মিয়ানমারে গণতন্ত্র আবারো ভূলুন্ঠিত সূচি পারবেন কি ফিরে দাঁড়াতে?
গণতন্ত্র পুনরায় মুখ থুবড়ে পড়লো প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে। ক্ষমতাচ্যুত হলেন ১৯৯১ সালে শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ৭৫ বছরের অং সান সু চি। ক্ষমতা দখল করলো সে দেশের সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল মিয়ানমারে নতুন কোন ঘটনা নয়। ১৯৪৮ সালে দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৭২ বছরে মিয়ানমার মাত্র ১৫ বছরের মতো বেসামরিক সরকার পেয়েছে। বাকিটা সময় দেশটির গণতন্ত্রের গলা টিপে ক্ষমতায় থেকেছে সে দেশের সেনাবাহিনী। আর তাই আবার সেনা বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের সংবাদে খুব একটা অবাক হইনি। বরঞ্চ এদ্দিন যে সে দেশের সেনাবাহিনীর জেনারেলরা সু চি-কে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কীভাবে সহ্য করেছেন সেটিই ছিল অবাক করা ব্যাপার। ক্ষমতার স্বাদ যে সেনাবাহিনী একবার পায় সে যে সহজে ছাড়ার নয়, সে আমরা কেবল মিয়ানমারে নয়, আমাদের দেশেও দেখেছি। তারা গণতন্ত্রের রক্ষক হিসাবে নিজেকে ঘোষণা দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরান, কিছু চমক দেখানো কাজ করেন এবং এক সময় নিজেরা রাজনৈতিক দল গঠন করে দেশ চালাতে থাকেন। মিয়ানমারেও অনেকটা আবার তাই হতে যাচ্ছে বলে ধারণা। নির্বাচন সঠিক হয়নি, কারচুপি হয়েছে এই অভিযোগ এনে সু চি-কে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে জেনারেলরা ক্ষমতায় জেঁকে বসেছেন। বর্তমান সেনা প্রধানের চাকরি মেয়াদ আর বেশি দিন নেই। তাই তিনি চেয়েছিলেন সু চি-র সাথে সমঝোতা করে প্রেসিডেন্ট হবেন। কিন্তু গেল বছর নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনা সমর্থিত দল তেমন সুবিধা করতে না পারায় সে সম্ভাবনা যে কম তা অনুধাবন করে বন্দুকের নল দিয়ে ক্ষমতায় গেলেন। জরুরি অবস্থা জারি করলেন। ধরপাকড় করে ভীতির সৃষ্টি করলেন। গ্রেপ্তার করলেন সু চি-কেও, যদিও বা তার বর্তমান অবস্থান কোথায় তা এখনো স্পষ্ট নয়। সেনা প্রধান ঘোষণা দিলেন এক বছরের মধ্যে পুনরায় নির্বাচন দেবেন। মিয়ানমারের জনগণ তার সে আস্বাসে খুব একটা আস্থা রাখতে যে পারছেন না তা বলা বাহুল্য। ইতিমধ্যে কিছু হালকা প্রতিবাদ হতে দেখা গেছে, ডাক্তাররাও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জোরালো প্রতিবাদ এখনো চোখে পড়েনি।
তবে কথা হলো, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও সে দেশের প্রকৃত ক্ষমতা কি কখনো সু চি-র কাছে ছিল? নেপথ্যে মূল কলকাঠি নেড়েছেন সেনা প্রধান আর তার জেনারেলরা। সেনাবাহিনীর সাথে দর কষাকষি করে নির্ভীক এবং মানবাধিকার নেত্রী সু চি-কে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেনা বাহিনী বরাবর ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে ছিল। গণতন্ত্র সে দেশে কখনো তার নিজস্ব পথে কিংবা গতিতে এগুতে পারেনি। পারেনি বলে তথাকথিত গণতন্ত্রের আবরণে ২০% আসন নির্দিষ্ট ছিল সেনাবাহিনীর জন্যে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল তাদের অধীনে। তাদের পুতুল হয়ে সু চি উড়ে এসেছিলেন এই হল্যান্ডে। যে শহরে আমার বাস, সেই দি হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর কোন হত্যাযজ্ঞ হয়নি। সেদিনের সেই বিচার সভায় আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রথম দিন তাকে দেখে, তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ দেখে মনে হয়েছে তিনি তার বিবেকের কাছে দংশিত হচ্ছেন, যখন রোহিঙ্গার পক্ষে আদালতে বক্তব্য রাখা হচ্ছিল। কিন্তু পরদিন দেখলাম ভিন্ন এক অং সু চি। মানবাধিকার রক্ষায় যে ব্যক্তি গোটা বিশ্বে আলোচিত ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন, পেয়েছিলেন শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার, সেই ব্যক্তি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইলেন এবং বললেন, না, কোন গণহত্যা হয়নি মিয়ানমারে। যে সেনাবাহিনীর পক্ষে তিনি সাফাই গাইলেন, বিশ্ব-নিন্দা কুড়ালেন, সেই সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিলো। তিনি কি ভুলে গিয়েছিলেন যে এই সেনাবাহিনী তাকে বছরের পর বছর গৃহবন্দী করে রেখেছিল। শেষ রক্ষা তার হলো না। গত সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যে সু চি-কে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তার বিরুদ্ধে পুলিশ যে চার্জশিট দাখিল করেছে তাতে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা বেশ কৌতূহলের উদ্রেক করে। সুচির বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ‘ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট’ নীতিমালা ভঙ্গ করেছেন এবং তার কাছে বেআইনী ‘কমিউনিকেশন ডিভাইস’ পাওয়া গেছে। পুলিশের তথ্য মতে, তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটকে রাখা হবে। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে দুই সপ্তাহের জন্যে পুলিশী তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কোভিডের সময় তিনি সভা করেছেন, যা ছিল নিষিদ্ধ। ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্যে কী জোরালো অভিযোগ! অং সু চি-র সাথে সেনাবাহিনীর একটি বিরোধ বরারব ছিল। এই বিরোধ ক্ষমতাকে ঘিরে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অং সুচির আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাকে ভয় পেয়ে এসেছে। এবার তারা সুচির বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ দাঁড় করার চেষ্টা করছেন তার লক্ষ্য তাকে (সু চি) রাজনৈতিক পদ থেকে থেকে দূরে রাখা, কেননা কোন পার্লামেন্ট সদস্যের ‘অপরাধমূলক দন্ড’ (ক্রিমিনাল কনভিকশন্স) থাকতে পারে না। সে ক্ষেত্রে সুচি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তিনি আর রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতে পারবেননা। বিগত ৩২ বছর ধরে জেনারেলরা সুচির জনপ্রিয়তার কারণে সৃষ্ট ‘হুমকিকে’ ‘নিউট্রালাইজ’ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি প্রতিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। এবার তারা সক্ষম হন কিনা সেটি দেখার বিষয়।
সেনা অভ্যুত্থানে অবাক হইনি তবে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েছি এই ভেবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেয়ার আলোচনা বিলম্বিত হবে, এমনকী অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আপাতত কম গুরুত্ব পাবে। অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে তাদের নিজস্ব সমস্যা এবং সমাধান খুঁজে বের করা। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র এই বিষয়টিকে কতটুকু সিরিয়াসলী নেয় সেটিও দেখার বিষয়। কেননা সদ্য ক্ষমতায় বসা ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সামনে ‘কোভিড’ সহ নানামুখী সমস্যা। যদিও বা সেনা অভ্যুত্থানকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে এবং অং সূচি সহ সকল বন্দীদের মুক্তি দাবী করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের উপর যুক্তরাষ্ট্র ‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা’ আরোপ করার হুমকি দেয়। জি-৭ সদস্য রাষ্ট্রগুলি (যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানী, ফ্রান্স ও জাপান) এক যুক্ত বিবৃতিতে সামরিক জান্তাকে অতি শীঘ্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার দাবি জানায়। পাশাপাশি মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর আহবান জানানো হয়। তাতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ভড়কে যাবে তেমন ভাবার কোন কারণ নেই। তারা খুব ভালো করে জানেন তাদের পেছনে আছে চীন ও রাশিয়া। মিয়ানমারে আছে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ। আর সে কারণে জাতিসংঘে মিয়ানমার সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রস্তাব চীনের প্রতিবাদের মুখে গৃহীত হতে পারেনি। অন্যদিকে স্বদেশে অং সূচি জনপ্রিয় হলেও বহিঃবিশ্বে তার আগের সে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরে তার অবস্থান তাকে বিশ্বে বিতর্কিত ও নিন্দিত করে তুলে। তারপরও এইভাবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে বন্দুকের নলের মধ্যে দিয়ে সরিয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করা কারো জন্যে কাম্য হতে পারে না। অং সুচি সাহসী মহিলা। অতীতে সমস্ত ভয়, ভীতি উপেক্ষা করে তিনি তার দেশের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ভুল যেটি তিনি করেছেন সেটি হলো এক পর্যায়ে তার আপোষকামিতা, সামরিক জান্তার সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি এবং তাদের (সামরিক জান্তা) পক্ষ হয়ে কাজ করা। শুরু থেকেই যদি তিনি অনড় থাকতেন তার আদর্শে, তাহলে তাকে রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরে গোটা বিশ্বে হেয় হতে হতো না এবং আজ এই পরিস্থিতির মুখে তাকে এবং তার দেশ মিয়ানমারকে হয়তো পড়তে হতোনা। গণতন্ত্র ফিরে পাবার লক্ষ্যে জনগণ সোচ্চার হবে, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে পুনরায় উঠে দাঁড়াবে এই আশা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট