হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

গেল সংখ্যায় লিখেছিলাম ১৬শ ও ১৭ শ শতাব্দীতে ক্রীতদাস বাণিজ্যের মাধ্যমে ডাচ রাজপরিবার কি পরিমাণ লাভবান হয়েছিল এবং এই বাণিজ্য দিয়ে তারা তাদের সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির গোল্ডেন এইজবা স্বর্ণযুগের অর্থায়ন কীভাবে করেছিল। পাশাপাশি লিখেছিলাম কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে সমপ্রতি ডাচ রাজার ক্ষমা প্রার্থনা প্রসঙ্গে। তবে ক্রীতদাসবাণিজ্য যে কেবল ওলন্দাজরাই করেছিল তা নয়। ফরাসি, ব্রিটিশ, স্পেনিশ, ডেনিশ, পর্তুগিজ শাসকরাও এই বাণিজ্য করেছিল। আফ্রিকীয় ক্রীতদাসদের উপর যে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল সে ছিল বর্ণনাতীত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় চট্রগ্রাম শহরে চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে টানটান উত্তেজনা নিয়ে ইংরেজি ছায়াছবি রুটসদেখেছিলাম। মার্কিন লেখক আলেক্স হ্যালির ১৯৭৬ সালে লেখা উপন্যাস রুটস: দ্য সাগা অফ এন আমেরিকান ফ্যামিলিঅবলম্বনে তৈরী এই চলচিত্রের মূল চরিত্র কুন্তা কিন্তে। পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শোনা ঘটনার উপর ভিত্তি করে আলেক্স হ্যালি কুন্তা কিন্তের গল্প দাঁড় করান। উপন্যাসের বর্ণনা অনুযায়ী আনুমানিক ১৭৫০ সালে আফ্রিকীয় দেশ, গাম্বিয়ার মন্দিনকা গ্রামে কুন্তা কিন্তের জন্ম। কুন্তা কিন্তের বয়স যখন ১৭ তখন একদিন সে বনে যায় কাঠ খুঁজতে। সেই কাঠ দিয়ে সে তার ভাইয়ের জন্যে ঢোল বানাবে। এমন সময় চার শ্বেতাঙ্গ তাকে ধাওয়া করে ঘিরে ফেলে এবং বন্দী করে নিয়ে যায়। কুন্তা কিন্তে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে চোখ, মুখ বাঁধা এবং বন্দী অবস্থায় দেখতে পায়। তারপর তাকে এবং তার মত আরো অনেক আফ্রিকীয় ক্রীতদাসকে লর্ড লিগোনিয়ার নামে ক্রীতদাসজাহাজে করে উত্তর আমেরিকায় পাঠানো হয়। সেই ছবিতে দেখেছি আফ্রিকীয় ক্রীতদাসদের উপর কী চরম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। তবে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে পাঠানোর জন্যে ক্রীতদাস কেবল আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়নি। সংগ্রহ করা হয়েছিল এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ থেকেও।

) আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রীতদাস সংগ্রহ করে জড়ো করা হতো পশ্চিম আফ্রিকার দেশ, বেনিনের একটি স্থানে। ২০০ বছর ধরে বেনিনের শক্তিশালী রাজারা ক্রীতদাস বাণিজ্য করতো। ক্রীতদাসদের মধ্যে বিভিন্ন উপজাতির পুরুষ ছাড়াও মহিলা ও শিশু ছিল। কর্মসূত্রে ২০০৮ সালে আফ্রিকার এই দেশটিতে যাবার সুযোগ হয়েছিল। সপ্তাহ খানেক ছিলাম অতলান্তিক সাগর পাড়ের এই দেশটিতে। গিয়েছিলাম উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামনভিবের আমন্ত্রণে, ‘মাইক্রোফাইনেন্সসংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। হল্যান্ডের আরো ৮/১০টি প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ফিল্ড ট্রিপে একদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বেনিনের ওইদাহ‘ (OUIDAH) নামক একটি স্থানে, একেবারে অতলান্তিক সাগর ঘেঁষে। এটি পশ্চিম আফ্রিকার বৃহত্তম ক্রীতদাস বন্দর হিসাবে পরিচিত। আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি তপ্ত রোদে এসে থামলো কয়েক শত বছরের পুরানো বটবৃক্ষের মত এক বিশাল গাছের নিচে। গাছটিকে ঘিরে তৈরী করা হয়েছে পাথরের একটি বেদী। পাশে এক আফ্রিকীয় ক্রীতদাসের মূর্তি। ওই এলাকার আশপাশ থেকে এমন কী পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আফ্রিকীয় ক্রীতদাসদের হাতেপায়ে ও গলায় লোহার শেকল পরিয়ে ওই গাছের নিচে আনা হতো। তারপর দাম বিকানো হতো। আমাদের গাইড বলেন, ‘ইউরোপীয়রা একটি সিগারেটের বিনিময়ে কিংবা এক মুদ্রা, এমন কী একটি টুপির বিনিময়ে কিনে নিতো ক্রীতদাসকে। কেনা বেচার পালা শেষ হলে তাদের চোখ বেঁধে ত্রিশ বার এই গাছটির চৌদিকে প্রদক্ষিণ করানো হতো। তারপর মাইল দেড়েক মাটির পথ হাঁটিয়ে হাজির করানো হতো সমুদ্রের পাড়ে।আমরাও এক পর্যায়ে হেঁটে এলাম সেই স্থানে, যেখানে এক সময় জাহাজ ভিড় করতো। জাহাজে উঠানো হতো শেকলবাঁধা ক্রীতদাসদের। আমাদের সাথে থাকা মেক্কা আব্দুল্লাহ এক পর্যায়ে অঝোর ধারায় শব্দহীন কাঁদতে থাকে। সুদানে জন্ম নেয়া এই মহিলার বর্তমান স্থায়ী আবাস হল্যান্ড। হেগ শহরের ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজ (আই এস এস) থেকে পিএইচডি করেছেন। কাছে গিয়ে মেক্কাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি। ভেজা দুচোখ নিয়ে সে বলে, ‘আমি তো এই ক্রীতদাসদেরই এক উত্তরসূরি। আমার পূর্বপুরুষদের কী অমানবিকভাবে এখান থেকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, কী অমানুষিক যন্ত্রণা ও কষ্ট তারা ভোগ করেছে সেটা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে পড়েছে।বাস্তবিক তাই! পাশেই যে মিউজিয়াম, সেখানে ক্রীতদাসদের উপর অত্যাচারের সচিত্র প্রতিবেদন দেয়ালে সাঁটানো। তা দেখে আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে পড়ে। যাই হোক

) সময় এগিয়ে চলে। কয়েক শতাব্দী পর ১৮৬৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর ১৩তম সংশোধনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অংশ হিসাবে গৃহীত হয় এবং এই সংশোধনী আনুষ্ঠানিকভাবে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে। তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকার অঙ্গরাজ্য কেনটাকি থেকে ডেলাওয়্যার পর্যন্ত এক লক্ষেরও বেশি ক্রীতদাসকে মুক্তি দেয়া হয়। এর আগে ১৮৬৩ সালে ডাচরা সুরিনাম এবং অন্যান্য ডাচঅধিকৃত অঞ্চল থেকে ক্রীতদাস প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে। এদিকে ১৮৮৫ সালে বার্লিনসম্মেলনে নেয়া সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয়রা ভাগাভাগি করে নেয় গোটা আফ্রিকাকে। কে কোন রাজ্য নিজ দখলে নেবে এই প্রতিযোগিতায় নামে তারা। পর্তুগাল নিজেদের দখলে নেয় এংগোলা, বেলজিয়াম নেয় কঙ্গো, ব্রিটেন নাইজেরিয়া, ফ্রান্স নেয় পশ্চিম আফ্রিকার বৃহদাংশ। পরবর্তীতে অনেক দেশ গুটিয়ে নেয় তাদের শাসন। যদিওবা পরোক্ষ শাসন বা প্রভাব এখনো দৃশ্যমান অনেক দেশে। কী ভাষা, কী সংস্কৃতি, পোশাক, আচরণ এমনকী স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও।আফ্রিকা ও এশিয়ার যে সমস্ত দেশে ওলন্দাজরা ঘাঁটি গেড়েছিল, যে দেশগুলিকে শাসন ও শোষণ করেছিল, সেখান থেকে তারা হয় নিজ থেকে সরে আসে, নয়তো প্রতিরোধের মুখে তাদের সরে আসতে হয়। তেমন একটি দেশ সুরিনাম। প্রায় ৩০৮ বছর শাসন ও শোষণ করার পর ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর সুরিনাম স্বাধীন হলে, সুরিনামের প্রায় ৫০% জনগণ ডাচ সরকারের দেয়া হল্যান্ড চলে আসার অপশনগ্রহণ করে। যেহেতু তারা (সুরিনামী জনগণ) দীর্ঘ সময় ডাচ শাসনাধীন ছিল, তারা ডাচ ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সহজে মিশে যেতে সক্ষম হয়। এই প্রসঙ্গে সমপ্রতি কথা হচ্ছিল সুরিনামী সমপ্রদায়ের হল্যান্ডে তৃতীয় প্রজন্মের একজন, সুধীর নান্নানের সাথে। মেধাবী ও আই টি এক্সপার্ট এই তরুণ এক সাক্ষাৎকারে বলে, সুরিনামের জমিজমা বিক্রি করে তার বাবা হল্যান্ড চলে আসেন। এসে সেই টাকায় হেগ শহরে দুটো বাড়ি কেনেন। ভাষাগত কারণে তার বাবার চাকরি পেতে অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া তখন ডাচ সরকার সুরিনাম থেকে আসা সবাইকে চাকরি, বাসস্থান সহ সমস্ত সুবিধা প্রদান করে। সুধীর বলে, মজার ব্যাপার হলো, সুরিনামে বিভিন্ন জাত, ধর্ম, বর্ণের লোকের বসবাস। সেখানে যেমন রয়েছে ভারতীয় হিন্দু ও মুসলিম সুরিনামিজ, তেমনি রয়েছে চৈনিক, ইন্দোনেশীয় সুরিনামিজ। রয়েছে বিভিন্ন আফ্রিকীয় গোষ্ঠীর সুরিনামীজও। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এর উপর ভিত্তি করে ডাচ সরকার ১৯৭৫ সালে হল্যান্ড চলে আসা সুরিনামীদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়। সুধীর নান্নান আরো জানায়, স্বাধীনতার পর যে সমস্ত সুরিনামিজ হল্যান্ড চলে আসে তাদেরকে নিজ দেশে বিশ্বাসঘাতক বা দেশপ্রেমিক নয় বলে সমালোচনা করা হতো। তাদের লক্ষ্য করে তারা বলতো, ‘তোমরা তো হল্যান্ড গেছো সরকার থেকে ভিক্ষার উপর নির্ভর করে বাঁচার জন্যে।অন্যদিকে যারা হল্যান্ড চলে আসেন তারা সুরিনামে থেকে যাওয়া স্বদেশীদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তোমরা আছো দুর্নীতিকে নিয়ে। আমরা দুর্নীতি থেকে বাঁচতে চলে এসেছি।মজার ব্যাপার হলো, এই নিয়ে দুই দলেরই রয়েছে একে অপরকে আক্রমণ করে রচিত নিজস্ব গান, অনেকটা পালা গানের মত। হল্যান্ডে সুরিনামি সমপ্রদায়ের মধ্যে ভারতীয় হিন্দু সমপ্রদায়ের জনগণ ভালো সামাজিক অবস্থানে রয়েছে। ডাচ রাজনীতি থেকে শুরু করে ওকালতি, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো অবস্থানে রয়েছে তারা। তাই বলে সুরিনামি অন্যান্য গোষ্ঠীগুলি যে ভালো অবস্থানে নেই তা নয়। সুরিনামী ছাড়াও হল্যান্ডে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু ডাচ জনগণের কাছে সুরিনামি জনগণ বেশি গ্রহণীয় ও পছন্দের। কেননা তারা মূল স্রোতধারার সাথে মিশে গেছে, তবে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে। এমন কী অনেক আফ্রিকীয় গোষ্ঠীও মূল স্রোতধারার সাথে অনেকটা মিশে গেছে। অন্যদিকে তুরস্ক, মরোক্ক, সিরিয়া এমনতর দেশ থেকে আসা বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। তবে ভালো দিক হলো এদেশে আন্তঃগোষ্ঠীর মধ্যে কোন বিভেদ বা কলহ নেই। তোমারটা তুমি করো, আমি থাকি আমার বিশ্বাস নিয়েঅনেকটা এই বোঝাপড়ার মধ্যে সমপ্রীতি টিকে আছে বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মধ্যে। (২৫১২২০২৫)

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছোটো কাগজ শিশুসাহিত্য : নবীন-প্রবীণ লেখকের সমাহার
পরবর্তী নিবন্ধব্র্যান্ড পার্সোনালিটির আত্মহত্যা: ছোট ভুলে বড় বিপদে পড়তে পারে যে কোনো ব্র্যান্ড