‘বুদ্ধগয়া’- দেখা মিলল না সুজাতার বাড়ির-৪
নিরঞ্জনা! কী চমৎকার নাম। নামেই কাছে টানে। কেউ কেউ তাকে লীলাঞ্জনা নামেও ডাকে। নিরঞ্জনার কাছ থেকে ঘুরে এসে ভাবছি আবার কবে তার কাছে যাওয়া হবে। কেমন যেন অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে এই নদীটি। শীতে প্রায় শুকিয়ে আসে, অথচ বর্ষায় ভরা, পূর্ণ যৌবনা, উচ্ছল। এক সময় একে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ভারতের অন্যতম বাণিজ্য, সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য। সে সময় ক্ষমতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি ছিল এই বিহার রাজ্য। এই রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে নিরঞ্জনা নদী, যাতে স্নান করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। নিরঞ্জনা নদীর পাড়ে থাকতেন সুজাতা। এক সন্ন্যাসীর আগমনী বার্তা শুনে তিনি শ্রদ্ধাচিত্তে তাকে পায়েস দিয়েছিলেন। এরপরই সিদ্ধার্থ গৌতম বট বৃক্ষের নীচে ধ্যানে অধিষ্ঠিত হন, লাভ করেন বুদ্ধত্ব। সেই বৃক্ষ পরবর্তীতে ‘বোধিবৃক্ষ’ নাম ধারণ করে। আর এই বৃক্ষকে ঘিরে গড়ে উঠে বুদ্ধগয়া মন্দির, প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট অশোক। এই প্রথম আমার এই রাজ্যে আসা। বিহার পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। বিহার নামটি সংস্কৃত শব্দ ‘বিহার’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ আবাসস্থল বা ‘এবোড’। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সময়ে এই রাজ্যে প্রচুর সংখ্যক বৌদ্ধ বিহার ছিল, ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের আবাসস্থল। মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী একটির পর একটি রাজ্য জয় করতে গিয়ে ১১৯৮ সালে বিহারে এসে হত্যাকাণ্ড ঘটান এবং বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আবাসস্থল ধ্বংস করে দেন। হত্যা করে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে। ধ্বংস করা হয়, নালন্দা ও বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এই বিহার রাজ্য থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে বুদ্ধ গয়া। এখন বৌদ্ধ ধর্মীয় কার্যকলাপ বিহারের এই বুদ্ধগয়াতে এসে সীমিত হয়েছে। এখন আর বিহারের আগের সে জৌলুশ নেই। দু’দিনের অবস্থানে যেটুকু দেখেছি এদিক-ওদিক, দারিদ্র্যের ছোঁয়া চোখে প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। রাস্তার দু-ধারে ঘরবাড়ি, মানুষগুলো যেন প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে। রাস্তার ধারে ক্ষেতে পুরুষের চাইতে মহিলাদের সক্রিয় অবস্থান বেশি বলে মনে হলো আমার স্বল্পসময়ের দেখায়।
আগেই বলেছি ইতিহাস আমার বিষয় নয়। আমার দেখা ও শোনা অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। দ্বিতীয় দিন মহাবোধি বুদ্ধ মন্দির দেখে এসে আমাদের হাতে প্রচণ্ড অবসর। যে গাড়ি চড়ে আমাদের কলকাতা থেকে বিহার আসা সেটি রয়ে গেছে আমাদের সাথে, তার চালক সহ। সে ভাবেই গাড়ির মালিকের সাথে কথাবার্তা হয়েছে। দলের সদস্যরা ঠিক করলো বুদ্ধগয়ার আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখবে। একটু দূরেই নাকি সুজাতার বাড়ি। নিরঞ্জনা নদীর তীরে। সে কারণে এই নদীটির এখন আলাদা একটি পরিচিতি আছে, গুরুত্ব আছে। সুজাতার বাড়ি জিজ্ঞেস করলে অনেকে বলে দেয় বলে শুনেছি। সেই লক্ষ্যে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে, যদিও বা তখন আমার চলার মত শারীরিক দশা ছিল না। কেননা গত দু-তিনদিন ঘুম তেমন হয়নি বললেই চলে। হল্যান্ড থেকে দেশে এসেই কলকাতা, তারপর দীর্ঘ গাড়িপথ পেরিয়ে বুদ্ধগয়া। বুদ্ধগয়া এলাকায় আরো বেশ ক’টি বৌদ্ধ মন্দির। বিভিন্ন দেশের তৈরি। মহাবোধি বুদ্ধ মন্দিরের কাছাকাছি বেশ বড়সর এলাকা নিয়ে নিজস্ব স্টাইলে গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ মন্দির। বাংলাদেশ ছাড়াও যে সমস্ত দেশের দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ মন্দির আছে তা হলো, শ্রীলংকা, ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড, তিব্বত, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, চীন, জাপান, মায়ানমার ও কোরিয়া। চীনের মন্দিরে বুদ্ধ মূর্তিটি ২০০ বছরের পুরানো এবং চীন থেকে আনা বলে জেনেছি। জাপানের মন্দির দেখলে মনে হয় প্যাগোডা, মায়ানমারের মন্দিরটিও অনুরূপ। থাই মন্দিরের পাশে ২৫-মিটার উঁচু বুদ্ধ মূর্তি দূর থেকে সবার দৃষ্টি কাড়ে। এক কথায় চমৎকার। এটিও এখানে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সবার দৃষ্টি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে চলেছে। এর চারিদিকে, প্রবেশমুখে চমৎকার চোখ-জুড়ানো, মন-ভোলানো বাগান, বিশাল বুদ্ধ মূর্তিকে ঘিরে যে চত্বর তাতে বুদ্ধের শিষ্যদের দাঁড়িয়ে-থাকা মূর্তি। সময়ের কারণে সব কটি মন্দিরের ভেতরে যাওয়া হয়ে উঠেনি। নান স্থান, নানা দেশ থেকে আসা ভক্ত, দর্শক, পর্যটকের কমতি নেই, নানা বয়েসী। গোটা এলাকাটি যেন স্থায়ী মেলা। নানা ধরনের সামগ্রী নিয়ে ডালা খুলে বসেছে ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলি। গাড়ি চলাচলের রাস্তাগুলি তেমন বড় নয়, ফলে অনেক রাস্তা গাড়ি চলাচলের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যাতে দর্শনার্থীরা কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে। তবে ওই সমস্ত এলাকায় টুকটুক জাতীয় পাশে খোলা টেঙি চলাচল করছে, ওরাই আপনাকে বুদ্ধগয়া এলাকায় ঘুরিয়ে দেখাবে পয়সার বিনিময়ে। হেঁটে দর্শনীয় সব কিছু দেখা সম্ভব নয়, যদি না আপনার হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে। এতে লাভ হয়েছে স্থানীয় যুবকদের, তাদের কিছু কর্মসংস্থান হয়েছে। কেননা এছাড়া বুদ্ধগয়া এলাকায় আর তেমন কোন কর্ম সংস্থানের সুযোগ দেখলাম না। কেবল বুদ্ধগয়া এলাকাই বা বলি কেন, গোটা বিহার রাজ্য এখন ভারত থেকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। বিহারে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৮% ২৫ বছরের নীচে, যা গোটা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সব চাইতে বেশি। মাত্র ১১,৩% শতাংশ জনগণের শহরে বসবাস, বাদবাকি সবাই গ্রামাঞ্চলে। হিন্দী ছাড়াও উর্দু এখানকার প্রধান সরকারি ভাষা, এছাড়া আছে মাইথিলি, মাগাহী ও ভোজপুরি। বিহারের পশ্চিমে উত্তর প্রদেশ, উত্তরে নেপাল, পুবদিকে পশ্চিম বঙ্গ এবং দক্ষিণে ঝাড়খন্ড।
এইতো গেলো বিহারের অবয়ব। আমাদের গাড়ি, রাস্তায় চলমান গাড়ি আর পথচারীর ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলে সুজাতার বাড়ির দিকে। আমাদের যিনি গাইড, কুদ্দুর যেতেই পাশের জানালা খুলে পথচারী বা পানের দোকানদারকে হিন্দীতে জিজ্ঞেস করে জানতে চায় সুজাতার বাড়ি কোনদিকে। কেউ আঙুল দেখিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বলে, কেউ বলে ওই সামনের ব্রিজ পার হয়ে ডান দিকে এগিয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে কদ্দুর এগিয়ে গেলেই পেয়ে যাবে। কেউ গাইডের প্রশ্নটাই না বুঝে কোন উত্তর না দিয়ে তার গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যায়। এক পর্যায়ে আমরা ব্রিজ পার হয়ে এগিয়ে যাই। আর একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলে, তোমরা ঘুরে, যে দিক থেকে এসেছে সেদিকে ফিরে যাও। মেজাজটা গেল বিগড়ে। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সেই সকাল থেকে বাইরে। দুপুরে হালকা কোথায় কিছু খেয়ে নিয়েছিলাম বলে মনে হয়। মনে হয় এই কারণে, যখনকার কথা বলছি সে বছরের শুরুর দিককার কথা। ইতিমধ্যে ১১ মাস হয়ে গেছে। সঠিক মনে নেই। মনে যেটি আছে তা হলো, আমার পক্ষে আর গাড়িতে বসে থাকা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না। দুটো কারণে- এক, শরীর ভীষণ ক্লান্ত, মনে হচ্ছিল এখনই বুঝি পতন ঘটবে আমার, দুই, এতক্ষণ ধরে সুজাতার বাড়ি খোঁজার ধৈর্য্য আর আমার নেই। সুজাতার বাড়ি বলছি বটে, তবে এখন এতগুলি বছর, যুগ পেরিয়ে সেখানে যা আছে, তা ইতিহাস থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কিছু স্মৃতিচিহ্ন মাত্র। ‘সুজাতা স্তূপ’ বলে নিরঞ্জনা নদীর তীরে একটি নির্দিষ্ট এলাকা আছে, যেখানে ছিল তার বাবার বাড়ি। গ্রামের নাম বাকরাউর। সিদ্ধার্থ নিরঞ্জনা পার হয়ে ওই গ্রামে যান। সুজাতা ‘মানত’ করেছিলেন সন্তানের জন্যে তিনি কোন সন্ন্যাসীকে ‘পায়েস’ দান করবেন। গ্রামের একজন যখন বললে, এক সন্ন্যাসী এসেছেন, তখন সুজাতা ‘সারি’ চালের পায়েস বানিয়ে সিদ্ধার্থকে দেন। তা খেয়ে সিদ্ধার্থ কিছুটা শক্তি পান তার দেহে। খাওয়া শেষে অন্নপাত্র নিয়ে নদীতে আসেন এবং তা নদী জলে বিসর্জন দেন এই বলে, অন্নপাত্র ফিরে আসবে যদি আমার লক্ষ্য সিদ্ধি হয়। অন্নপাত্র ফিরে আসে, সিদ্ধার্থ ফিরে আসেন বোধিবৃক্ষের নিচে এবং সেদিনই ‘বুদ্ধত্ব’ লাভ করেন। পাঠক, এ আমাদের গাইড মানিকের মুখ থেকে শোনা। সেটি কতটুকু ইতিহাস-নির্ভর আমার জানা নেই।
সিদ্ধার্থকে পায়েস খাইয়েছিলেন এই মহীয়সী নারী, সুজাতা। তারই স্মৃতিতে গড়ে উঠেছে এই ‘সুজাতা স্তূপ’, খুব সম্ভবতঃ খ্রিস্টপূর্ব ২ শতাব্দীতে। সুজাতা স্তূপ আর দেখা হলো না আমার। আমার দলকে হতাশ করে বলি, আমাকে কোনখানে নামিয়ে দাও, আমি টুকটুক নিয়ে কামরায় ফিরে যাব, বিশ্রাম নেব। সুজাতায় আমার আর আগ্রহ নেই, অন্ততঃ আপাতত। বেঁচে থাকলে এবং আবার যদি আসি, হয়তো আসবো, তখন সুজাতার শ্বশুর বাড়ি ঘুরে আসা হবে। সুজাতার দর্শন তো পাবো না। তারপরও এমন ঐতিহাসিক স্থানটি একবার দেখে আসা দরকার। না হলে যে মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁত থেকে যাবে। আমার এই দলছুট সিদ্ধান্তে গাড়ির ভেতর সীমাহীন ধৈর্য্য নিয়ে বসে থাকা সহ-যাত্রীদের কেউ কেউ আমার ‘পরে অসন্তুষ্ট হলো বটে, তবে তা খুব আমলে না নিয়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘শরীরের নাম মহাশয়, তবে যদি সয়’। চালককে হিন্দীতে বললাম, ‘গাড়ি রোখো’। রাস্তার পাশেই সাইড করে গাড়ি থামতেই নেমে পড়ি। টুকটুক নিয়ে সোজা কামরা। পথিমধ্যে প্রচণ্ড ভিড়। মানুষ আর গাড়ির।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট