রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘আশ্বাসের’ উপর পশ্চিমা বিশ্ব দ্বিধা ও সংশয়–জড়িত ‘বিশ্বাস’ রেখেছিল। এখন তার খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেন, ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ। গোটা দেশ রুশ–আক্রমণে ধ্বংসপ্রায়। ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, রেল স্টেশন, তেল ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, কল–কারখানা, রাস্তা–ঘাট, সড়ক, কালভার্ট– মোটকথা একটি দেশকে ধ্বংস করার যত উপায় আছে কোনটাই বাদ রাখেনি রাশিয়া। নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে শিশু, নারী, বৃদ্ধ–বৃদ্ধা। গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে ইতিমধ্যে। রুশ সেনাবাহিনীর হাতে তরুণী, নারী ধর্ষিত হবার ঘটনাও ঘটেছে বলে পত্র–পত্রিকায় প্রকাশ। দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে কোটির মত লোক। অনেকে এখনো আটকা পড়ে আছে মাটির নীচে বাংকারে। পুতিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ ও মহল থেকে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যে পুতিনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে বলেন, ‘পুতিন একজন হত্যাকারী, তাকে এর মাশুল দিতে হবে’। ইউক্রেন আগ্রাসনের আগে বেঁটে–খাটো রুশ গোয়েন্দা বাহিনী, কেজিবির প্রাক্তন এজেন্ট পুতিন বলেছিলেন, ‘ইউক্রেন বর্ডারে রুশ সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে স্রেফ সামরিক মহড়া চালানোর জন্যে, ইউক্রেন আক্রমণ করার কোন পরিকল্পনা রাশিয়ার নেই।’ তিনি রুশ সেনা মোতায়েন করেছিলেন বেলেরুশেও। তার এই ‘যুদ্ধ–যুদ্ধ’ আয়োজন দেখে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বলেছিল এই সমস্ত আয়োজন গ্রেফ ইউক্রেন আক্রমণ করার পাঁয়তারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত কোন কোন দেশ শুরুতে বিষয়টাকে খুব একটা সিরিয়াসলি নেয়নি। অন্যদিকে রুশ–প্রেমিকদের অনেকেই বাইডেনের আশংকাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর এই দাবি সঠিক নয়। তাদের যুক্তি রাশিয়ার অধিকার রয়েছে তাদের সীমানায় নিজ সেনা মোতায়েন করার। দাবি সঠিক। কিন্তু তার পেছনে যে ‘ওয়ার–মঙ্গার’ বা ‘যুদ্ধবাজ’ পুতিনের ভিন্ন অভিসন্ধি ছিল তা তারা ঠিকমত ও সময়মত বুঝে উঠতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে আজকের রাশিয়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজকের রাশিয়ায় গণতন্ত্র বলতে কিছু নেই। পুতিন–সরকারকে স্বৈরাচার সরকার ছাড়া আর কোন বিশেষণে আখ্যায়িত করা যায় কিনা জানিনে। পুতিনের বিরুদ্ধে যেই দাঁড়িয়েছে, তার অন্যায়, অপকর্মের বিরুদ্ধে যে কথা বলেছে, তাদের হয় হত্যা করা হয়েছে বিষ প্রয়োগে, কিংবা বিরোধী নেতা আলেক্সই নাভালনির মত মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ভরানো হয়েছে। প্রতিবাদী কণ্ঠকে যে কেবল দেশেই স্তব্দ করা হয়েছে তা নয়, বিদেশের মাটিতেও গোয়েন্দা লাগিয়ে হত্যা করার ঘটনা সে আমরা পত্র–পত্রিকায় সামপ্রতিক সময়ে দেখেছি, যদিওবা রুশ সরকার ও পুতিন এই সমস্ত ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রাশিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ১৫.৪০০ রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিরপেক্ষ সংবাদ পত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক ইতিমধ্যে রাশিয়া ত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেখানে বসে রুশ ভাষায় সত্যিকার ঘটনা প্রকাশ করে চলেছেন, যাতে তাদের দেশের (রাশিয়া) জনগণ সত্যিকার পরিস্থিতি জানতে পারেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুতিন সব চাইতে ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা করলেন ইউরোপে, ইউক্রেন আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকে এই পর্যন্ত ইউরোপ এমন অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তায় ভুগেনি। অনেকেই প্রশ্ন করেন, পুতিন কেন এমন কাজটি করলেন। কী তার অভিসন্ধি? পুতিন এই বলে তার এই আগ্রাসনকে ‘জায়েজ’ করতে চাইলেন যে, পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে–পড়া ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হয়ে পড়েছে। সেটি একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়। তাই বলে এক সময় ইতিহাসের বিবর্তনে বিশাল সোভিয়েত সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রগুলিকে আবার করায়ত্ত করার অলীক ও অবাস্তব স্বপ্ন দেখা এবং সেই অবাস্তব স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে কেবল ইউরোপ নয়, গোটা বিশ্ব–নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে কেউ বা কোন দেশ, হোক না সে যত শাক্তিশালী, ঠেলে দেবে সে তো কিছুতেই সমর্থনযোগ্য ও গ্রহণীয় নয়। রুশ নেতা তার এই ইউক্রেন–আগ্রাসনকে একটি ‘মহৎ লক্ষ্য’ বা ‘নোবেল কাজ’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি এই আক্রমণকে ‘আগ্রাসন’ কিংবা ‘যুদ্ধ’ বলতে গররাজি। পুতিনের যুক্তি– ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের অধিকাংশ রুশ এবং ইউক্রেন তাদের প্রতি অবিচার করে চলেছে। যদি তাই হয়ে থাকে তার জন্যে জাতিসংঘ রয়েছে, সেখানে যাওয়া যেত। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো হয়তো সম্ভব হতো।
ফিরে আসি শুরুর দিককার সময়ে। পুতিন ও তার সামরিক জেনারেলরা ধরে নিয়েছিলেন দিন কয়েকের মধ্যে ইউক্রেন নিজেদের দখলে নেবেন, জেলেনস্কির সরকারকে হটিয়ে ‘পুতুল সরকার’ বসাবেন। কিন্তু শুরু থেকে বিশাল রুশ বাহিনীকে এমন নাকানি–চুবানি খাওয়াবে তা পুতিন কিংবা তার সেনাপতিরা ‘ঠাহর’ দিতে পারেননি। যুদ্ধ ইতিমধ্যে দু–মাস পেরিয়ে গেছে। কেবল সেনাবাহিনী নয়, গোটা ইউক্রেনবাসী মরীয়া হয়ে লড়ে যাচ্ছেন তাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে। অন্যদিকে এই যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে পুতিন ততই তার ধৈর্য্য হারাচ্ছেন ও মরীয়া হয়ে উঠছেন। অনুমান করা হচ্ছে রাশিয়া সামনের দিনগুলিতে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। যদিও বা এমন সংবাদ প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ক্রেমলিন থেকে তড়িঘড়ি করে ঘোষণা দেয়া হয় যে রাশিয়ার এমন ধরনের কোন পরিকল্পনা নেই। কিন্তু কথা হলো ক্রেমলিন কিংবা পুতিনের কথায় কতটুকু বিশ্বাস রাখা যায়। তিনি তো বলেছিলেন ইউক্রেন আক্রমণের কোন পরিকল্পনা তার নেই। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি। ইউক্রেন ইতিমধ্যে এখন জনশূন্য হয়ে পড়েছে, রাজধানী কিভ ছাড়া। মার্কিন দূত মাইকেল কার্পেন্টারের মতে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে নাগাদ রাশিয়া লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে নিজ ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করতে পারে। দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় খেরসন শহরকে ‘গণ প্রজাতান্ত্রিক’ ঘোষণার মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। ইউক্রেন কিংবা এর পূর্বাঞ্চল দখল করার পরিকল্পনা পুতিনের হঠাৎ করে, তা ভাবার কোন কারণ নেই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে ইউক্রেন স্বাধীন হবার পর দেশটি পশ্চিমমুখী অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে। পুতিন চেয়েছিলেন এই পরিস্থিতি উল্টোদিকে মোড় নেবার। ইউক্রেনের দীর্ঘদিনের ইতিহাস অস্বীকার করে তিনি বলেন, রুশ ও ইউক্রেনবাসী এক জনগোষ্ঠী এবং তিনি এই স্বাধীন দেশটিকে ‘এন্টি রাশিয়া প্রজেক্ট’ হিসাবে মনে করেন। তিনি চাপ সৃষ্টি করেন ইউক্রেনের উপর এবং ২০১৩ সালে যখন তৎকালীন প্রো–রুশ প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করার উদ্যোগ নেন, তখন পুতিন তাকে বাধ্য করেন তা থেকে সরে আসতে। ইয়ানুকোভিচ চুক্তি থেকে সরে এলে দেশে শুরু হয় প্রতিবাদ এবং অবশেষে এই প্রতিবাদের মুখে ২০১৪ সালে পতন ঘটে প্রো–রাশিয়া সরকারের। বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের মুখে রাশিয়া নিজ দখলে নেয় ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের ক্রিমিয়া রাজ্য। শুরু হয় রুশ–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে ইউক্রেনের লড়াই, তাতে ১৪.০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে।
সবশেষে, সব শুরুর যেমন শেষ আছে ঠিক তেমনি ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া এই অসম–যুদ্ধও একদিন শেষ হবে। কিন্তু ততদিনে অনেক নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সরাসরি এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না, নেবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। সেটি হলে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে। ইউরোপীয়রা পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে তাদের মাটিতে। তারা আর এমন যুদ্ধ দেখতে চাননা। ইউক্রেন আরো ধ্বংস হবে, আরো অনেক ইউক্রেনবাসী মৃত্যুবরণ করবেন। পুতিন তার ‘গো’ ধরে থাকবেন। তাকে এই যুদ্ধ থেকে একটা–কিছু নিয়ে ফিরে যেতে হবে। তিনি যে শূন্য হাতে ফিরে যাবেন না তা নিশ্চিত। তাহলে তো তিনি নিজ জনগণের কাছে তার মুখ রাখতে পারবেন না। ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লের’ মত তিনি নিজেকে মনে করেন অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্ব মানুক আর নাই মানুক তার তাতে কিছু যায় আসেনা। ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই তার মুখ্য। তার স্বপ্ন– সোভিয়েত সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়া। সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হলে তাকে ইউক্রেনের মত আরো কটি আশপাশের দেশ করতলগত করতে হবে। পুতিন কি সেদিকে পা বাড়াবেন?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট