন তখন কেউ কেউ প্রস্তাব রেখেছিলেন সিগ্রিড কাগ আগামী কোয়ালিশন সরকার গঠন করুক। সেটি করতে গেলে তাকে আরো ৬টি রাজনৈতিক দলের সাথে সমঝোতা করতে হবে, যা আপাতত সম্ভব নয় বলে রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা মনে করেছেন। এদিকে রুতে কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম শরিক দল, ক্রিস্টিয়ান ইউনিয়ন দলের নেতা বলেন, রুতে যদি পরবর্তী সরকার গঠন করতে যায়, তাহলে তারা সেই কোয়ালিশনে থাকবেন না। কেননা তার ভাষায়, রুতের সাথে একত্রে কাজ করা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়, তিনি সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। অন্যদিকে -৬৬ নেত্রী সিগ্রিড বলেন, রুতের প্রতি তার বিশ্বাস সম্পূর্ণভাবে চলে গেছে। ‘তার এবং আমার মাঝখানে দূরত্ব এখন অনেক বেশি। আমি যদি তার অবস্থানে থাকতাম তাহলে আমি ইস্তফা দিতাম’।
কিন্তু মার্ক রুতে এত সহজে যে ‘ইস্তফা’ দেবেন না তা নিশ্চিত। তিনি বলেন, ‘আমি যোদ্ধা’ এবং সবার বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। ইতিমধ্যে কোয়ালিশন সরকার গঠনে দু-সদস্য বিশিষ্ট বিশেষ কমিশন কাজ শুরুই করেছে। আশা করছেন আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে কোন ফলাফল নিয়ে আসতে সক্ষম হবেন তারা। কেবল সরকার গঠন নয়, গতকাল হয়ে গেল ডাচ সংসদের নতুন স্পীকার নির্বাচন। গত পাঁচ বছর ধরে দক্ষতার সাথে সংসদ পরিচালনা করেছেন মরক্কীয় বংশোদ্ভূত ডাচ নাগরিক, খাদিজা আরিব। লেবার পার্টি সদস্যা, খাদিজা আরিব ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডাচ জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ২০১৫ সালে বছর খানেক তিনি ভারপ্রাপ্ত স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। ওলন্দাজ রাজনীতিতে অতি পরিচিত মুখ ৬১ বছরের এই মহিলা ১৫ বছর বয়েসে মরক্কো থেকে হল্যান্ড আসেন এবং পরবর্তীতে আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সোসিওলজি’ নিয়ে পড়াশুনা করেন। মরক্কোয় নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ১৯৮৯ সালে তিনি মরক্কোয় গ্রেপ্তার হন এবং ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে হল্যান্ড ফিরে আসতে সক্ষম হন। ১৯৯৮ সালে তিনি ডাচ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর তাকে আর ফিরে দাঁড়াতে হয়নি। স্পিকার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন বর্তমান স্পিকারসহ মোট তিনজন। বাকি দুজন হলেন, ডি-৬৬ এর মিস ভেরা বের্গকাম্প এবং চরম ডান দল পেই ফেই ফেই-র মার্টিন বসমা। গোপন ভোটে আগামী সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন ডি -৬৬ এর মিস ভেরা বের্গকাম্প।
সর্বশেষ, সমস্ত তর্ক-বিতর্ক একপাশে রেখে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হয়েছে। আলোচনার টেবিলে আবার সবাই ফিরে এসেছেন। ফিরে এসেছেন মার্ক রুতেও। দেখা যাক কখন নতুন কোয়ালিশন সরকার গঠন হয়। কে হন আগামী চার বছরের জন্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুতে না অন্য কেউ?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের সোনার বাংলা
পরবর্তী নিবন্ধঅর্থ-সন্ত্রাস ও সততার নির্বাসন