হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৫ জুন, ২০২২ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’ – সাবাশ বাংলাদেশ, পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়!

সাবাশ বাংলাদেশ, পৃথিবী সত্যিই অবাক তাকিয়ে রয়! স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’ আর স্বপ্ন নয়, এটি বাস্তব। বাংলাদেশ আবারো দেখিয়ে দিলো যে লক্ষ্য যদি হয় স্থির ও অবিচল, তবে সে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। কাজটি অসম্ভব হলেও আর সেই ‘অসম্ভবকে’ সম্ভব করেছে বাংলাদেশ। আর এটি সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাসের কারণে- সে কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। স্বপ্নের সেতু ‘পদ্মা সেতু’ যখন নানা প্রতিকূলতা, বাধা, সমালোচনা ও প্রতিরোধের মুখে অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে এবং অনেকে ‘শুরুতেই এর শেষ’ বলে ধরে নিয়েছিলেন, তখন শেখ হাসিনা সমস্ত শঙ্কা, জল্পনা-কল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু আমরা বানাবোই এবং নিজস্ব অর্থায়নে।’ তার এই উক্তিকে অনেকে তার ‘আস্ফালন’ ও ‘দম্ভোক্তি’ হিসাবে দেখেছিলেন। অনেকে এও বলেছিলেন পদ্মার মত খরস্রোতা নদীতে সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। এমন কী খোদ সরকারের অনেকেও আড়ালে-আবডালে সন্দিহান ছিলেন। ছিলেন না কেবল শেখ হাসিনা। বিশ্ব ব্যাংক তার দেয়া প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিলো কারচুপির অভিযোগ এনে, যা পরবর্তীতে কানাডার কোর্টে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সমস্ত প্রতিরোধ ডিঙিয়ে মাথা উঁচু করে যেন পরম অহংকারে দাঁড়িয়ে গেল স্বপ্নের সেতু, ‘পদ্মা সেতু’।

আর পাঁচ-দশটি ব্রীজের চাইতে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’ ভিন্ন। এটি কেবল পদ্মা নদীর উপর সব চাইতে বড় সেতু তা নয়। এটি গঙ্গা নদীর উপর যত সেতু আছে তার চাইতে বড়। ভিন্ন এই কারণেও যে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এবং তা হয়েছে সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশের জনগণের অর্থায়নে, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে। কোন বিদেশী সংস্থার অর্থায়ন বা কোন দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক তহবিল সংস্থা এই সেতু নির্মাণে কোন ভূমিকা রাখেনি। এটি চীনের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগের (বি আর আই) অংশ নয়, যা নিন্দুকের কেউ কেউ বলে বেড়িয়েছিলেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে কেবল বাংলাদেশী ও বিদেশী নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলি প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত ছিল। চায়না রেলওয়ে লিমিটেডের অধীনে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি মূল সেতু নির্মাণের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল এবং লিংক রোডের জন্যে চীনের সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর শুরু হয় সেতু নির্মাণ কাজ এবং কথা ছিল ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর কাজ শেষ হবে। সেটি হয়নি। কয়েক দফায় নানা কারণে এই সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।

ভাবতে ভালো লাগে এটি পৃথিবীর ১১তম দীর্ঘতম সেতু। চালু হবার পর এই সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্ত করার যে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন তা পূরণ হবে। রাজধানী ঢাকার ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে নির্মিত এই সেতু মাওয়া, লোহজং, মুন্সিগঞ্জকে দক্ষিণ প্রান্তে জাজিরা, শরীয়তপুর, শিবচর ও মাদারীপুরের সাথে সংযুক্ত করেছে। এর ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক যোগাযোগের প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হবে। বলা বাহুল্য, একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নে যোগাযোগ-ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপযুক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে ফসল-উৎপাদনকারী সে তার প্রকৃত মজুরী থেকে থাকে বঞ্চিত। সাধারণ জনগণকেও পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। আশা করা হচ্ছে বহু-প্রতীক্ষিত এই পদ্মা সেতু চালু হবার পর দেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষ আর আগের মত অবহেলিত থাকবে না। পদ্মা সেতু এমন সময় উদ্বোধন করা হচ্ছে যখন দেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সমপ্রতি যথার্থই বলেছেন, ‘আমি মনে করি পদ্মা সেতু এমন সময় উদ্বোধন করতে যাচ্ছি যখন বন্যা শুরু হয়ে গেছে। এই বন্যা দক্ষিণাঞ্চলেও যাবে। সে সময় পণ্য পরিবহন, বন্যা মোকাবেলা, বন্যার সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের সহযোগিতা করার একটা বিরাট সুযোগ আমাদের আসবে। বর্ন্যাতদের রিলিফ দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ খাদ্য সরবরাহ আরো সহজতর হবে।’ উল্লেখ করা যেতে পারে, একনেক ২০১১ সালে প্রকল্পটির জন্য ২০,৫০৭.২০ কোটি টাকা সংশোধিত ব্যয় অনুমোদন করে। ২০১৬ সালে এর ব্যয় পুনরায় ৮,২৮৬ কোটি টাকা বাড়ালে মোট ব্যয় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ২৮,৭৯৩.৩৯ কোটি টাকা। সেতুর জন্যে সরকারকে ২,৬৯৩.২১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সেতু বাবদ মোট খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৩০,১৯৩.৩৮ কোটি টাকা।

আজ সকাল (২৫ জুন) দশটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পদ্মা সেতু’ মাওয়া পয়েন্টে উদ্বোধন করবেন এবং সেতু পার হয়ে মাদারীপুরের জাজিরায় এক সভায় বক্তব্য রাখবেন। সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন। দিন কয়েক আগে সেতুর সব কটি বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠলে পুরো এলাকায়, নদীর বুকে এক অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি করেছিল। দেখে মনে হয়েছিল কোন শিল্পীর তুলির অপরূপ কাজ। বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়ায় দেখা যায় অনেকের উচ্ছ্বাস, উল্লাস, কবিতা, গান। গোটা দেশ যে আনন্দ উৎসবে মেতেছে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

শেখ হাসিনার এই সাফল্য আগামী নির্বাচনেও হয়তো ‘ইতিবাচক ‘প্রভাব রাখতে পারে। বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে চলছে নানা ‘খেল’। সমালোচকরা বলেন, শ্রীলংকার মত অনেক অনুন্নত দেশ চীনের কাছে ঋণের কারণে বাঁধা পড়ে আছে। তাদের আশংকা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সে-পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমরা যদি বিগত ১৪ বছরের শেখ হাসিনার শাসনামলের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই তিনি চারিদিক সামাল দিয়ে কাজ করেছেন অতি দক্ষতার সাথে।

গত দুই যুগের বেশি সময়ে তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছেন সবার জন্য, কোন নির্দিষ্ট একটি দেশ বা বলয়ের জন্যে নয়, এমন কি প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের ক্ষেত্রেও নয়। চীন, জাপান, ভারত, রাশিয়া – এই সবকটি দেশ আমাদের নানা উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। যেমন পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে একটি চৈনিক কোম্পানি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি করেছে রাশিয়া, রামপালে মৈত্রী থার্মাল প্রকল্পটি ভারতের এনটিসিপির সাথে যৌথ উদ্যোগে, ঢাকা মেট্রো রেল জাপানের সহায়তায়, এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগের জন্যে একটি চীন কোম্পানি চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ করছে, ঢাকা বিমানবন্দরের কাজ হচ্ছে জাপানীদের অর্থায়নে, আংশিকভাবে পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করবে চীন কোম্পানি এবং বেলজিয়ামের একটি কোম্পানি করছে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল ড্রেজিংয়ের কাজ। শেখ হাসিনা ভূ-রাজনীতি বা যা আমরা ইংরেজিতে বলি, ‘জিয়ো-পলিটিক্স সম্পর্কে সচেতন এবং ইতিমধ্যে বহিঃবিশ্বের সাথে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়ক-সূচক বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন। বলা বাহুল্য, তার এই দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে হেনরি কিসিঞ্জার-বর্ণিত ‘বটমলেস বাস্কেট’ বাংলাদেশকে তিনি একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন। কেবল এতদ অঞ্চলেই নয়, বিভিন্ন উন্নয়ন-সূচকে তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘মডেল’ রাষ্ট্র হিসাবে দাঁড় করাতে সফল হয়েছেন। তাতে বাংলাদেশী হিসাবে সবার গর্ব বোধ করার কথা।

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বপ্নের পদ্মা সেতু
পরবর্তী নিবন্ধসাহস ও সততার পদ্মা সেতু স্বপ্নসারথি শেখ হাসিনা