ভালোবাসার কারণে বৃটিশ সিংহাসন ছেড়েছিলেন অস্টম এডওয়ার্ড। সে আজ থেকে ৮৪ বছর আগে ১৯৩৬ সালে। তিনি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। বাধ্য হয়েছিলেন দেশ ছাড়তে। দেশ ছেড়ে তিনি অনেকটা অজ্ঞাত ছিলেন, বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রেখেছিলেন। জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়েছেন ফ্রান্সে এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। একই রাজপ্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে এর অন্যতম সিনিয়র সদস্য, প্রিন্স হ্যারি, যার পুরো নাম হ্যানরী চার্লস এলবার্ট ডেভিড। কেবল রাজপ্রাসাদ নয়, তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন তার স্ত্রী ম্যাগান ও সন্তান আর্চিকে নিয়ে। প্রথমে কানাডা, পরবর্তীতে ঘাঁটি গাড়লেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান অভিনেত্রী ম্যাগানকে ভালোবেসে বিয়ে করার পর থেকে তিনি (হ্যারি) এবং তার স্ত্রী রোষানলে পড়েন বর্ণ ও সংকীর্ণবাদী হিসাবে পরিচিত বৃটিশ মিডিয়ার, বিশেষ করে ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর মুখে। রাজপ্রাসাদ-কূটকৌশল ও নানা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় এই তরুণ রাজ দম্পতিকে। বিশেষ করে যখন ম্যাগান সন্তান-সম্ভাবনা, তখন থেকে তাকে নিয়ে, তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে বৃটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো নানা মুখরোচক, নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে যা ম্যাগান ও তার স্বামী প্রিন্স হ্যারিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এমন কী তাদের ঘরে অনাগত সন্তানের গায়ের রং কী ধরনের হবে এই নিয়েও কানাঘুষা চলে এবং তাকে (হ্যারি) প্রশ্ন করা হয়। এও বলা হয় যে, যে সন্তান আসছে তাকে প্রিন্সের ‘টাইটেল’ দেয়া হবে না। বৃটিশ পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিতে হ্যারির ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের স্ত্রী কেইট যা করেন সবই ভালো। অথচ ম্যাগান যদি একই কাজ একই ভাবে করেন তার নিন্দায় মেতে উঠেন তারা। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, যা আমি এই কলামে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে উল্লেখ করেছিলাম। তা হলো, কেইট গর্ভবতী হলে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। বৃটিশ ট্যাবলয়েডগুলো লিখলো: ‘স্ত্রীর সুস্থতা কামনা করে প্রিন্স উইলিয়াম তার স্ত্রীর কাছে একটি শিশুর মাধ্যমে ‘আডভোকাডো’ (এক ধরনের খাবার ফল) পাঠিয়েছেন। যে শিশুটির হাতে ফল পাঠিয়েছেন তার মাও গর্ভাবস্থায় একই ধরনের অসুস্থতায় ভুগছিলেন। নিজের স্ত্রীর পাশাপাশি শিশুটির মায়েরও অসুস্থতা কামনা করেছেন উইলিয়াম।’ একই ঘটনা যখন ম্যাগানের ক্ষেত্রে ঘটলো তখন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে লিখলো সেই পত্রিকা। এই ঘটনার বছর দেড়েক পর প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী ম্যাগান গর্ভবতী হলে তিনি অনুরূপ ফল (আডভোকাডো) খেলেন। পত্রিকাটি লিখলো: ‘গর্ভবতী ডাচেস অব সাসেস্ক (ম্যাগান) আডভোকাডো ‘গিলছেন’। অথচ এই ফল গাছটির কারণে পানির স্বল্পতা, অবৈধভাবে বন উজাড় ও পরিবেশের সামগ্রিক ক্ষতি হচ্ছে।’ অপমান ও অবজ্ঞা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে এক পর্যায়ে ম্যাগান আত্মহননের কথাও ভেবেছিলেন। ম্যাগান বলেন, ‘আমার চারপাশের যে কোন কিছু নিয়ে গণমাধ্যমের এক ধরনের বিশেষ আগ্রহ কাজ করত। এমনকি আমার মা-বাবার গতিবিধির খবর নেওয়ার জন্যও গণমাধ্যমকে অর্থ দেওয়া হয়েছিল।’
রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের এই সমস্ত কাহিনী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কানাঘুষা চলছিল। কিন্তু যাদের উপর দিয়ে এই ঝড়-তুফান বয়ে গেছে তারা নিজেরা যখন এই সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন গোটা বিশ্ব হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সবার মত আমিও অবাক বিস্ময়ে ও রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নিয়ে টিভি পর্দায় দেখছিলাম ও শুনছিলাম প্রায় আড়াই ঘণ্টার তাদের একান্ত সাক্ষাৎকার। গেল ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস টিভিতে তারা কথা বলছিলেন ‘অপরাহ উইথ মেগান অ্যান্ড হ্যারি : এ সিবিএস প্রাইমটাইম স্পেশাল’ অনুষ্ঠানে। বরণ্য সাংবাদিক অপরাহ উইনফ্রির সাথে ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের নিজ বাসভবনে। অবাক হয়ে তাদের মুখে শুনছিলাম ডিউক অব সাসেঙ প্রিন্স হ্যারিকে দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাজপ্রাসাদ থেকে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে, অবাক হয়েছিলাম শুনে যে রাজপ্রাসাদ থেকে দেয়া তার ‘ভাতা’ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অবাক হয়ে শুনছিলাম কেবল রাজপ্রাসাদ নয়, কেন তাকে তার নিজ দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে সে কাহিনী। বার বার অবাক হয়েছি। অবাক হয়েছেন উইনফ্রি নিজেও। কিছুক্ষণ পর পর অবাক বিস্ময়ে তিনি উচ্চারণ করেছেন, ‘হোয়াট’? এটা কি প্রতিহিংসা পরায়ণতা? কি কারণে? কার বিরুদ্ধে? তাদের এই সাক্ষাৎকারকে ইতিমধ্যে ‘বোমশেল’ বা ‘বোমা-ফাটানো’ সাক্ষাৎকার হিসাবে উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বলা হয়, ‘এতে বৃটিশ রাজপরিবার ও রাজপ্রাসাদকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে। ফেলেছে সংকটেও।’ তাদের এই সাক্ষাৎকারে আরো বেরিয়ে এসেছে এতদিনকার না-জানা তথ্য। রানী এবং প্রিন্স চার্লস কিংবা প্রিন্স উইলিয়ামের চারপাশে যে বলয় তার কথা বেরিয়ে এসেছে।
প্রিন্স হ্যারিকে দেখে আমার কষ্ট হয়েছে। স্ত্রী ম্যাগান ও সন্তান অর্চিকে নিয়ে সুখে আছেন বললেও কেন জানি মনে নয়, পুরোপুরি সুখী তিনি নন। কতই বা বয়স। এই বয়সে কত ধকল সইতে হয়েছে। অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছেন। দেখেছেন কীভাবে সংকীর্ণতাবাদী, বর্ণবাদী বৃটিশ ট্যাবলয়েড গণমাধ্যমগুলো তার মায়ের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, যার পরিণতি দুর্ঘটনায় মৃত্যু, দেখেছেন কীভাবে তার মা রাজপরিবারে এমন কী খোদ রানীর হাতে অপমানিত হয়েছেন বারবার, এমন কী অন্য নারীতে আসক্ত তার বাবা প্রিন্স চালর্সের হাতেও। বৃটিশ জনগোষ্ঠী ও বহির্বিশ্বে প্রিন্সেস ডায়ানার ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা রাজপরিবারের অনেককে, এমন কী খোদ রানী এলিজাবেথকেও ঈর্ষণীয় করে তোলে বলে শোনা যায়। ঠিক একই ভাবে ম্যাগান ও প্রিন্স হ্যারি যখন বহির্বিশ্বে তাদের মানবতার কাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন তখন তারাও এই ঈর্ষার শিকার হন। উইনফ্রিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রিন্স হ্যারি বলেন, তারা নিজ থেকে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে আসেননি। তারা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ঘিরে এমন একটা পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে যাতে তিনি বাধ্য হয়েছেন তার স্ত্রী, সন্তান এবং নিজেকে বাঁচানোর জন্যে রাজপ্রাসাদ ছাড়তে। ‘কারো সমর্থন না পেয়ে সরে দাঁড়ানোর জন্যে রাজপরিবারের কেউ দুঃখ প্রকাশ করেননি। ব্যাপারটা এমন যেন রাজপরিবার ছাড়ার সিদ্ধান্তটা আমাদের। এ কারণে আমাদের এমন পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে,’ দুঃখের সাথে বললেন প্রিন্স হ্যারি। সাক্ষাৎকারে হ্যারির সঙ্গে একমত পোষণ করে মেগান বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণমাধ্যমের সঙ্গে হঠকারী সম্পর্ক স্থাপন করেছে।’ তাঁকে (ম্যাগান) ও হ্যারিকে গণমাধ্যমের অসত্য প্রচার থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন রাজপরিবারের গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকেরা। তবে ইতিমধ্যে, হ্যারির এ ধরনের অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়েছে দ্য সোসাইটি অব এডিটরস। তারা বলেছেন, সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই হ্যারি এ ধরনের অভিযোগ করেছেন। ব্রিটিশ গণমাধ্যম সংকীর্ণবাদী নয়। প্রতিবাদ জানিয়েছে ডেইলি মেইলও। তবে দ্য সোসাইটি অব এডিটরসের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব রয়েছে, এমন এক ব্যক্তি প্রিন্সকে সাবধান করে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে না যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই ব্যক্তি হ্যারিকে বলেছিলেন, ‘গণমাধ্যমের সঙ্গে এমন করবেন না। তারা আপনার জীবন ধ্বংস করে দেবে।’ কেবল রাজপ্রাসাদেই নয়, আমরা দেখি অনেক সময় রাষ্ট্রযন্ত্রেও রাষ্ট্রনায়ককে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে ভেতরের একটি গোষ্ঠী। একটি অলিখিত নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে ফেলা হয় তাদের। ফলে তখন কার্যতঃ ওই রাষ্ট্রনায়কের হাতে সব সময় সব ক্ষমতা থাকে না। তিনি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারেন না। তেমনি অলিখিত নিয়মের বেড়াজালে আটকে আছেন হ্যারির ভাই প্রিন্স উইলিয়াম ও তাদের বাবা প্রিন্স চালর্স। সে কথাটিই বললেন প্রিন্স হ্যারি। তিনি বলেন, তার ভাই ও বাবা রাজপরিবারের নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছেন। তার বাবা তার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে তিনি জানান, তিনি তার ভাই, বাবাকে ভালোবাসেন এবং গত মাসে তার দাদা (রানীর স্বামী) প্রিন্স ফিলিপ যখন চিকিৎসার কারণে হাসপাতালে ছিলেন, তখন তিনি রানীকে ফোন করেন।
প্রিন্স হ্যারি ও ম্যাগানের এই একান্ত সাক্ষাৎকার মনে করিয়ে দেয় ২৬ বছর আগে হ্যারির মা, প্রিন্সেস ডায়ানার দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকার। সে সাক্ষাৎকারও ছিল একটি ‘বোমশেল’, যা রাজপ্রাসাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। বিবিসি প্যানারোমা অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মার্টিন বশিরকে দেয়া ওই সাক্ষাৎকার গোটা বিশ্ব জুড়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ওই সাক্ষাৎকারে প্রিন্সেস ডায়ানা বাইরে থেকে এসে রাজপরিবারের একজন সদস্য হিসাবে গড়ে উঠার লড়াই, বয়সে অনেক বড় প্রিন্স চার্লসের সাথে দাম্পত্য জীবনের কষ্ট, মাতৃত্বকালীন ঝড়-তুফান, হতাশা, অবসাদ, রাজপরিবারে পর্দার অন্তরালে ঘটে যাওয়া অনেক বঞ্চনা ও অন্যায়ের কথা ইত্যাদি নানা বিষয় অকপটে বলেছিলেন। একই ভাবে অনেকটা একই কাহিনী উঠে এসেছে হ্যারি ও ম্যাগনের এই সাক্ষাৎকারেও। এই দুয়ে পার্থক্য- ডায়ানাকে লড়তে হয়েছিল সম্পূর্ণ একা, তার পাশে তার দুঃসময়ে কেউ ছিলেন না। ছিলেন না তার স্বামী, প্রিন্স চার্লস। তিনি তখন অন্য নারীতে আসক্ত। অন্যদিকে, ম্যাগনের এই দুঃসময়ে তিনি পাশে সর্বক্ষণ পেয়েছেন প্রিন্স হ্যারিকে। প্রিন্স হ্যারি সর্বক্ষণ পাশে থেকে তাকে সাহস যুগিয়েছেন। তা না হলে হয়তো ম্যাগনের পরিণতিও হতে পারতো, ভিন্নভাবে। তারা দুজন ভালো থাকুক, সুন্দর থাকুক, ভালো থাকুক তাদের সন্তান আর্চি এবং ভালো থাকুক তাদের অনাগত সন্তান। ইতিমধ্যে রাজপ্রাসাদ হ্যারি ও ম্যাগনের সাক্ষাৎকারে দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, রানী তাদের ভালোবাসেন। সমস্যা যা তা বাইরে না এনে নিজেদের মধ্যে আলাপ করে সমাধানের পথ বের করা যেতে পারে। হ্যারি ও ম্যাগান রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলে ভালো লাগবে আমার এবং অনেকের। (১১-৩-২০২১)