বুদ্ধের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত ‘বুদ্ধগয়া’ -৩
কাক-ডাকা ভোরে বুদ্ধগয়া বৌদ্ধ মন্দিরে যখন পৌছি তখন নানা দেশ থেকে আসা ধর্মপিপাসু নর-নারী শ্রদ্ধাবনতচিত্তে যার যার নিজস্ব প্রথানুযারী বন্দনা করে চলেছেন। বাইরে মন্দিরের গায়ে জ্বলছে প্রদীপ আর ধূপ। ভেতরেও। প্রধান মন্দির ছাড়াও এদিক-ওদিকে আরো বেশ কটি দর্শনীয় মন্দির ও উপাসনার স্থান। কাছেই একটি বড় জলাশয়, তার ঠিক মাঝখানে বুদ্ধের বড় একটি মূর্তি, মাথার উপর নাগমনি ফণা তুলে দাঁড়িয়ে। ধর্মে যারা বিশ্বাসী তারা বলেন, ঝড়, বৃষ্টি থেকে বুদ্ধকে রক্ষা করার জন্যে নাগমনি ফণা তুলে ধরেছিল। কাউকে কাউকে দেখলাম বোধি বৃক্ষের চারপাশ ঘিরে বসে, চোখ বুঁজে ধ্যানমগ্ন, কেউবা মন্দিরের চারদিক প্রদক্ষিণ করে চলেছেন, অন্যদিকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন কোন দেশ থেকে আসা ধর্মানুরাগীরা মৃদু শব্দে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছেন। প্রায় সবার পরনে সাদা থান। এমনি এক সাদা থান পরনে এক জাপানি তীর্থ যাত্রীর সাথে বুদ্ধগয়ায় সাক্ষাৎ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের। কবিগুরু দেখলেন জাপানি এই বৌদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করছেন আর প্রতিটি পদক্ষেপে একটি ধূপ জ্বেলে রেখে যাচ্ছেন। প্রশান্ত তার মূর্তি, গভীর তার ভক্তি। আলাপে কবি জানতে পারেন, এই ভক্ত এসেছেন সুদূর জাপান থেকে, পেশায় মৎসজীবি, নাম ফুজি। নিজ দেশে কোন এক সময় কৃত-অপরাধ মোচনের লক্ষ্যে তার এই পথ পাড়ি দেয়া, যে স্থানটিতে বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন, যে স্থান থেকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বে শান্তির বাণী, সেই স্থানটিতে এসে, সেই মাটির স্পর্শে কলুষমুক্ত হবে, স্নিগ্ধ হবে এই আশা নিয়ে তার এতটা পথ মাড়িয়ে আসা। এই যে আমি দেখছি আমার চারিধার শতশত নরনারী, এদের মাঝেও হয়তো অনেকেই আছেন যারা এই জাপানি মৎসজীবীর মত অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে বুদ্ধগয়ায় এসেছেন। প্রতিদিন বোধিবৃক্ষতলে বসে গভীর ধ্যানে প্রার্থনা করেন ফুজি। কবির দলে থাকা নিবেদিতা সযন্তে তাকে প্রতিদিন খাবার দিতেন। অতি সাদামাটা ভাবে তিনি (ফুজি) থাকতেন যাত্রীনিবাসের একটি ঘরে। রবীন্দ্রনাথ মাঝরাতেও শুনতে পেতেন জাপানি উচ্চারণে ফুজির মন্ত্রপাঠ। বুদ্ধগয়া ভ্রমণকালে কবির মনে জাপানি এই মৎসজীবী ভীষণভাবে দাগ কাটেন। কথাটি এই কারণে বলা, বুদ্ধগয়া দর্শন ও অবস্থানের প্রায় তিন দশক পর কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি হলে বুদ্ধের জন্মোৎসবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কবি এই জাপানি মৎসজীবীর কথা স্মরণ করে বলেন, “যারা মহাপুরুষ তারা জন্ম মুহূর্তেই স্থান গ্রহণ করেন মহাযুগে, চলমান কালের অতীত কালেই তারা বর্তমান, দুর্বিস্তীর্ণ ভাবী কালে তারা বিরাজিত। এ একথা সেদিন বুঝেছিলাম সেই মন্দিরেই। দেখলুম, দূর জাপান থেকে সমুদ্র পার হয়ে একজন দরিদ্র মৎস্যজীবী এসেছে কোনো দুষ্কৃতির অনুশোচনা করতে। সায়াহ্ন উত্তীর্ণ হল নির্জন নিঃশব্দ মধ্যরাত্রিতে, সে একাগ্র মনে করজোড়ে আবৃত্তি করতে লাগল: আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম”।
যাই হোক, এক পর্যায়ে সারিবদ্ধ আমরা মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করলাম। সামনে বিশালাকৃতি পদ্মাসনে বুদ্ধ। যেন জ্যোতি বেরুচ্ছে এই বুদ্ধমূর্তির গা থেকে। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোক এই মন্দির নির্মাণ করেন বলে ইতিহাস বলে। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে সম্রাট অশোক বড় ভূমিকা রাখলেও ধর্মান্তরিত হবার আগে তিনি রাজ্যের পর রাজ্য জয় করার লক্ষ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। কথিত আছে, কলিঙ্গ রাজ্যের (বর্তমান উড়িষ্যা) বিরুদ্ধে যুদ্ধে এক লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু দেখে তার মাঝে পরিবর্তন আসে। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শ্রীলংকা ও মধ্য এশিয়ায় পাঠান। সম্রাট অশোক গোটা এক সপ্তাহ বুদ্ধ গয়ায় কাটান কেবল বোধিবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে থেকে। বেশ কয়েকবার তিনি বুদ্ধগয়ায় এসেছিলেন। ইতিহাস বর্ণনা আমার কাজ নয়, সে জ্ঞান সীমিত। যা কিছু বলা তা এদিক-ওদিক পড়ে, শুনে জানা। আমরা আমাদের অর্ঘ্য, শ্রদ্ধাঞ্জলী বুদ্ধের চরণতলে অর্পণ করে বেরিয়ে আসি মন্দির থেকে। ভেতরে প্রচণ্ড ভীড়। ঠিক করি সন্ধ্যের সময় আর একবার আসা যাবে। রাতের আঁধারে, চারিদিকে যখন বাতি জ্বলে উঠবে তখন নাকি এই বৌদ্ধ মন্দিরের ভিন্ন এক রূপ, যা না দেখলে জীবনের অনেক কিছুই দেখা হয়নি বলে ধরে নেয়া হয়, সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিল আমাদের দলে থাকা মানিক, সম্পর্কে ভাগ্নি জামাই, থাকে কলকাতা। চমৎকার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। শুনলে কে বলবে সে কলকাতার। বাংলাদেশেও বছর কয়েক ছিল। তার সাথে এই প্রথম দেখা।
আমরা ফিরে যাই ‘বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট মনেস্ট্রিতে’, বাংলাদেশি বৌদ্ধদের মালিকানায় গড়ে উঠা এই মন্দিরের এই নাম। বোধি বৃক্ষকে ঘিরে যে মহাবোধি মন্দির তার থেকে খুব বেশি দূরে নয় বাংলাদেশি এই বৌদ্ধ মন্দির। আমরা হেঁটেই ফিরে এলাম। খুব সম্ভবত রাত নটার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করতে হয়। এর পর খাবার বন্ধ। গোটা আশপাশ এলাকায়থাই, জাপান, শ্রীলংকা সহ বিশ্বের নানা বৌদ্ধ দেশের মালিকানায় গড়ে উঠেছে নিজস্ব মন্দির। তাতে আছে সেই দেশীয় ভিক্ষু। আমাদের সাথে ভোরে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশ বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান, ড. কল্যাণ প্রিয় ভিক্ষুর। ব্যাখ্যা দিলেন এই মন্দির গড়ে উঠার ইতিহাস। তিনি জানালেন, ১৯৮৪ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু, মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরের নেতৃত্বে এক দল বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার অফিসে সাক্ষাৎ করেন। এই দলে মহাসংঘনায়কের সাথে ছিলেন, শুদ্ধানন্দ মহাথের, ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া, ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, রতন কুমার বড়ুয়া এবং সুনিতানন্দ শ্রমণ। তারা প্রধান ভারতীয় মন্ত্রীর কাছে বুদ্ধ গয়ায় বাংলাদেশী বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণে স্থানের জন্যে আবেদন জানিয়েছিলেন। তাদের বক্তব্য শোনার পর প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সাথে সাথে বিহার সরকারের কাছে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের কাছে স্থান বরাদ্দের জন্যে সুপারিশ করে চিঠি দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একই সালের ৩০ অক্টোবর নিজ দেহরক্ষীর হাতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে এই উদ্যোগ পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে রাজীব গান্ধী সরকার এই ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, গড়ে উঠে বাংলাদেশী মালিকানায় চমৎকার, দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ মন্দির। সামনে বেশ বড়সর খোলা মাঠ। তার সামনে একাংশে সুন্দর একটি বাগান, তারি মাঝে বসার ক’টি বেঞ্চ, চেয়ার, মাথার উপর ছাতির আকারে ছাদ। সেখানে দু’রাত খাবার শেষে আমরাও বসেছিলাম, আড্ডা দিয়েছিলাম অনেক রাত অবধি। তখন মন্দিরের সবাই নিজ নিজ কক্ষে। আমরা ক’টি প্রাণী আড্ডা শেষে হেঁটে গেইট গলিয়ে বের হয়েছিলাম চা কিংবা কফির সন্ধানে। অনেকদূর হেঁটে খুঁজে বেড়িয়েছি, পাইনি। ততক্ষনে সব বন্ধ। সব দোকান তাদের ডালা বন্ধ করে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটি দোকানে পাওয়া গেল মিষ্টি। সব কিছুতে ‘না’ করতে পারি, কিন্তু মিষ্টিতে ‘না’ করতে পারিনে। মিষ্টি খেয়ে, একটি ছোট্ট পানের দোকান থেকে ভাগ্নি বিটু কিনলো কিছু পান। মানিকের জন্যে। মানিক ছাগলের মত দিনের যতক্ষণ জেগে থাকে পান চিবোয়, সব সময় হাতে একটি প্লাস্টিকের ছোট ব্যাগ। আমাদের সাথে সে বের হয়নি, কামরায় শুয়ে ছিল।
বাংলাদেশি মালিকানায় মন্দিরের একটি বিষয় ভালো লাগলো, তা হলো, মন্দিরের দেখভাল বা মেইনটেনেন্স। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। তবে সাধারণ তীর্থ যাত্রীদের জন্যে যে থাকার কামরা সেগুলির ব্যাপারে আর একটু যত্নবান হলে আরো ভালো হতো। ভালো লাগলো, একদল অল্প বয়েসী ও তরুণ শ্রমণ রান্না-বান্না, ধোঁয়া-মোছার কাজ করছে দেখে। ড. কল্যাণ প্রিয় ভিক্ষু বললেন, ‘এখানে সব কাজ আমরা নিজেরাই করি। এমন কী এই যে অতিথি যারা প্রতিদিন এখানে আসেন, থাকেন, তাদের দু-বেলা খাওয়া, সকালের ব্রেকফাস্ট ও বিকেলে চা সব এরাই বানায়’। সত্যি খুব প্রশংসনীয়। ড. কল্যাণ প্রিয় ভিক্ষু জানালেন, বর্তমানে এই মন্দিরে ২৫ জন সদস্য আছেন, এর মধ্যে অর্ধেক ভিক্ষু, বাকিরা শ্রমণ। এদের অনেকে স্থানীয় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেন। মন্দিরের উপরে ও একদিকে রয়েছে অতিথিশালা। তাতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ট্যুরিস্ট থাকেন। বছরের অক্টোবর এবং নভেম্বর ভীড়টা বেশি, কেননা কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় নভেম্বরে। অনেকে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন। মা-বাবা বা নিকট জনের আত্মার মঙ্গল কামনা করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেন। মন্দিরের প্রধান ভিক্ষুকে আপনার সাধ্য বা ইচ্ছে মাফিক অর্থ দিলে তিনিই সকল ব্যবস্থা করে দেবেন, আয়োজন করবেন অনুষ্ঠানের। আমরাও এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্যে অনুরোধ জানিয়েছিলাম কল্যাণ প্রিয় ভিক্ষুকে। চমৎকার আয়োজন করেছিলেন পরদিন সকালে। বিদেশ বিভুঁয়ে কেনা-কাটার ঝামেলা থেকে মুক্ত আপনি। মন্দিরের গেইট পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ডানদিকে বড় ধরণের একটি হল ঘর, তাতে দেয়ালে মন্দির পরিদর্শনে ভারত ও ভারতের বাইরে থেকে আসা বিশিষ্টজনদের ছবি। বিহারাধ্যক্ষ জানালেন, ‘আপনার কাকা, লায়ন ড. মৃদুল বড়ুয়া চৌধুরী তার নিজস্ব অর্থায়নে ৮০ বাই ৪০ ফুট হল বানিয়ে দিয়েছেন’। শুনে খুব ভালো লাগলো। আমার অর্থবান এই কাকা দেশেও অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন, আমাদের গ্রাম-লাগোয়া যে জেলে পাড়া, সেখানকার বাসিন্দাদের জন্যে একটি বহুতল মন্দির বানিয়ে দিয়েছেন, গ্রামের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েদের হাই স্কুল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক