হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

ইমরান খানের ‘ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন’
ব্যাটে-বলে না মিললে যা হয়। হয় মাঠ থেকে প্যাভিলিয়নে ফেরা, না হয় ‘ওভার’ শেষে শূন্য রানে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়া। তাই ঘটেছে পাকিস্তানের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধান মন্ত্রী ইমরান খানের ক্ষেত্রে। বেস্ট ক্রিকেটার থেকে ‘কৌন বনেগা কৌড়পতির’ মত অল্পদিনের মাথায় রাজনৈতিক নেতা বনে যাওয়া ইমরান খানের রাজনৈতিক চালে ভুল ছিল। মারতে চেয়েছিলেন ‘ছক্কা’, কিন্তু হয়ে গেলেন ‘বোল্ড আউট’। বেচারা ইমরান! ক্রিকেট মাঠ গরম করেছিলেন এক সময়, ক্রিকেটে পাকিস্তানকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছেন। ক্রিকেট বয়, প্লে-বয় হিসাবে পরিচিত সুদর্শন ইমরান খান ক্ষমতায় বসার আগে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার দেশের ভাগ্যাহত জনগণকে। বড় গলায় বলেছিলেন, ৯০ দিনের মধ্যে দেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করবেন, জাতীয় রাজস্ব বিদেশী মুদ্রায় ভরিয়ে দেবেন, যে সমস্ত দুর্নীতিবাজ বিরোধী রাজনৈতিক নেতা বিদেশী ব্যাংকে অর্থ পাচার করেছেন তা ফেরত আনবেন। বড় গলায় আরো বলেছিলেন, পাকিস্তানের পাসপোর্ট হবে এমন একটি পাসপোর্ট যা সবার কাছে হবে কাঙ্ক্ষিত। বলেছিলেন, প্রয়োজনে আত্মহত্যা করবো কিন্তু কখনো আই এম এফ অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের কাছে ধর্ণা দেব না। পাকিস্তান হবে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য, চাকরির অভাব থাকবেনা, বিচার-ব্যবস্থা স্বাধীন হবে, সরকারি কর্মচারীরা নিয়োগ পাবে তাদের মেধা ভিত্তিতে। ‘নয়া পাকিস্তান’ তার ভাষায়, ‘দুধে-মধুতে ভেসে যাবে।’
জনগণকে তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ‘নয়া পাকিস্তানের’। কিন্তু ‘নয়া’ তো দূরের কথা, ইমরান খানের তিন বছরের বেশি সময়কার শাসনামলে পাকিস্তানের অর্থনীতি আরো পিছিয়ে গেছে। অথচ ক্রিকেট-মাঠ ছেড়ে রাজনীতির-মাঠে স্থান করে নিতে তিনি কম লড়াই করেননি। পাকিস্তানে কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকারী দুটি প্রধান দলকে পিছু রেখে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন, সক্ষম হয়েছিলেন জনতাকে তার জমায়েতে সামিল করতে, নিজের দল পি টি আই-কে একটি নতুন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসাবে দাঁড় করাতে। বিশ্বে দুর্নীতি তালিকায় এগিয়ে থাকা পাকিস্তানকে দুর্নীতি-মুক্ত করার যে আশ্বাসবাণী তিনি সাধারণ জনগণকে দিয়েছিলেন, তাতে জনগণ বিশ্বাস করেছিলেন। নির্বাচনে জিতে পাকিস্তানের ২২তম প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। কিন্তু দেখা গেল ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’। ইমরান খানের ক্ষেত্রেও তাই হলো। তিনি তার দেয়া আশ্বাসবাণী পূরণ করতে ব্যর্থ হলেন। যদিও বা কোভিড-পরিস্থিতি তিনি বেশ ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছিলেন। প্রশংসিত হয়েছিল তার মায়ের নামে নির্বাচনের আগে পাকিস্তানে আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণে।
এমন না যে ইমরান খানই পাকিস্তানের একমাত্র প্রধান মন্ত্রী যিনি মেয়াদ শেষ হবার আগেই ক্ষমতাচ্যুত হলেন। এর আগেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রীরা এমন পরিস্থিতির (অনাস্থা ভোট) সম্মুখীন হয়েছিলেন, তবে তারা টিকে গেছেন। ইমরান টিকলেন না। ইমরান খান পাকিস্তানের প্রথম প্রধান মন্ত্রী যিনি অনাস্থা ভোটে হেরে গিয়ে ক্ষমতা হারালেন সাড়ে তিন বছরের মাথায়। মূলত, ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হবার পর থেকে আজ অবধি বিগত ৭৫ বছরে পাকিস্তানের কোন সরকার প্রধান তার মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। জুলফিকার আলী ভুট্টো তিন বছর ১১ মাসের মাথায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন এবং জেনারেল জিয়াউল হক তাকে ১৯৭৯ সালে ফাঁসিতে ঝুলান। তার কন্যা বেনজির ভুট্টো দুই দফায় প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু তিনি প্রথমবার (১৯৮৮) মাত্র দুই বছর এবং দ্বিতীয়বার (১৯৯৬) তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরে যেতে বাধ্য হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় এসে মাত্র এক বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হন। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রথম প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ৪ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য। বারবার ঘুঘু এসে তার ধান খেয়ে গেছে, আর জনগণ অসহায়ের মত কেবল দেখেছে।
বলা হয়, পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বা ‘ফেইলড স্টেট’। গণতন্ত্র এই দেশটিতে নিজস্ব পথে এগুতে পারেনি। এগুতে দেয়া হয়নি। বারবার ফিরে এসেছে সামরিক জান্তা, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এবং ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ। সন্ত্রাসীদের ‘সেইফ-হ্যাভেন’ ছিল পাকিস্তান। সন্ত্রাসী বিন লাদেনের ঘাঁটি ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান এবং সন্ত্রাস অনেকটা ‘সিনোনিম’ হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান বলা চলে, একটি সামরিক-শাসিত রাষ্ট্র যা ৭৫ বছরের মধ্যে ৫০ বছর শাসিত হয়েছে সামরিক বাহিনী দ্বারা। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে বারবার সরকারগুলি। তাদের হয় সামরিক বাহিনীর কথা মত কাজ করতে হয়েছে কিংবা ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করতে হয়েছে। এর ব্যতয় ঘটলেই সরকার পতন। গণতান্ত্রিক সরকারগুলি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করতে চাইলেও সামরিক শাসকদের কারণে তা সম্ভব হয়নি। ফলে নির্বাচিত সরকারগুলি বাধ্য হয়েছে দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে লাগানোর পরিবর্তে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে। কিন্তু ইমরানকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো কেন? তাহলে কি তার প্রতি সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল না? ঠিক তা না, কেননা তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখনই বলাবলি হচ্ছিল যে ইমরান খান ক্ষমতায় আসতে পেরেছেন সেনা বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে। তার প্রায় সাড়ে তিন বছরের ক্ষমতাকালীন সময়ে সেনাবাহিনীকে দেখা গেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশটির কলকাঠি নাড়তে। আর এই কারণে অনেকে ইমরান সরকারকে একটি ‘হাইব্রিড সরকার’ হিসাবেও চিহ্নিত করেছিলেন। কারো কারো অভিমত, ইমরান সেনাবাহিনীর সৃষ্টি, তাদের সমর্থনে গড়া এবং তাদের দ্বারাই তার পতন। পাকিস্তানের ব্যাপারে একটি বিষয় পরিষ্কার, তা হলো, আপনি যতই জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসুন না কেন, সরকারের উপর যে ‘অদৃশ্য’ সরকার অর্থাৎ সামরিক এস্টাব্লিশমেন্ট বসে আছে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। ঘুড়ি যেই উড়াক না কেন, লাটাইটি তাদের দখলে। এর ওলট-পালট হলে আপনার গদি যাবে উল্টে। কেবল তাই নয়, ইমরানের শাসনামলে খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে হু হু করে, ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানী রুপির পতন ঘটেছে উল্লেখযোগ্য হারে। যদিও বা তার পক্ষের লোকজনের মতে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এর জন্যে অনেকটা দায়ী। ফলে এক সময় জনগণের মাঝে ইমরান-বিরোধী ক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং যেহেতু সাধারণের মাঝে এই বিশ্বাস ছিল যে তিনি সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট সেই কারণে সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধেও জনগণের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এছাড়া পাক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ও আই এস আই-প্রধান লে.জেনারেল ফাইজ হামিদের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব ইমরানের পতনকে ত্বরান্তিত করে বলে অনেকের ধারণা। সাধারণত পাকিস্তানে সেনা প্রধানের পরামর্শে অতি ক্ষমতাশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, আই এস আই-এর প্রধানের নিয়োগ দেন প্রধান মন্ত্রী। কিন্তু সেনা প্রধানের পছন্দের লোককে নিয়োগ দিতে ইমরান খান দেরি করছিলেন। সেখান থেকে ইমরানের সাথে সেনা বাহিনীর সম্পর্কের ফাঁটল, বলা চলে মধুরেণু সমাপেয়। এই সুযোগটা নিলো বিরোধী দলগুলি। তারা একাট্টা হয়ে ইমরান সরকারের পতনের দাবি জানাতে থাকে। অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়ে ১৭৪টি। ৩৪২ আসনের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবটি পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট। আর্থিক দুরবস্থা ও ভুল পররাষ্ট্রনীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবটি এনেছিল বিরোধী দলগুলো। এর পর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্যে ইমরান খান কিছু অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। বিরোধীদের উস্কে দিয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি দোষারূপ করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ তক তাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হলো। ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়েছে। এতে ইমরান-বিরোধীরা উল্লসিত। তবে গণতন্ত্রের জন্যে যে বিষয়টি সুখকর নয় তা বলা বাহুল্য। যাই হোক, ক্ষমতায় এসেছে নতুন সরকার। সামনে নির্বাচন। দেখা যাক পাকিস্তান রাজনৈতিক সংকট থেকে কবে উদ্ধার পায়। কারণ পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিকাশ না হলে তার নেতিবাচক প্রভাব এই অঞ্চলে পড়তে বাধ্য। সেটি যে কারো জন্যে সুখকর নয় তা বলা বাহুল্য।

লেখক : সাহিত্যিক, কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাত্তরের ১৬ এপ্রিল পটিয়ায় বোমা হামলা : গণহত্যার শিকার ২০ নারী-পুরুষ
পরবর্তী নিবন্ধসর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা : একটি মাঙ্গলিক উদ্যোগ; যার বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ