হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

কলম্বিয়ায় আজ প্রথম দিন। হোটেল চেকইন করে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে লবিতে এসে দেখি সবাই সেখানে অপেক্ষমাণ। চেকইন করার সময় আমাদের বলা হয়েছিল সন্ধ্যা সাতটায় লবিতে জড়ো হতে। উদ্দেশ্য সবাই মিলে ডিনার করতে বাইরের কোন রেস্তোরাঁয় যাওয়া। দল বেঁধে আমরা হেঁটে চলি। তখন কেবল সন্ধ্যা, তাতেই দেখি দোকানপাঠ সব প্রায় বন্ধ। রাস্তায় লোকজনের সংখ্যাও তেমন বেশি না। আমাদের দলে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা। তাদের মধ্যে ইংরেজ, বেলজিয়ান, ডাচ, জার্মান, আফ্রিকান, ল্যাটিন আমেরিকান, আমেরিকান, ম্যাক্সিকান, ভারতীয় ইত্যাদি। আছেন বাংলাদেশ থেকে আসা একমাত্র সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধি, সাইফুল হক। আমরা দুজন গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট‘ (জিএফএমডি)-এর সিভিল সোসাইটির ইন্টারন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। এই কমিটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মনোনীত প্রায় ৩৪ মাইগ্রেশন কর্মী ও বিশেষজ্ঞ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সাইফুল হক এই কমিটির একমাত্র সদস্য। দল বেঁধে মিনিট পনের হাঁটার পর আমরা একটি স্থানে পৌছালাম। সেখানে একই ছাদের নিচে মুখোমুখি দশ/বারটা ছোট আকারের টেইকওয়ে জাতীয় নানা দেশের খাবারদোকান। মাঝখানে অনেকগুলি চেয়ারটেবিল পাতানো। আমরা পৌঁছার আগেই অন্য হোটেলে উঠা আরো কিছু প্রতিনিধি সেখানে ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন। ধুমসে আড্ডা দিচ্ছেন। প্রতিটি টেবিলের উপর ছবি সহ খাবারমেন্যু। আমার মুখোমুখি বসেছেন লন্ডন থেকে আসা ঘানার মহিলা স্টেলা ওপকু। মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞ স্টেলাও স্টিয়ারিং কমিটির অন্যতম সদস্য। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে মাইগ্রেশন ইস্যু নিয়ে কাজ করার সুবাদে তার সাথে পরিচয় ও জানাশোনা। আমার বাঁয়ে বসেছিল লন্ডন থেকে আসা আফ্রিকীয় তরুণ, রিচার্ড লেইগ। ডানে সাইফুল হক। আমরা সংখ্যায় বেশি হওয়াতে ওয়েটাররা বেশ সমস্যায় পড়ে গেল। কিন্তু আমাদের সামনে যে আরো বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে তা টের পেলাম যখন এক ওয়েটার হাতের ইশারায় কাছে এলো। এক অক্ষর ইংরেজি জানেনা। তাকে মেন্যু কার্ড দেখিয়ে কোনটা কী জানতে চাইলে সে উত্তরে যা বললো তার কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম। ক্ষণিক বাদে এলো আর এক তরুণ ওয়েটার। সে কিছুটা ইংরেজি জানে। ছবি দেখিয়ে আমরা পছন্দমাফিক অর্ডার দেই। ইতিমধ্যে এসে পৌঁছালে এফ্রেইন জেমেনেজ। ম্যাক্সিকানআমেরিকান। থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। আমার ভালো বন্ধু। তার সাথেও পরিচয় অনেক বছরের। প্রতি বছর কোন না কোন দেশে তার সাথে দেখা হয়, হাসিঠাট্টামশকারি পাশাপাশি সিরিয়াস আলাপ হয়। এখনো বিয়েথা করেনি। ২০১৯ সালে জিএফএমডি সম্মেলনে দক্ষিণ আমেরিকার একুয়াডোর গেলে সেখানে স্থানীয় এক অতি সুদর্শন তরুণী তার প্রেমে পড়েছিল। বলা চলে প্রথম দর্শনেই প্রেম। এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে চাকরি করে তরুণী। সেখানেই পরিচয়। সেবার আমরা একুয়াডোর দিন ছয়েক ছিলাম না। দুএকদিনের মধ্যে তরুণীটি এফ্রেইনকে এমন গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললো যে সে তার নিজের গাড়ি এফ্রেইনকে ব্যবহারের জন্যে দিয়ে দেয়। এক সন্ধ্যেয় ডিনারে এফ্রেইন তরুণীটিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমাদের সবার সাথে বেশ জমে গেল তার। আমরা যেদিন ফিরবো তার আগের দিন তরুণীটি আমাদের সবাইকে চমৎকার এক রেস্তোরাঁয় ডিনারের আমন্ত্রণ জানায়। কলম্বিয়ার মত একুয়াডোরও সংগীতের দেশ। সন্ধ্যায় শুরু হওয়া সে ডিনার পার্টি আড্ডানাচপানীয় সহ অনেক রাত অবধি চলেছিল। কিন্তু ওদের দুজনের সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সে এক দীর্ঘ কাহিনী। পরের কোন এক সংখ্যায় এ নিয়ে লেখা যাবে।

এফ্রেইনের একটি ব্যাপার হলো সে যেদেশে যায় তন্নতন্ন করে দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে বেড়ায়, সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে। কখনোসখনো সম্মেলন ফাঁকি দিয়ে। সেটি টের পাই যখন সম্মেলন শেষে ফিরে গিয়ে সে তার ঘুরে বেড়ানোর ছবিগুলি সামাজিক মাধ্যমে পোষ্ট করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ২০১৬ সালে ঢাকার সম্মেলনে সে এসেছিল। অনেক স্থানে সে একা ঘুরে বেরিয়েছে, যেখানে আমার কখনোই যাওয়া হয়নি। যাই হোক বসে আছি খাবার সার্ভ করবে তারই অপেক্ষায়। এমন সময় দেখি ক্লান্ত পদক্ষেপে এফ্রেইন রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করছে। কাছে এসে হাই, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড বিকাশবলে জড়িয়ে ধরে। দেরী কেন জানতে চাইলে বলে, আমি তো তোমাদের হোটেলে উঠিনি। এসেছি দুদিন আগে, দেশটা ঘুরে বেড়াবো সেই উদ্দেশ্যে।এফ্রেইনের ভাষাগত সুবিধা। স্পেনিশ ভাষা জানে। দেখলেও বুঝা যায় যে দক্ষিণ আমেরিকার। ফলে ঘুরে বেড়াতে তার কোন সমস্যা হবার কথা নয়, যা আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল। সম্মেলনের প্রথম দিন। সম্মেলন শেষে হোটেল ফিরবো। সাথে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রতিনিধি সাইফুল হক। বাস ছাড়তে আরো ঘন্টা দুয়েক বাকি। অনুষ্ঠান শেষে কথা হবে, কিছু আড্ডা, তারপর সবার ধীরে সুস্থে বাসে ফেরা। সবাই এলে তারপর বাস ছাড়বে। ঠিক করলাম, রাস্তার মোড়ে গিয়ে টেক্সি নেই। কিন্তু রাস্তায় টেক্সিকে হাত দেখিয়ে থামতে বললে থামবে কিনা জানা নেই। হল্যান্ডে এই নিয়ম প্রচলিত নেই। সেখানে ফোন করে টেক্সিসেন্ট্রালে ফোন করে টেক্সি ডাকতে হয়। কী করি। এফ্রেইনকে ফোন করে বিষয়টা জানতে চাই। সে বলে, হ্যাঁ, রাস্তায় খালি টেক্সি দেখলে ডাকতে পারো। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়াই আমরা দুজন। ক্লান্ত শরীর। জেট লগ তো ছিলোই, তার উপর মনটাও ফুরফুরে ছিলনা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখি একটি টেক্সি সম্মেলন হলের দিকে এগুচ্ছে । কিন্তু খালি না যাত্রী আছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। দুটো কারণে: এক, তখন সন্ধ্যা নেমেছে, ভালো দেখা যাচ্ছেনা; দুই, কলম্বিয়ার সমস্ত টেক্সির জানালাগুলি কালো। বাইরে থেকে ভেতরে কেউ আছে কিনা, কিংবা ভেতরে কী হচ্ছে কিছুই বুঝার কোন উপায় নেই। কলম্বিয়া আসার আগে আমাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যেন রাস্তা থেকে টেক্সি না নেই। প্রয়োজন হলে যেন হোটেলের রিসেপশনে বলে ডেকে নেই। আগেই বলেছি ড্রাগস, ক্রাইমের স্বর্গরাজ্য কলম্বিয়া। তার ওপর ভাষা জানা নেই। হাত দেখানোর পর ইশারায় যাবে কিনাজানতে চাইলে চালক আমাদের ইশারায় বলে, সম্মেলন সেন্টারের সামনে আসো। সে থামতেই দেখি এক কলম্বিয় তরুণী এগিয়ে এলো, সাথে বড় ব্যাগ। মেয়েটি তার ব্যাগটি গাড়ির পেছনে রেখে চালকের আসনের পাশের সীটে গিয়ে বসে। আমরা হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন ড্রাইভার ইশারায় আমাদের দুজনকে গাড়ির পেছনের সীটে বসতে বললো। একটু ভড়কে গেলাম। তবে তরুণীটি যেহেতু সম্মেলন কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে, তখন ধরে নিলাম সে বিপজ্জনক কেউ না। সীটে বসে ড্রাইভারকে হোটেলের ঠিকানা দেখিয়ে আগে আমাদের নামিয়ে দিতে বলি। মাথা নেড়ে সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাস্তায় গাড়ির বেশ ভিড়। তবে অনিয়ম নেই, কারো মাঝে ট্রাফিক নিয়ম ভেঙে এগিয়ে যাবার প্রতিযোগিতা নেই। দেখে খুব ভালো লাগলো। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়াচ্ছে, যেখানে সিগন্যাল নেই সেখানে ট্রাফিক পুলিশের হাতের উপর নির্ভর করে ট্রাফিক সিস্টেম চলছে। দেখে খুব ভালো লাগলো। মনে এলো দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা তো নয়, অব্যবস্থার কথা। আমাদের টেক্সি এগিয়ে চলে। রাস্তাঘাট জানা নেই। জানা নেই ভাষা। মোবাইলে গুগুল ট্রান্সলেট করে ড্রাইভারকে বার কয়েক জিজ্ঞাসা করে জানতে চাই, আমরা প্রথমে হোটেলে যাচ্ছি তো? সে মাথা নাড়ে। জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হতে চাইছি, কেননা তরুণীটি কোথায় যাবে জানা নেই। সেও এক অক্ষর ইংরেজি জানেনা। অবাক হলাম দেখে যে এ দেশের তরুণ শ্রেণীও খুব একটা ইংরেজি জানেনা বা বলেনা। স্পেনিশ ভাষাই সব জায়গায় চালু। তার পেছনে কারণও আছে। কলম্বিয়া প্রায় ২৫০ বছর স্প্যানিশ শাসনাধীন ছিল। ফলে সে দেশে এবং আশপাশের দেশগুলিতে স্প্যানিশ ভাষাই সরকারি ভাষা হিসাবে চালু হয়। স্পেন কলম্বিয়াকে কেবল শাসন করেনি, সমানে শোষণ করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। ১৭০০ সালের শেষের দিকে কলম্বিয়ার জনগণ স্প্যানিশ শাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং তারই ফলশ্রুতিতে ১৮১১ সালে কার্টাজেনা নগরী স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং তাকে অনুসরণ করে বোগোতা (রাজধানী)। কলম্বিয়ার স্বাধীনতার স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতে। দেশগুলি হলো একুয়াডোর, পানামা, ভেনেজুয়েলা, পেরুর উত্তর অংশ এবং ব্রাজিলের উত্তরপশ্চিম অঞ্চল। তারাও বেরিয়ে আসে স্পেনের শাসন থেকে। কলম্বিয়া দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম স্প্যানিশ উপনিবেশ যা স্পেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। (চলবে)-৩০১০২০২৫।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআলোকিত নক্ষত্র জিনাত আজম
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস এবং বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি