ইউরোপে এখন শরৎকাল। তবে যাই যাই করছে। ইতিমধ্যে তার বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেছে। এই সময়টায় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে গাছের পাতাগুলি গায়ে বাসন্তী রং মেখে যেন আহত অভিমানে ঝরে পড়ে। বাসার সামনে, পেছনের বাগান যেখানে যতদূর দৃষ্টি যায়, চোখে পড়ে ঝরা–পাতা, মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ইচ্ছে করে গুনগুনিয়ে উঠি ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে / অনেক হাসি অনেক অশ্রুজলে / ফাগুন দিল বিদায় মন্ত্র আমার হিয়াতলে। / ঝরা পাতা গো বাসন্তী রং দিয়ে / শেষের বেশে সেজেছ তুমি কি এ।‘ শরৎ এলে মনে পড়ে শিউলি ফুলের কথা। কতদিন দেখা মেলেনি শুভ্র পাঁপড়ি আর কমলা রংয়ের বোঁটায় সৌরভ ছড়ানো এই ছোট্ট ফুল। শিউলি ফুলের সাথে শরতের ঝরা–পাতার একটা মিল রয়েছে। ওরা ঝরে পড়ে যেন অজানা অভিমানে। কার সাথে? কিসের অবহেলায়? জানতে ইচ্ছে করে।
২. সকালে ঘুম থেকে উঠে অন–লাইনে দিনের কয়েকটি পত্রিকায় চোখ বুলানো দীর্ঘদিনের অভ্যাস। দিন কয়েক আগে ঢাকা থেকে প্রকাশিত এক দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলাতেই একটি জায়গায় এসে স্থির হয় দৃষ্টি। সংবাদটির শিরোনাম – ‘শিউলি ফুলে ভরা গাছতলা, ফিরিয়ে আনে শৈশবের সকাল।‘ তাতে লেখা -‘রাজশাহী নগরীর পুরানো মসজিদের সামনে রেললাইন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি গাছটি সাদা–কমলা রঙের শিউলি ফুলে ছেয়ে গেছে। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই ফুলে ফুলে ভরে যায় গাছতলা। গত ৩০ বছর ধরে এমনি নিরবচ্ছিনভাবে সৌন্দর্য ও সৌরভ বিলিয়ে যাচ্ছে গাছটি।‘ সংবাদটি পড়তেই মুহূর্তে ফিরে যাই আমার ফেলে–আসা সেই শৈশব–কৈশোরের দিনগুলিতে। আমরা থাকতাম চমৎকার একটি এলাকায়, নাম বয়লিউ এভিনিউ। সেখানে ছিল বাবার সরকারি বাসভবন। মুখোমুখি মোট ১৮/১৯টি বড় মাঝারি আকারের বাংলো–প্যাটার্নের বাসা। প্রতিটি বাসার সামনে কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা বড় মাঠ। যে–সময়কার কথা বলছি তখন এটি ছিল চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে চমৎকার একটি দৃষ্টিনন্দন পাড়া। পাড়াটি তার সৌন্দর্য হারিয়েছে অনেক আগে। বর্তমানে এর এমন বেহাল দশা যে বলতে সংকোচ হয় এখানে আমার বেড়ে উঠা। যাই হোক– আমাদের বাসার বাঁদিকে শেষের বাসাটির সামনে ছিল চমৎকার একটি বড় বাগান। তাতে নাম জানা–অজানা অনেক ফুলের গাছ। লোহার গেইট পেরিয়ে অনাহুত কেউ সেই বাগানে ঢুকতে পারতোনা। বাগানের সীমানার গা ঘেঁষে ছিল মাঝারি আকারের একটি শিউলি গাছ। গাছের কটি ডাল বাগানের বাইরে এসে পড়েছিল। শরৎকালে গাছটি ছেয়ে যেত সাদা আর কমলা রঙের শিউলি ফুলে। ভোরের শিউলি ফুলের সৌন্দর্য কখনোই টের পেতাম না, যদি বাবা আমাদের ভোর রাতে বছরের এই সময়টায় বিছানা থেকে ডেকে না তুলতেন। দুর্গা পূজার দিন কয়েক আগে মহালয়া। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ হতো। সংস্কৃত ভাষায় চন্ডীপাঠের কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সুরেলা গলায় চন্ডীপাঠ এবং এর গানগুলি হৃদয় ছুঁয়ে যেত। আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন মুকুল আপারা। দু–পরিবারের সাথে ছিল গভীর সম্পর্ক। ওই ভোর রাতে মুকুল আপা, তার ছোট ভাই আমার সমবয়সী পাড়ার বন্ধু, বাবুলও আসতো। রেডিও ঘিরে আমরা সবাই বসতাম, শুনতাম। অথচ দুর্গাপূজা ধর্মীয় বিশ্বাসে আমাদের কারো নয়। চন্ডীপাঠ শেষে গায়ে চাদর জড়িয়ে এগিয়ে যেতাম সেই শিউলি গাছের দিকে। তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। যদ্দুর মনে পড়ে কুয়াশাও পড়তো। বাগানের ভেতর ঢোকার উপায় নেই। কিন্তু বাগানের বাইরে মাটিতে শিউলি ফুল পড়ে থাকতো। দেখে মন জুড়িয়ে যেতো। শিউলি ফুল কুড়িয়ে চাদরে ভরে বাসায় ফিরতাম। সুঁই–সুতো নিয়ে মালা গেঁথে ঘরের দেয়ালে যেখানে বুদ্ধের ছবি তাতে ঝুলিয়ে দিতাম। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ওই পত্রিকা আরো লেখে– ‘প্রতিদিন ভোরে এখানে ফুল কুড়াতে আসে এই এলাকার শিশুরা। কেউ ফুল দিয়ে মালা গাঁথে, কেউবা বাড়ি নিয়ে সাজিয়ে রাখে। কেউ পূজার জন্য ফুল কুড়াতে চলে আসে। কয়েক শিশুকে দেখা গেল পলিথিনে ও হাতের মুঠোয় ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা বলে, রোজই তারা ফুল কুড়াতে আসে। তাদের শিউলি ফুলের ঘ্রান ভালো লাগে।‘ সংবাদটি পড়তে পড়তে কেমন যে নষ্টালজিক হয়ে পড়ি। মনে পড়ে সেই ছোট্ট বেলার দিনগুলির কথা। কেন জানি বয়স যত বাড়ছে ততই পুরানো দিনগুলি হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই ফেলে–আসা সময়, ফেলা আসা নিকটজন, দেশ –সবকিছুই তো ফেলে আসা। এখন জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে কেবল তার স্মৃতিটুকু সম্বল করে আগামীর দিকে এগিয়ে যাওয়া, অপেক্ষার পালা অন্তিমযাত্রার দিকে। ।
৩. খুব কম ফুলের নাম আমার জানা। আবার দেখা গেছে নাম জানি, কিন্তু কোন ফুলের যে কী নাম তা জানা নেই। শিউলি, গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলী ফুল ছিল পছন্দের। বেলী ফুলকে নিয়ে আছে মজার ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘বেলী ফুল‘ নিয়ে ছোট্ট কয়েকটি লাইন লিখে বন্ধু ও সহপাঠী মহলে বেশ পরিচিতি লাভ করেছিলাম। সে সময় বিচিত্রা ছিল দেশের একমাত্র জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রায় প্রতি ঘরে শোভা পেতো চমৎকার এই সাপ্তাহিকীটি। এর কিছুদিন আগে জনপ্রিয় অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি সোনার পরিবর্তে ‘বেলী ফুল‘ দিয়ে বিয়ে করে আলোচনার সৃষ্টি করেছিলেন। অবশ্য সে বিয়ে খুব বেশি দিন টেকেনি। কেউ কেউ কৌতুক করে বলেন, বেলী ফুলের বিয়ে, আর কতদিন? শিউলি ফুল আমাদের প্রাণ, দৃষ্টি কাড়লেও এই ফুলকে নিয়ে হুমায়ুন ফরীদির মত আর কেউ এগিয়ে আসেননি। এখন তো যদ্দুর জানি শিউলি ফুল আগের মত দেখা যায় না। শেষ কবে দেখেছি মনে নেই। কম করে হলেও তো পঁয়ত্রিশ বছর হবে। আমাদের পাড়ার একমাত্র শিউলি ফুলের গাছ যেটি ছিল সেটিও শুনেছি অনেক আগেই, অনেক কিছুর মত ইতিহাস হয়ে গেছে।
৪. শিউলি ফুলের আর একটি নাম ‘শেফালী‘। শরৎ ঋতুর শ্রেষ্ঠ শিউলি। শিউলি না ফুটলে শরতের শুভ্রতা যেন অপূর্ন থেকে যায়। এই ফুল যেমন শরৎকালের আগমনীর আভাস দেয়, তেমনি শরৎকালের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তোলে বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবেনা। শুধু কি সৌন্দর্য আর সৌরভ? শিউলি ফুলে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন ফরীদি যেমন এই ফুল দিয়ে বিয়ে করেছেন, তেমনি এই ফুল মুগ্ধ করেছে কবিদেরও। তাইতো শিউলি ফুলের বর্ণনা আমরা পাই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের লেখায়, গানে ও কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন– ‘শারদ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে/ তুমি ঊষার সোনার বিন্দু‘ ; ‘শিউলি–সুরভিত রাতে, বিকশিত জোৎস্নাতে‘। লিখেছেন, ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল / রাতের বায় কোন মায়ায় নিল হায় বন ছায়ায় / ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল / কেন রে তুই উম্মনা।‘ কিংবা ‘হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা, আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা।‘ নজরুল লিখেছেন -‘ শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লীবালা‘; ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে/ শারদ রাতের বুকে ওই‘। মজার ব্যাপার হলো, সাহিত্যে যেমন শিউলি ফুল স্থান পেয়েছে, ঠিক তেমনি এই মন–ভুলানো, প্রাণ–জুড়ানো ফুলকে পাওয়া যায় হিন্দু পুরাণে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে শিউলি ফুল অনেকবার এসেছে। শিউলি ফুলের আর এক নাম ‘পারিজাত‘। কথিত আছে, পারিজাতিকা নামে এক রাজকন্যা সূর্যের প্রেমে পড়ে, তাকে পেতে চান। কিন্তু শত চেষ্টা করেও পাননা। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে রাজকন্যা আত্মহত্যা করেন। তার দেহের ভস্ম পারিজাত বৃক্ষ হিসাবে ফুটে ওঠে। এ যেন নীরব প্রেমের প্রতীক, সূর্যের স্পর্শ মাত্র ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দুর মত। জানা গেছে, হিন্দু দেবতার পূজায় শিউলি ফুলই একমাত্র ফুল যেটি মাটিতে ঝরে পড়লেও তাকে দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়ে থাকে। কেবল কি তাই? শিউলি ফুল রোগও সারায়। বাত, আথ্রাইটিসের ব্যথায় শিউলি পাতা হার্বাল টি তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। এতো গুণে গুণান্বিত শিউলি ফুলের জয় হোক, জয় হোক শেফালির। আজকের লেখার ইতি টানবো একটি উক্তির উল্লেখ করে। ‘ফুলের মত হও, কেননা যে এই ফুলকে নষ্ট করে, চূর্ণ করে তার সেই নিষ্ঠুর হাতেও সে সুবাস ছড়ায়‘। (১২–১১–২০২৫) লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট











