হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ

ফিরে এলামদক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়া থেকে। ঘুরে এলামনা বলে ফিরে এলামকথাটি এই কারণে বলা যে, দেশভ্রমণ কিংবা দেশদেখা বলতে যা বুঝায় আমার ক্ষেত্রে প্রায় সময় তা হয়ে উঠেনা। আমার কেবল ভিন দেশে যাওয়া ও ফিরে আসা হয়। কাজ নিয়ে যাওয়া, কাজ শেষে ব্যাগ গুছিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঘোরা কিংবা দেশ দেখার অর্থে যাওয়া হয় কম। আর সেই কারণে বলি আমার শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা। তারপরও অল্প কদিনের অবস্থানে স্বল্পদেখায় কলম্বিয়ার যে বিষয়টি ভালো লেগেছে তা হলো সে দেশের জনগণের বিশেষ করে নারীদের শক্তি ও কর্মক্ষমতা। প্রায় সব জায়গায় নারী। নারীরা দোকান নিয়ে বসেছে, সুপারমার্কেটে নারী, মটর সাইকেলে নারী। নারীদের এই যে অবাধ চলাচল, পরনে আধুনিক পোশাক, টাইট জিনস প্যান্ট, স্বল্প বসনসেদিকে কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সবাই চলেছে নিজ নিজ কাজে বা ধান্ধায়। ভালো লেগেছে দেখে সংগীতের প্রতি সবার আসক্তি দেখে। জ্যামাইকার সংগীত শিল্পী বব মার্লি বলেছেন, ‘সংগীতের একটি ভালো দিক হলো, এটি যখন তোমার মন ছুঁয়ে যায়, তখন তুমি কোন ব্যথা অনুভব করোনা।কিউবার দক্ষিণে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ছোট্ট এই দ্বীপে জন্ম নেয়া বিশ্বখ্যাত এই সংগীত শিল্পীর জনপ্রিয়তা সীমাহীন। তার গান সমানে বাজে ইউরোপআমেরিকার বিভিন্ন ক্যাফে, বারে, রেস্তোরাঁয়, নানা পার্টিতে। কলম্বিয়ার যেখানে গেছি, কী শপিং মল, সুপার মার্কেট, রাস্তার ধারে সওদা নিয়ে দোকান সব জায়গায়, এমন কী ট্যাক্সিতেও বেজে চলে গান। বেশির ভাগ স্পেনিশ ভাষায়। গানের কথা বুঝিনা, কিন্তু গানের ছন্দে শরীর আপনাতেই সেইককরে। আর বোধকরি সে জন্যে কলম্বিয়া ছন্দের দেশহিসাবে পরিচিত।

যে শহরে (রিওচা) ছিলাম তা আকারে ও গুরুত্বে ছোট্ট। যানবাহন বা লোকজনের ভিড় তেমনটা চোখে পড়েনি। সকাল ও সন্ধ্যার দিকে দেখতাম রাস্তাঘাটে ভিড়। রাত নয়টার দিকে ধীরে ধীরে ভিড় কমে আসতো। দোকানপাটও বন্ধ হয়ে আসতো। আমরা যেহোটেলে ছিলাম তার সামনের রাস্তা ঘেঁষে নানা ধরনের পসরা নিয়ে বসতো বাজার। সকাল সাড়ে আট নটার দিকে দেখতাম এক কলম্বীয় তরুণী, পরনে প্যান্টগেঞ্জি, একা দোকানের কাঠামো তৈরী করে তাতে নানা ধরনের পসরা সাজিয়েছে। সম্পূর্ণ একা। আবার সন্ধ্যার দিকে সব খুলে প্যাকেটে ভরে কাঁধে নিয়ে ধারেকাছে একটি বাহনে তুলছে। যে কদিন ছিলাম তাকে একা এই কাজটি করতে দেখেছি। তার কষ্ট দেখে আমার কষ্ট হতো। কিন্তু মনে হয় তার অভ্যেস হয়ে গেছে। জীবন ও জীবিকার কারণে মানুষকে কত কিছুই করতে হয়। বেশ কিছু তরুণীকে দেখলাম বাইক নিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে এসে দাঁড়াতে। সীটের পেছনে যাত্রী তুলে নিয়ে এগিয়ে যেতে। পাঠাওজাতীয়। যেদিন হল্যান্ড ফিরবো, খুব ভোরে তখনও এয়ারপোর্টের কাজকর্ম শুরু হয়নি, টেক্সি বিদায় করে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে মূল দরোজার সামনে। তখন অনুমান করি সকাল সোয়া ছয়। একটি বাইক এসে থামলো ঠিক আমার সামনে। নেমে এলো এক যাত্রী। দুজনের মাথায় হেলমেট। যাত্রী নেমে তার হেলমেট খুলে চালককে দিলো। তারপর পকেট থেকে গুনে গুনে কিছু কয়েন দিল। চালকও যখন তার হেলমেট খুলে ফেললো তখন টের পেলাম সে মহিলা। আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বললো স্প্যানিশ ভাষায়। অনুমান করি জানতে চাইছে আমি যাবো কিনা। ইশারায় জানিয়ে দেই না। এদেশে মহিলাদের প্রকাশ্যে অবাধ চলাচল। সহবাস এই দেশে সাধারণ ব্যাপার। এক তথ্যে জানা যায়, বেশির ভাগ শিশু আনুষ্ঠানিক বিয়ের বাইরে জন্মগ্রহণ করে। ২০০০ এর দশকে জন্ম নেয়া শিশুদের জন্ম ৫৫,% বিয়ের বাইরে। অন্যদিকে ২২,% শিশুর জন্ম বিবাহিত মায়েদের ঘরে এবং ২১,% শিশুর জন্ম সিঙ্গল মাদার বা এককমায়েদের ঘরে। মজার ব্যাপার যে মহিলাদের অবাধ চলাচলের এই দেশে কেবল ১৯৯১ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ বৈধ করা হয়। ফিরে আসি সম্মেলনে, যে কারণে এদেশে আসা।

এই ধরনের বৈশ্বিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার আর একটি প্রাপ্তি রয়েছে বলে মনে করি। সেটি হলো নানা দেশ থেকে আসা নানা ধরনের লোকের সাথে পরিচয় ঘটে, আবার অনেক পরিচিতির সাথে অনেক দিনের ব্যবধানে দেখা হয়। দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে। সুদূর কলম্বিয়া এসে দুই অবাঙালির মুখে স্পষ্ট বাংলা শোনাসেটিও ছিল এক মজার অভিজ্ঞতা। তাদের একজন প্রফেসর বিনোদ খাদ্রিয়া। বেঁটেখাটো, চোখে চশমা ভারতীয় এই প্রফেসরও এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে সিভিল সোসাইটির ইন্টারন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য। গেল বছর তাকে জেনেভা মাইগ্রেশন সম্মেলনে দেখেছিলাম। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, হাসিমুখ। অবাক হলাম যখন উনি আমার সাথে সুন্দর উচ্চরণে বাংলা বলা শুরু করলেন। তার সাথে এসেছেন তার স্ত্রী। কিন্তু বেচারি কেবল হোটেলের কামরায় বন্দি হয়ে রইলেন। কেননা আমরা সেই সকালে বের হতাম ব্রেকফাস্ট সেরে, হোটেলে ফিরতাম সন্ধ্যার পর। ভদ্রমহিলা একা যে বেরুবেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে সে উপায়ও নেই। তাই দেখে প্রফেসর বিনোদকে বলি, ‘আপনি ওনাকে এনে কেবল কষ্টই দিলেন।কথাটি তার স্ত্রীকেও বললাম। তার সাথে দেখা ডিনার টেবিলে, হোটেলের ছোট্ট রেস্তোরাঁয়। দেখলাম মহিলাও আমার সাথে বাংলায় কথা বললেন। কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে বলেন, তারা দুজনে আদিতে আসামের। থাকেন দিল্লী। কলোম্বিয়ায় স্ত্রী আসার কারণ হিসাবে জানালেন, এখান থেকে তারা যাবেন আমেরিকা। সেখানে থাকেন তাদের মেয়ে। মেয়েকে দেখে কিছুদিন সেখানে থেকে ফিরবেন দেশে। সম্মেলনের ফাঁকেফোঁকরে দেখা, টুকটাক কথাবার্তা হয় অনেকের সাথে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিন। হলে বসে অপেক্ষা করছি কখন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আসবেন। উনি প্রধান অতিথি। প্রফেসর বিনোদের পাশে আর এক ভারতীয়। মাইগ্রেশন নিয়ে কাজ করেন। তাকে আগেও দেখেছি। কথা তেমন হয়নি। নাম রামাচন্দ্র খুন্তিয়া। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেন। প্রফেসর বিনোদের সাথে বাংলা বলতে দেখে দেখি তিনিও চমৎকার বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন। এর আগে তার সাথে কথা হয়েছে ইংরেজিতে। এবার আমার বেশ অবাক হবার পালা। তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কীভাবে বাংলা শিখেছো? উত্তরে বলে, ‘আমি এসেছি উড়িষ্যা থেকে। আর এক সময় তো বাংলা বিহার উড়িষ্যা এক ছিল। আমাদের ওখানে তো এখনও ভাতের পর মিষ্টি, পান খাওয়ার রেওয়াজ আছে।এমনি দেখা আরো অনেকের সাথে। দীর্ঘ আলাপের সুযোগ নেই ব্যস্ততার কারণে। সবাই ব্যস্ত সম্মেলন নিয়ে, সম্মেলনের বিষয় নিয়ে। আলাপের সুযোগ লাঞ্চ বা কফি ব্রেকে। সেখানেও অভিবাসন বিষয় নিয়ে আলোচনা। তারই ফাঁকে একটু আধটু খেঁজুরে আলাপ।

) এলো ফেরার দিন। আগের দিন সন্ধ্যায় হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে সেখানে বসা কলম্বিয় তরুণীকে গুগুল ট্রান্সলেশন সাহায্য নিয়ে বলি, ‘আগামীকাল ভোর ছটায় আমাকে একটা টেক্সি ঠিক করে দিতে হবে। এয়ারপোর্ট যাবো। ভালো হয় যদি এখনই বুক করে রাখ, যাতে সময়মত আসে।তরুণীটি বলে, আগেভাগে বুক করার প্রয়োজন হবেনা। কাল সকালে ডাকলেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে টেক্সি চলে আসবে।তারপরও মনের ভেতর শংকা থেকে যায়। ভোর সাড়ে চারটায় বিছানা ছেড়ে কামরার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাই। পুরো শহর যেন ঘুমিয়ে আছে। চারিদিকে অন্ধকার। কেবল রাস্তার নিয়নবাতিগুলি জ্বলছে নীরবে। অন্ধকারে একা টেক্সি নিয়ে যেতে ভয় করছিল। তার উপর একা। যাই হোকতড়িঘড়ি করে শাওয়ার নিলাম। পৌনে ছটায় নিচে এসে দেখি রিসেপশনে কেউ নেই। ভড়কে গেলাম। মিনিট কয়েকের মধ্যে রিসেপশনের এক কর্মী এলো। তাকে টেক্সির কথা বললে সে ফোন করে। ঠিক মিনিট পাঁচেকের মধ্যে টেক্সি হাজির। মিনিট দশকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম রিওচা এয়ারপোর্টে। ছোট্ট বিমানবন্দর, চাটগাঁ বিমানবন্দরের চাইতে অনেক ছোট। তখন যাত্রী তো দূরের কথা, এয়ারপোর্টের কোন কর্মচারীরও দেখা মিললো না। কেবল একটি দরজার আঁধখানি খোলা। খানিকবাদে এলো ভেতরে যে কটি দোকান আছে তার কর্মচারীরা। ধীরে ধীরে যাত্রীরা আসতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পালা, তারপর বলা হলো এগিয়ে যেতে। রিওচা থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল কলম্বিয়ার রাজধানীই বোগোতো। সম্মেলনের সেক্রেটারিয়েটকে আমার সীট আপগ্রেড করতে বলেছিলাম। দেখলাম বিজনেস ক্লাসে টিকেট আপগ্রেড করা হয়েছে। ভালো লাগলো। পৌনে দুই ঘন্টার উড়াল দেয়া। নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছুলাম বোগোতা এয়ারপোর্টে। সেখানে দীর্ঘ বিরতি। ট্রানজিটে দীর্ঘ সময় চেয়েছিলাম, যাতে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। হাতে অফুরন্ত সময়। ডোমেস্টিক থেকে বেরিয়ে আমাকে যেতে হবে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে। ভাবলাম তাড়া কী! কফি হাউজে বসে কফি আর কেকের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। যে ছেলেটি সার্ভ করছিল তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাই কফি শপে কিংবা ধারেকাছে কোথায়ও মোবাইল চার্জ দেবার কোন পয়েন্ট আছে কিনা। আমার পাশের ছোট্ট টেবিলে ল্যাপটপ খুলে কফি খেতে খেতে কাজ করছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি নিজ থেকে ইংরেজিতে বললেন, ‘ওই দিকে গেলে পাবেন।আলাপ হলো সামান্য। থাকেন আমেরিকা এবং কানাডায়, তবে মূলত কলম্বিয়। মাইগ্রেশন নিয়ে কথা হলো।

) বোগোতা থেকে উড়োজাহাজ নির্দিষ্ট সময়ে স্টার্ট দিলো। ঘন্টাখানেক উড়াল দেবার পর প্লেন থামলো কার্তেজেনা শহরে। সেখানে রিফুয়েলিং। কিছু যাত্রী নেমে গেলেন, কিছু উঠলেন। আমরা প্লেনেই বসে রইলাম। কবুতরের খুপরির মত প্লেনের জানালা দিয়ে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেই বাইরে। অতলান্তিক মহাসাগর দেখা যাচ্ছে, এতো কাছে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। চমৎকার সোনালি রোদ। আমার পাশের আসনে বসেছিলেন এক যাত্রী। আলাপ হলে জানালেন, তিনি কলম্বিয় কিন্তু দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে বসবাস করছেন সুইডেনের গুটেনবার্গ শহরে। বয়স যখন ২০ তখন তিনি সুইডেন চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী আবাস গাড়েন। ইউরোপে যখন প্রচন্ড শীত তখন স্ত্রী সহ তিনি ছয় মাসের জন্যে কলম্বিয়া আসেন। তবে এবার তিন মাসের মাথায় ফিরে যাচ্ছেন বলে জানালেন। ভালো ইংরেজি বলেন। জানতে চাই, কেমন করছেন আপনাদের প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো?’ ‘তিনি ভালোই করছেন, তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রাট, তিনি চান মানুষের মাঝে সমতা। কিন্তু তিনি সোসালিষ্ট বলে অনেকে আবার তাকে পছন্দ করেননা।ইতিমধ্যে কার্তেজেনা থেকে আমাদের সঙ্গী হয়েছে চারপায়াদুই যাত্রী। তারা শব্দ করতে করতে এলো তাদের মালকিনের সাথে। অনুমান করি তরুণী ইউরোপীয়। বসেছেন আমার সামনে কয়েক সীটের আগে। একুট পর পর কুকুর দুটি ঘেউ ঘেউ করে উঠে। মনে মনে বলি, যাত্রাটা গেল। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন। প্লেন উড়াল দেবার পর থেকে দীর্ঘ পথে কোন শব্দ করেনি নিরীহ প্রাণী দুটো। তাদের শব্দ শোনা গেলো কেবল আমস্টারডামে ল্যান্ড করার ঘন্টা দেড়েক আগে, যখন যাত্রীদের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা হচ্ছিল। অবশেষে দীর্ঘ আট ঘন্টা বিরতিহীন উড়াল দেবার পর আমাদের উড়োজাহাজটি হল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের শিফল এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করলো প্রচণ্ড শব্দে। ফিরে এলাম আমার অল্পকদিনে স্বল্পদেখা কলম্বিয়াকে পিছু রেখে। (সমাপ্ত) – ১০১২২০২৫

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগীতিজীবন : গীতিকবির জীবনালেখ্য
পরবর্তী নিবন্ধগণতন্ত্র ও সামাজিক কাঠামো