ক্রীতদাস প্রথা ১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীতে রমরমা ব্যবসা ছিল। যদিও বা এর শুরু খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সাল থেকে। প্রাচীন বিশ্বে ইউরোপ, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথা বা ‘স্লেইভারি‘ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময়ে আইন পাশ করে ‘ক্রীতদাস প্রথা‘ নিষিদ্ধ করা হলেও এই অমানবিক প্রথা এখনো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। ওলন্দাজরা ১৬ এবং ১৭শ শতাব্দীতে ক্রীতদাস ব্যবসার মাধ্যমে তাদের সাম্রাজ্য ও সংস্কৃতির ‘গোল্ডেন এইজ‘ বা ‘স্বর্ণযুগের‘ অর্থায়ন করেছিল। ক্রীতদাস ব্যবসার অংশ হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে প্রায় ছয় লক্ষ আফ্রিকান ক্রীতদাস পাঠিয়ে ওলন্দাজরা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। আর এতে সব চাইতে বেশি লাভবান হয়েছিল ডাচ রাজপরিবার ও এর সদস্যরা। এই প্রসঙ্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ক্রীতদাস প্রথায় রাষ্ট্রের ‘ইচ্ছাকৃত, কাঠামোগত এবং দীর্ঘমেয়াদী সম্পৃক্ততা‘ হিসাবে যা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে বর্তমান রাজার পূর্ব পুরুষরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিলেন। ২০২৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় জানা যায়, এই ব্যবসা থেকে ডাচ রাজ পরিবার ১৬৭৫ সাল থেকে ১৭৭০ সালের মধ্যে তাদের উপনিবেশগুলি থেকে বর্তমান সমতুল্য ৪৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে। এই সমস্ত ডাচ উপনিবেশের (কলোনি) মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনাম ছিল অন্যতম। অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ওই সমস্ত উপনিবেশের জনগণ প্রতিবাদ করতে গেলে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার, হত্যার মাধ্যমে তা দমন করা হয়। কিন্তু এক সময় তীব্র জনরোষ ও প্রতিরোধের মুখে ডাচ শাসকরা সেই সমস্ত উপনিবেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হন। ওই সমস্ত উপনিবেশ লাভ করে স্বাধীনতা। সুরিনাম ছাড়াও ডাচ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল ইন্দোনেশিয়া।
আয়তনে অতি ক্ষুদ্র একটি দেশ হল্যান্ড। ভাবতে অবাক লাগে এই ছোট্ট দেশটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিশাল দেশ ইন্দোনেশিয়াকে ৩০০ বছর ধরে শাসন ও শোষণ করেছে। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী স্বাধিকার আন্দোলন ও প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ১৯৫০ সালের ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে। ওলন্দাজরা ফিরে আসে। বছর দশেক আগে ইন্দোনেশিয়ার জাভা শহরের বোগোর নামক এলাকায় বিশাল এক বনাঞ্চলে (বোটানিক্যাল গার্ডেন) যাবার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেখেছি ডাচ গভর্নরের চমৎকার দৃষ্টিনন্দন বাসভবন। বর্তমানে সেটি ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের বাসবভন। এটি বোগোর প্যালেস বা বোগোর রাজপ্রাসাদ হিসাবে পরিচিত। ঔপনিবেশিক–যুগে বোগোরের চমৎকার জলবায়ুর কারণে প্রাসাদটি ডাচ গভর্নর জেনারেলের প্রিয় বাসভবন ছিল। ইন্দোনেশিয়ার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি সুকর্ণোরও এটি বিশেষ পছন্দের ছিল এবং ১৯৬৭ সালে তার পতনের আগ পর্যন্ত এটি সরকারী রাষ্ট্রপতি বাসভবনে পরিণত হয়েছিল। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রাসাদটি বেশিরভাগই অব্যবহৃত ছিল। আমরা যখন এই বিশাল বোটানিক্যাল বাগানে ‘ট্যুরে‘ যাই তখন জেনেছিলাম সে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এই বাসভবনেই বসবাস করেন। অবাক হলাম যখন দেখলাম প্রেসিডেন্টের বাসভবন পাহারায় তেমন কোন কড়াকড়ি নেই। মাত্র জনা কয়েক অস্ত্রধারী পুলিশ গেইটের ভেতরে বসে আছে। অতি কাছ থেকে আমাদের ছবি তুলতে দেয়া হলো। এই বিশাল বোটানিক্যাল বাগান নির্মাণে ডাচদের অবদান ছিল। তার নমুনা দেখতে পাই সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময়। বেশ কয়েকটি ভবন দেখলাম, সেগুলোর নাম এখনো ডাচ ভাষায় রয়ে গেছে। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদটি তার স্বতন্ত্র স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। প্রাসাদ সংলগ্ন বিশাল এলাকা জুড়ে উদ্ভিদ উদ্যান। বোটানিক্যাল গার্ডেন ২৮৪,০০০ বর্গমিটার (২৮.৪ হেক্টর) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
২) ফিরে আসি সুরিনামে। দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭৫ সালের ২৫ নভেম্বর। ১৬৬৭ সাল থেকে সুরিনাম ছিল ডাচ উপনিবেশ। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৮৬৩ সালে সুরিনাম এবং অন্যান্য ডাচ–অধিকৃত ভূমিতে ক্রীতদাস প্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়। প্রাক্তন উপনিবেশ সুরিনামের সাথে হল্যান্ডের বর্তমান সম্পর্ক অম্ল–মধুর। বিশাল দেশ সুরিনাম। প্রায় ১৬৩.৮২০ বর্গ কিলোমিটার, হল্যান্ডের চাইতে প্রায় চারগুন বড়। হল্যান্ডের আয়তন প্রায় ৪১,৫৪৩ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা মাত্র ৬৩২.৬৩৮। অন্যদিকে হল্যান্ডের জনসংখ্যা এক কোটি ৮৩ লক্ষ। সুরিনাম যখন স্বাধীন হয় তখন ডাচ সরকার সুরিনামের জনগণকে একটি ‘অপশন‘ দিয়েছিল। বলা হলো, যারা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে হল্যান্ড চলে আসতে চায়, তারা আসতে পারে। সে সময় সুরিনামের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০% নাগরিক হল্যান্ডে চলে আসে। হল্যান্ডে এসে তারা বিশেষ করে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষা–দীক্ষায় বেশ সফলতা অর্জন করে এবং ডাচ মূল জনগোষ্ঠীর সাথে পাল্লা দিয়ে ভালো অবস্থানে আছে। ইউরোপীয় জীবনধারার সাথে তারা সহজে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলে তারা ডাচ জনগণের কাছে তুর্কি, মরক্কীয় জনগোষ্ঠীর চাইতে বেশি গ্রহণীয় ও আদরীয়। মূল ধারার রাজনীতিতেও অনেক সুরিনামী নাগরিক সক্রিয় রয়েছে। রয়েছে ডাচ পার্লামেন্টেও।
৩) এর মাঝেও সুরিনামী সমপ্রদায়ের পক্ষ থেকে ডাচ সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে তাদের দেশে (সুরিনাম) ক্রীতদাস ব্যবসার আড়ালে যে অপরাধ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু ডাচ সরকার দীর্ঘদিন তাতে কর্ণপাত করেনি। কেবল বছর কয়েক আগে বিগত সরকার প্রধান ডাচ প্রধান, মন্ত্রী মার্ক রুতে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর একই অপরাধের জন্যে অনেকাংশে যারা দায়ী সেই রাজ পরিবারের বর্তমান রাজা, উইলিয়াম আলেক্সান্ডার সুরিনামের ৫০ বছরের স্বাধীনতা পূর্তির আগে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারই সূত্র ধরে রাজা উইলিয়াম আলেক্সজান্ডার স্বস্ত্রীক গত ২৫ নভেম্বর সুরিনাম সফর করেন। তিনি তার পূর্ব পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত ক্রীতদাস ব্যবসা ও অন্যায়ের জন্যে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সুরিনামের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ডাচ রাজার এই সফর সুরিনামী জনগণের মাঝে দারুণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং তার পূর্বপুরুষের কৃত অপরাধের জন্যে ডাচ রাজার এই আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়াকে প্রায় সবাই তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। বিগত ৪৭ বছরের মধ্যে ডাচ রাজপরিবারের এটিই ছিল প্রথম সফর। রাজা উইলিয়াম আলেকজান্ডার ভ্রমণের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে দাসপ্রথা যা ১৮৬৩ সালে সুরিনাম এবং অন্যান্য ডাচ–অধিকৃত অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছিল, ‘সেই ইতিহাস থেকে আমরা দূরে সরে যাব না এবং ক্রীতদাস প্রথার বেদনাদায়ক উপাদানগুলি থেকেও দূরে থাকব না।‘ তিনি আরো বলেন, ‘একটি অভিন্ন আগামী গড়ে তোলা কেবলমাত্র তখনই অর্থবহ হবে যদি আমরা বর্তমানে যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছি তা বিবেচনা করি এবং সেই ভিত্তি হল আমাদের ভাগাভাগি করা অতীত।‘ ডাচ রাজার সুরিনাম–সফরকে ঘিরে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল নিহত ক্রীতদাসদের স্মরণে স্মৃতিমঞ্চে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ এবং সফরের প্রথম দিন ক্ষতিগ্রস্তদের বংশধর এবং আদিবাসী সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ ও ভাব বিনিময়। একই দিন আয়োজিত ভিন্ন এক অনুষ্ঠানে সুরিনামী সমপ্রদায়ের নেতারা অতীতের অন্যায়ের জন্যে ডাচ রাজার ক্ষমা প্রার্থনা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। আদিবাসী সমপ্রদায়ের প্রতিনিধি উইলগো ওমেন বলেন, ‘আমরা রাজার ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করলাম এই বিশ্বাসে যে তিনি একটি পরিষ্কার বিবেক নিয়ে দু–দেশের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করতে চান।‘ ক্রীতদাস প্রথা আইন করে বিলুপ্ত হলেও তা এখনো দুর্ভাগ্যজনকভাবে সমানে চালু রয়েছে বিশ্বব্যাপী। সে বিষয়ে পরবর্তী সংখ্যায় লেখার ইচ্ছে রইলো। (চলবে) –১৮–১২–২০২৫
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।












