হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৮ জুন, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

‘অসম্ভবের’ সাথে এক পিতার হেরে যাবার লড়াই

‘সম্ভবের’ সাথে লড়াইয়ে জেতার একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ‘অসম্ভবের’ সাথে লড়াইয়ে? তাতে কেবল লড়াই হয়, জেতা হয়না। সে একেবারে অসম্ভব। তারপরও মানুষ কখনো-সখনো অসম্ভবের সাথে লড়াই করে, লড়াই করে জিততে চায়। বাঁচতে চায়, বাঁচাতে চায় প্রিয়জনকে। জেতা সম্ভব নয় জেনেও। ‘জিততেও তো পারি’- এই ক্ষীণ আশা নিয়ে মানুষ লড়াই করে চলে অসম্ভবের সাথে। এই অসম্ভবের সাথে লড়াই করতে দেখেছি আমার দীর্ঘদিনের একসাথে কাজ-করা সাংবাদিক বন্ধু মনসুরকে, পুরো নাম ওসমান গনি মনসুর। মনসুরের সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ‘তুই-তোকারি’ পর্যায়ের। সেই ঊনাশি সাল থেকে, যখন ডেইলী লাইফে যোগ দেয়ার মধ্যে দিয়ে আমার সাংবাদিকতা শুরু। যদ্দুর মনে পড়ে হ্যাংলা-পাতলা গড়নের সুদর্শন ও সদা-হাস্যমুখ মনসুরকে প্রথম দেখি লালদীঘি মাঠে ঢাকা থেকে আসা কোন এক রাজনীতিবিদের জনসভা ‘কভার’ করতে গিয়ে। চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রথম যে ‘রিপোর্টার্স স্ট্যান্ডিং কমিটি’ গঠন হয় তার প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিল মনসুর এবং আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক। সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচনে মনসুর ছিল বিপক্ষ-প্যানেলে। আমি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বে তাতে চির ধরেনি। মনসুর তখন দৈনিক স্বাধীনতায়। এরপর দৈনিক ইত্তেফাক, তারপর তো তাকে আর ধরা-ছোঁয়া যায়নি। চট্টগ্রামের লিডিং রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাকের মত জাতীয় দৈনিকে প্রথম পাতায় কয়েক কলামে ‘বাই-লাইনে’ প্রায়শ নিউজ বেরোয় মনসুরের। এরপর তো সম্পাদক।

কিন্তু সম্পাদক যখন হয়নি, যখন মনসুর একজন ‘জাঁদরেল’ রিপোর্টার, তখন একটা সময় দেখেছি তার মাঝে এক অসহায় পিতার আকুল আঁকুতি, মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত তার একমাত্র পুত্র সন্তান মাত্র বার বছর বয়েসী, রাফির জন্যে। রাফির জীবনের শেষ মুহূর্তে দূর থেকে, মনসুর ও তার ডাক্তার স্ত্রী রওনক জাহান মিনু যখন সিঙ্গাপুর হাসপাতালে, মনসুর উন্মাদের মত এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করেছিল, রাফির জন্যে ম্যাচ-করে তেমন কোন বোনম্যারো পাচ্ছিল না, সেই সময় সিঙ্গাপুর থেকে ফ্যাঙ পাঠিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিল একটু চেষ্টা করতে। মোবাইল ছিলনা সে সময়। একমাত্র ভরসা ফ্যাক্স, টেলিফোনে এক মিনিট বাংলাদেশে কথা বলতে গেলে কম করে পাঁচশ টাকা, তাও কোন টেলিফোনের দোকান থেকে করলে। ল্যান্ডফোন থেকে আকাশছোঁয়া। সহধর্মিনী সুমনা কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ খবর নিয়েছিল। লন্ডনের জনমত পত্রিকায় বোনম্যারোর জন্যে আবেদন জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। সে সময় হল্যান্ডের প্রথম রাষ্ট্রদূত ড. তৌফিক আলী সাহেবের সাথেও পরামর্শ করেছিলাম দূতাবাসে গিয়ে। তিনিও চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলনা। পজিটিভ কিছুই মিললো না। মনসুর বাদ রাখলো না। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিতে লাগলো, যদি কোথাও পাওয়া যায়, সেই ক্ষীণ আশায়। মিললো না। রাফি চলে গেল। চিরতরে। সবাইকে কাঁদিয়ে। এমন কী এই যে আমি, যে আমি কোনদিন রাফিকে দেখিনি সেই আমিও মনের-দেখায় দেখা রাফিকে ভেবে চোখের জল ফেলেছি। ‘প্রত্যেক জন্ম আলিঙ্গন করে নেবে মৃত্যুকে’ -এ অবধারিত সত্য।

কিন্তু যে মৃত্যু অসময়ে দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হয়, তাকে কী করে মেনে নেয়া যায়। চোখের সামনে সন্তানকে কষ্ট পেয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখার মত কষ্টকর অভিজ্ঞতার মত আর বড় কোন কষ্টকর-অভিজ্ঞতা মা-বাবার নেই। মনসুর ও তার স্ত্রীকে সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যে যেতে হয়েছে।
রাফির চলে যাবার পর তাকে নিয়ে লিখেছিলাম দৈনিক আজাদীর এই পাতায়, আজ থেকে ২৫ বছর আগে, নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। রাফি বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৩৭ বছর। টগবগে এক তরুণ। আজ এতগুলি সময় পেরিয়ে নতুন করে রাফির কথা মনে এলো মনসুরের লেখা, ‘অসম্ভবের সাথে লড়াই’ বইটি হাতে আসার পর। সপ্তাহ কয়েক আগে দেশ থেকে ফিরে এসেছে শ্যালিকা পূরবী। বন্ধু ড. সেলিম চৌধুরীর (চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান) কাছে মনসুর আমার জন্যে পাঠিয়েছিল তার লেখা সদ্য প্রকাশিত দুটি বই। আর একটি হলো, ‘বৃক্ষ’। আরো দুটি বই পেয়েছিলাম একই সাথে। পাঠিয়েছিলেন আর এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু, এম নাসিরুল হক। নাসির ভাইয়ের লেখা দুটি বই, ‘হংসমিথুন’ এবং ‘গণতন্ত্র উন্নয়ন ও বাংলাদেশ’ পূরবীর হাত ধরে পেয়েছি। প্রথম রাতেই ‘অসম্ভবের সাথে লড়াই’ অনেকটা রুদ্ধশ্বাসে পড়েছিলাম। পড়ছি আর যেন স্পষ্ট দেখতে পারছি সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ১২ বছরের কিছুদিন আগেরও একটি প্রাণোচ্ছল ছেলে মরণ যন্ত্রণায় শুয়ে আছে, অপেক্ষা মৃত্যুর। বইটি পড়েছি আর চোখ ভিজিয়েছি বার কয়েক। মনসুরের বর্ণনায় -”আমরা কাঁদছি, রাফি অবিচল।

অবশ্য কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দৃঢ়তা আছে। জানতে চাইলাম, ব্যথা আছে কিনা, কষ্ট হচ্ছে কিনা, সে বললো না-তো। আমাকে বলে, কেঁদো না, কাঁদলে আমিও কাঁদবো।” এইখানে এসে চোখের জল আক্ষরিক অর্থে থামাতে পারিনি। দ্বিতীয়বারের মত রাফির জন্যে কাঁদলাম আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম সৃষ্টিকর্তার কাছে- ‘রাফিকে ভালোভাবে রেখো। এই পৃথিবীতে সে কষ্ট পেয়েছে। তোমার কাছে যেন সে আর কষ্ট না পায়’। এই যে লিখছি কেন জানি চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। মনসুরের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে আমি পিতা হিসাবে আর এক পিতার সে সময়কার, সেই মুহূর্তের কষ্ট, ব্যাথা কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারি। আরো কয়েকটি স্থানে চোখের জলকে ধরে রাখতে পারিনি। যেমন, ”বাম হাতের কব্জির আইভিতে ইনজেকশন চলছে। ইনজেকশন শেষ হলো। রাফির একটু ঝিমিয়ে পড়ার ভাব এলো, একটু শান্ত। ….আমার মনে হলো- এবার হয়তো আরো কিছু সময় তাকে পাবো। রুমে পিনপতন নীরবতা চলছে। তারপর আরো কয়েক সেকেন্ড কাটলো। হঠাৎ – হঠাৎ তার আধামুষ্টি হাত ঝটকার মতো খুলে গেল। মুহূর্তেই আমরা বুঝতে পারলাম রাফি আর নেই। এ পৃথিবীর আলো তার চোখে লাগছে না। বাতাস তার শ্বাস প্রশ্বাসের কাজে আসছেনা। কারো ছোঁয়ায় তার সাড়া লাগবে না। সাথে সাথে আমি আর্ত চিৎকারে লুটিয়ে পড়লাম।” কী বেদনাদায়ক মুহূর্ত! মনসুর তার অপূর্ব লেখনীর মধ্যে দিয়ে আমাদের, পাঠকদের কাঁদিয়েছে বার বার। সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসায় মা-বাবা কী না করতে পারে। বিশ্বাস নেই, তারপরও যে ক্ষীণ আশার কথা বলেছিলাম, সে আশায় মনসুর গিয়েছিল তার বর্ণনার ‘ঢাকার একটি সংকীর্ণ গলির মধ্যে চার তলা পুরানো ঘিঞ্জি ভবনে। …ছেলের জীবনের জন্যে জন্য আমি সব কিছুই বিশ্বাস করতে রাজি। তাই এসেছি। শুধু এখানেই নয়, অনেক পীরের দরগাহ-দরবারে গিয়েছি। আরো যাবো।’ কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে রাফি চলে গেল না-ফেরার দেশে।

অনেকেই ভেঙে পড়ে। মনসুর যথার্থই লিখেছে- ‘জাগতিক নিয়মেই এক সময় শোক-আহাজারির উত্তাপ প্রশমিত হতে থাকে’। শোককে পাথরে পরিণত করে মনসুর ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অক্লান্ত ত্যাগ আর পরিশ্রমের ফসল, ‘ক্লাস’, ‘চিলড্রেন লিউকেমিয়া এসিস্টেন্স এন্ড সাপোর্ট সার্ভিসেস’ গড়ে তুলেছে। তার হাত দিয়ে গড়ে উঠা এই সেবা-প্রদানকারী সংগঠনের কারণে নব্বইয়ের দশকে মনসুর হল্যান্ড এসেছিল। তখন এখানকার জনা কয়েক প্রবাসী বাংলাদেশিকে বাসায় ডেকে মনসুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চাঁদা দিয়ে ‘ক্লাসের’ সদস্য হয়েছিল। মনসুর এর আগে ও পরে বার দুয়েক হল্যান্ড এসেছিল। আমার বাসায় উঠেছিল। প্রথমবার সে যখন হল্যান্ড এলো তার সাথে এসেছিলেন তার এক বন্ধু, সফল গার্মেন্টস-ব্যবসায়ী বনে যাওয়া ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপ কুমার দত্ত ও তার স্ত্রী ডাক্তার অঞ্জনা ডাক্তার। সবাই উঠেছিল আমার বাসায়। আড্ডা হয়েছিল রাতভর। এরপর তো প্রদীপদা বন্ধু বনে গেলেন এবং দেশে গেলে হয় চিটাগাং ক্লাব নয়তো সিনিয়র্স ক্লাবে তার সৌজন্যে আহার-পানীয়ের সাথে আড্ডা অবধারিত। মনসুরের কাছে আমি ঋণী। সে যখন হল্যান্ড এসেছিল নিজে উদ্যোগী হয়ে তাদের নিজস্ব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার লেখা বাছাই করে বই বের করার প্রস্তাব রাখে। তাকে আমি বলিনি। সে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ না নিলে হয়তো আমার প্রথম বই, ‘ইউরোপ থেকে’ দিনের আলো দেখতে পেত না। হয়তো এরপর যে কটি বই প্রকাশ পেয়েছে তা প্রকাশেও উৎসাহিত হতাম না। তড়িঘড়ি করে আমি লেখাগুলি কেবল তার হাতে দিয়েছিলাম। বাদবাকি সব করেছিল মনসুর ও আমাদের এক ‘কমন’ বন্ধু, শফিকুল আলম খান (বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাক্তন পরিচালক)।

ফিরে আসি রাফিতে। যেমন করে, কী অবাক করা, যেদিন রাফি সবাইকে কাঁদিয়ে এই পৃথিবীর সমস্ত মায়াকে জয় করে চিরদিনের তরে বিদায় নিলো, তার ঠিক এক বছর পর, একই দিনে মনসুর ও তার স্ত্রী রওনক জাহানের জীবনে এলো নতুন সন্তান। নাম রাখা হলো, ‘ফিরা’। রাফি নামকে উল্টো দিক থেকে লিখলে হয় ‘ফিরা’। ‘ফিরা’-র মাঝেই কি তবে ফিরে এলো ‘রাফি’? জানিনা। যা জানি তা হলো, ‘ট্র্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’। রাফি ও ফিরা – দুজনের জন্যে রইলো প্রার্থনা ও অফুরন্ত ভালোবাসা।

লেখক : সাহিত্যিক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভিক্ষাবৃত্তি মানুষকে অকর্মণ্য বানাতে সাহায্য করে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রস্তাবিত বাজেট বিতর্কমুক্ত থাকুক