হল্যান্ড থেকে

কেবল ড্রাগস আর অপরাধের স্বর্গরাজ্য নয়, সাহিত্য-সংগীতের লীলাভূমিও কলম্বিয়া -৪

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

আঁধারের অপর পিঠে আলো। সামপ্রতিক কলম্বিয়াভ্রমণ নিয়ে লিখতে গিয়ে কথাটা মনে এলো। ড্রাগস, অপহরণ, রাহাজানি সহ নানা অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসাবে পরিচিত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার যেমন মন্দ দিক আছে, ঠিক তেমনি দেশটির ভালো দিকেরও কমতি নেই। সাহিত্য, সংগীত নিয়ে তো দেশটি গর্বই করতে পারে। প্রথমে আসি সংগীত প্রসঙ্গে। কলম্বিয়ার সংগীত প্রসঙ্গ এলে প্রথমে যে নামটি উচ্চারিত হয় তা হলো, সাকিরা। সাকিরার কথা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। অথচ ওর গান আমারও পছন্দের। সাকিরার গান এমনই জনপ্রিয় যে তাকে আদর করে কুইন অব ল্যাটিন আমেরিকাডাকা হয়। এই প্রায়ভুলেযাওয়া বিষয়টি অর্থাৎ সাকিরার কথাটা মনে করিয়ে দিলেন দৈনিক আজাদীর চীফ রিপোর্টার ও লেখক বন্ধুসম হাসান আকবর। প্রকাশিত লেখার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তিনি লিখলেন, ‘আমেরিকা থেকে সব আয়োজন করেও কলম্বিয়া যেতে পারিনি। সাকিরার দেশটা খুব দেখার ইচ্ছে ছিল। আপনি যাচ্ছেন জানলে চলে আসতাম। সাকিরার কলম্বিয়া দেখতে আমার মৃত্যুর আগের দিন হলেও যাবো।আহারে! মানুষের যে কত ধরনের সাধআহ্লাদ, আশাআকাংখা থাকে। বুঝি অর্থবানদের এমনই সাধ হয়। ওনার এই ইচ্ছের কথা জেনে যে প্রশ্ন মনে জেগেছিল তাহলো, তার যে অনুরাগ, ভালোবাসা তা কি সংগীতের প্রতি, না সংগীতশিল্পীর প্রতি? কৌতুক করে সে কথা তাকে উত্তরে লিখেছিলাম। তবে সে যাই হোক না কেনকোটি শ্রোতাদর্শকের মত কলম্বিয়ার এই গায়িকা আমারও পছন্দের। তার গান দেখতে ও শুনতে ভালো লাগে। উচ্চমূল্য দিয়ে অনেকে তার শোতে যান তাকে দেখতে ও তার গান শুনতে। সাকিরা সুন্দরী, সেক্সি। তার মনমাতানো গানের সাথে তার কার্ভডশরীর নাচানো দর্শকশ্রোতাকে মুগ্ধ করে। সাকিরা কেবল গায়িকা নন, গীতিকারও। তিনি স্প্যানিশ ও ইংরেজি গানে সমান দক্ষ। ইতিমধ্যে তার ১০০ মিলিয়ন রেকর্ডগান বিক্রি হয়েছে। কলম্বিয়ান এই সংগীত শিল্পী সর্বকালের সেরা বিক্রিত রেকর্ডিং শিল্পীদের একজন। এতো গেল তার সংগীতের দিক। গত চার দশকে তিনি তার ক্যারিয়ারে বিভিন্ন প্রশংসা ও পুরস্কার পেয়েছেন। গানের বাইরেও জনসেবামূলক কাজের জন্যে সাকিরা জাতিসংঘ, ইউনিসেফজার্মানি, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, ওয়ার্ল্ড লিটারেসি ফাউন্ডেশন কর্তৃক পুরস্কৃত হন। ফরাসি সরকার তাকে Order des Arts et des Letters সম্মানে ভূষিত করেন। ২০০৯ সালে সাকিরা ল্যাটিন একাডেমি কর্তৃক বর্ষসেরা সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব‘ (পার্সন অব দি ইয়ার) হিসাবে পুরস্কৃত হন। কলম্বীয় হলেও লেবাননের রক্ত তা শরীরে রয়েছে। তার দাদাদাদি স্প্যানিশ ও লেবানীজ বংশদ্ভুত। সাকিরার প্রপিতামহ (বাবার দিক থেকে) লেবানন থেকে কলম্বিয়ার সিনসেলেজো শহরে চলে আসেন এবং সেদেশে স্থায়ী ঠিকানা গাড়েন। কলম্বীয় এই সংগীত শিল্পীর জন্ম ক্যারিবিয়ান সাগরের কাছাকাছি বারাংকুয়ালা শহরে।

কলম্বিয়ায় আরো গুণী ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের কথা পূর্ববর্তী সংখ্যায় লিখেছিলাম। লিখেছিলাম সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (১৯৮২) লেখক, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুইজের কথা। তার সব চাইতে বিখ্যাত উপন্যাস দুটি– ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউডএবং লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরাবিশ্বজুড়ে পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। ল্যাটিন আমেরিকার কবি, লেখক, সাহিত্যিকরা বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে সাহিত্য নিয়ে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাদের কাছে পাবলো নেরুদা অতি পরিচিত একটি নাম। গার্সিয়া মার্কেজ তাকে (পাবলো নেরুদা) ‘বিংশ শতাব্দীর যে কোনো ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিবলে অভিহিত করেছিলেন। চিলির এই কবি, যার আসল নাম নেফতালি রিকার্ডো রেয়েস বাসোয়াল্টো, সবুজ কালিতে লিখতেন। কারণ এই রঙ ছিল তার কাছে আশাজাগানিয়া। তার লেখায় ছিল প্রেমের কবিতা থেকে শুরু করে পরাবাস্তববাদী লেখা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য এবং রাজনৈতিক ইশতেহার। সাহিত্যে তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন ১৯৭১ সালে। গার্সিয়া মার্কুইজ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ১৯৮২ সালে। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আরো যারা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তারা হলেন, গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (চিলি, ১৯৪৫), মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল আস্তুরিয়াস (গুয়াতেমালা ১৯৬৭), অক্টাভিও পাজ (মেক্সিকো ১৯৯০), মারিও ভার্গাস লোসা (পেরু ২০১০)। নোবেল বিজয়ী এই লেখক ও কবিদের মধ্যে চিলির গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কবিহবার পেছনের কাহিনী বেশ মজার। সেটি পাঠকের সাথে শেয়ার না করে পারলাম না। তার আসল নাম লুসিলা গোডয় ওয়াই আলকায়াগা। ১৮৮৯ সালে চিলিতে জন্মগ্রহণ করা এই মহিলা পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং তার প্রথম প্রকাশনা ‘সনেটস অফ ডেথ’, প্রকাশ পেয়েছিল ১৯১৪ সালে। তিনিই হলেন প্রথম ল্যাটিন আমেরিকান নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। লিখতেন ‘গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল’ ছদ্মনামে। তার পেছনেও কারণ ছিল। তার দুই প্রিয় কবিগ্যাব্রিয়েল ডিআনুনজিও এবং ফ্রেডেরিক মিস্ত্রাল (যিনি ১৯০৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন) এর প্রতি শ্রদ্ধা স্বরূপ এই নাম ধারণ করেছিলেন তার লেখায়। ভাবি পৃথিবী ও মানুষ কত বিচিত্র।

উপরের অংশ পড়লে মনে হয় পৃথিবীর এই দিকটা যেন তীর্থভূমি। সাহিত্য প্রেমীদের জন্যে তো বটেই। সংগীত প্রেমীদের জন্যেও। যে কদিন কলম্বিয়ায় ছিলাম, কাজের ফাঁকে যখন কোথাও গেছি, শপিং কিংবা ঘুরতে, লক্ষ্য করেছি সব জায়গায় স্প্যানিশ গান বেজে চলেছে। দোকান, শপিং মল, রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়ে বসা দোকান থেকে শুরু করে টেক্সসি সব জায়গায় স্প্যানিশ গান বেজে চলেছে। ভাষা বুঝিনে। কিন্তু গানের তালে তালে শরীর দোলে। কলম্বিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার সংগীত হল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপে বেশ জনপ্রিয়। এমন নয় যে হল্যান্ডে স্প্যানিশ ভাষার চল রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ক্যারিবিয়ান মিউজিক বেশ জনপ্রিয়। আর সালসাগানের কথা কে না জানে! বাংলাদেশের অনেকে বিশেষ করে যারা গান পছন্দ করেন, চর্চা করেন তাদের কাছে সালসাবেশ পরিচিত। সালসা গানের সাথে যুগল নৃত্য প্রায় দেখা যায়। গানের এমনি ছন্দ বা তাল যে আপনি না চাইলেও আপনার মন তো বটেই শরীরও নাচবে আপনাতে। সালসা ছাড়াও আর যে সমস্ত কলম্বীয় সংগীত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় তা হলো: কাম্বিয়া, ভ্যালেনাটো, জোরোপো, বাম্বুকো, রক, পপ এবং ধ্রুপদী সঙ্গীত। কাম্বিয়াসম্ভবত কলম্বিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত ধারা। এটি পশ্চিম আফ্রিকীয় দাসদের মধ্যে একটি প্রণয়নৃত্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। গানের এই জয় জয়কারের জন্যে বোধকরি কলম্বিয়া দি ল্যান্ড অফ থাউজেন্ডস রিদমবা হাজার ছন্দের দেশহিসাবে পরিচিত। যাই হোকফিরে যাই ক্যারাবিয়ান সাগর পাড়ের এই দেশটিতে আসার প্রথম দিনে।

রিওচা এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পৌঁছে সিঁড়ি বেয়ে এলাম রিসেপশন কাউন্টারের সামনে। সেখানে বেশ ভিড়। বিভিন্ন দেশ থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা প্রতিনিধিরা রেজিস্ট্রেশন নিয়ে ব্যস্ত। রেজিস্টার্ডডেলিগেটের তালিকায় নাম খুঁজে পাবার পর এক এক করে হোটেল চেকইন করছেন। রিসেপশন ডেস্কের এক পাশে মাথা নিচু করে কাজ করে চলেছে আফ্রিকীয় তরুণী, অমু। জেনেভায় এই সম্মেলনের যে কোঅর্ডিনেটিং অফিস রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাথলিক মাইগেগ্রশন কমিশনসেখানে কাজ করে অমু। তার সাথে বছর কয়েকের পরিচয়। গেল বছর জেনেভা সম্মেলনে প্রথম সামনেসামনি দেখা। উল্লেখ্য, কলম্বিয়ার এই সম্মেলন আয়োজনে আই সি এম সি সিভিল সোসাইটির কোর্ডিনেটিং অফিস হিসাবে কাজ করছে। অমুর পক্ষে একা এতো ভিড় সামাল দেয়া কঠিন। তার কথা বলার ফুসরৎ নেই। হাই অমুবলতেই মাথা তুলে চারি চক্ষুর মিলন হতেই মুখে একটু হাসি তুলে ধরে প্রতি উত্তরে হ্যালোবলে আবার কাজে মন দেয়। সেখানে দেখা কলম্বিয় তরুণ, হেক্টরের, অমুর অফিস কলিগ। সে সাহায্য করছে অমুকে। গালভর্তি দাড়ি, মাথার দশা ঠিক তার উল্টো। একটি চুলও অবশিষ্ট নেই। বয়স বড়োজোর ৩০/৩৫, পরনে হাফ প্যান্ট। কলম্বিয়ায় বেশ গরম। ৩৫/৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তখন বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচ। রেজিস্ট্রেশন ও রুমের চাবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমাদের সন্ধ্যা সাতটায় হোটেলের লবিতে জড়ো হবার জন্যে বলা হলো। উদ্দেশ্য সবাই একসাথে ডিনারে যাবে। রিওচা, ছোট্ট শহর। র‌্যাঞ্চেরিয়া নদী এবং ক্যারিবিয়ান সাগরের মোহনায় অবস্থিত শহরটি লা গুয়াজিরাবিভাগের রাজধানী। আছে একটি বালুকাময় সমুদ্র সৈকত। ক্যারিবিয়ান সাগরের গা ঘেঁষে। সাগর তীরে এক পড়ন্ত বিকেলে ক্ষণিকের জন্যে গিয়েছিলাম। ঔপনিবেশিক আমলে, রিওচা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী ছিল। ডুবুরিরা বন্দর থেকে বিপুল সংখ্যক মুক্তা উদ্ধার করতো। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শহরটি কলম্বিয়ার মাঝারি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যিক বন্দর গুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিকাশ লাভ করেছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কী প্রথম দর্শনে শহরটিকে ভালো লাগেনি, কোন অর্থেই। এলোমেলো, অগোছালো, নানা জায়গায় ময়লা আবর্জনা ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। যে সম্মেলনের কারণে কলম্বিয়া আসা সেটি এই শহরে হবার কথা ছিলনা। কথা ছিল ক্যারিবিয়ান সাগর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে ম্যাগডালেনা নদীর তীরে অবস্থিত ব্যারানকুইলা নামের কলম্বিয়ার বৃহত্তম শহরে অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, এ শহরেই মোহনীয় সংগীত শিল্পী সাকিরার জন্ম। কিন্তু একই সময়ে এই শহরে রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে আর একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকায় আমাদের অভিবাসীশীর্ষক সম্মেলনটি রিওচা শহরে শিফট করা হয়। জানতে পারি, এই ব্যাপারে খোদ দেশের প্রেসিডেন্ট পেত্রোর পরামর্শ ছিল। তিনি নাকি শহরটিকে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সরকারিবেসরকারি প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরতে চান, অর্থাৎ মার্কেটিং। দেশের অতি ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট পেত্রো, তার মতের বিরুদ্ধে যায় সে দুঃসাহস কার। প্রেসিডেন্ট পেত্রো এসেছিলেন আমাদের সম্মেলনে, দিয়েছিলেন জ্বালাময়ী ভাষণ। সে কথা আগের সংখ্যায় বিস্তারিত লিখেছিলাম। (চলবে)-১০২০২৫।

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোকসংগীত : গাইনের গীতে নারী
পরবর্তী নিবন্ধসূনীতি ভূষণ কানুনগো : বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ ও নিভৃত গবেষক