যুদ্ধকে আমি প্রচণ্ডভাবে ঘৃণা করি। কারণ যুদ্ধকে যে দেখেছি অতি কাছ থেকে। দেখেছি এর ভয়াবহতা। দেখেছি এর দানব রূপ। মাথার উপরে পাক-হানাদার বাহিনীর হেলিকপ্টার, নীচে আমি ও আমার মত অনেকে, কেউ দৌড়ে গাছ তলায়, কেউবা আশপাশের ঘরের ভেতর আশ্রয় নিচ্ছে। যুদ্ধের কারণে একাত্তরে ঘর, ভিটা, বসতবাটি ছেড়ে, দেশ ছেড়েছে কোটি বাঙালী। যুদ্ধকে এড়াতে প্রাণভয়ে শহর ছেড়ে যখন গ্রামে গেলাম দেখি সেখানেও যুদ্ধ এসে উপস্থিত একটা সময়। চোখের সামনে দাউদাউ করে জ্বলতে দেখেছি গ্রামের বাড়িটি। প্রাণভয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়েছি। পাক-সেনাবাহিনীর সম্মুখে পড়েছি বার কয়েক। বেঁচে গেছি কোনভাবে। যুদ্ধকে ঘৃণা করি। অনেকেই করে। কিন্তু আছে অনেক যুদ্ধবাজ যারা যুদ্ধকে ভালোবাসে। কেবল পুতিন নয়, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মত হাজারো পুতিন এই ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ’ খেলায় মেতেছিল যুগ যুগ ধরে। এই ‘খেলায়’ মেতেছিলেন জুনিয়র জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়ার, সাদ্দাম হোসেন, ইয়াহিয়া, টিক্কা খান, বিন লাদেন এমনি আরো অনেকে। ইতিহাস থেকে জানা যায় ৩৫০০ খ্রীস্টাব্দ থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ১৪.৫০০টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, যাতে কেবল প্রাণ গেছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন লোকের। এই সময়ে মানুষ শান্তিতে বাস করেছিল মাত্র ৩০০ বছর। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সাথে সাথে মানুষ মানুষকে কত কঠিন, যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দিতে পারে সে লক্ষ্যে তৈরী হয়েছে ভয়াবহ মারণাস্ত্র, রাসায়নিক অস্ত্র, আণবিক বোমার পাশাপাশি সিরিয়ায় এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন রাশিয়ার এই অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি পুতিন, সে বেশী দিনের কথা নয়। যুদ্ধ, হত্যাযজ্ঞ দেখেছি প্যালেস্টাইন, আর্মেনিয়া, বসনিয়ায়। সাধারণ নাগরিক হত্যার লক্ষ্যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতিমালায় নিষিদ্ধ। কিন্তু কে কাকে পরোয়া করে, কে শোনে কার কথা। আধুনিক যুদ্ধের দ্রুত ক্রমবর্ধমান ধ্বংসাত্মক পরিণতি ও নতুন নতুন উন্নত পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার ও ব্যবহার প্রসঙ্গে ১৯৪৭ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘আমি জানিনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোন অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করা হবে। কিন্তু চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠি ও পাথর দিয়ে।’ সমপ্রতি অভিযোগ উঠেছে ইউক্রেনকে নিজ আয়ত্তে আনতে না পেরে পুতিন এখন পাঁয়তারা করছেন কেমিক্যাল অস্ত্র প্রয়োগ করে ইউক্রেনকে সারেন্ডারে বাধ্য করতে। ইতিমধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুতিনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। পুতিনকে একইভাবে বর্ণনা করেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। কেননা ইউক্রেনকে অনেকটা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে বোমার আঘাতে। মরছে নিরীহ মানুষ। পুতিনের হাত রক্তে রঞ্জিত।
২. এক সময়ের কেজেবি এজেন্ট থেকে বৃহৎ রাশিয়ার স্বৈরশাসকে পরিণত ভ্লাদিমির পুতিন ধরে নিয়েছিলেন ক্রিমিয়ার মত ইউক্রেনকে দিন কয়েকের মধ্যে নিজ দখলে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তার হিসাবে একটু ভুল ছিল। ‘টু এর ইজ ম্যান’, মানুষ মাত্রই ভুল করে বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। সে ভুল করেছিলেন ভাবলেশহীন ছোটখাট এই রুশ শাসক। নব্বইর দশকে যখন বৃহৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে তখন গর্বাচবকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইয়েলৎসিন। ইয়েলৎসিনের হাত ধরে ক্রেমলিনের মসনদে বসেন পুতিন। হুট্ হুট্ করে সোভিয়েত সাম্রাজ্য ধসে পড়ে পুতিনের চোখের সামনেই। তখন থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন কী করে হৃত সাম্রাজ্য, হৃত সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরব ফিরে পাওয়া যায়। অন্যদিকে দেখা গেল রাশিয়াকে ঘিরে থাকা পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলি একটির পর একটি ন্যাটোর ভেতর ঢুকে পড়ছে। তাতে স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন হন পুতিন। তিনি রাশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্রেমলিনে তার ক্ষমতা বেশ পাকাপোক্ত করে নেন। বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে পুতিন ‘ওয়ার্ল্ড পাওয়ার’ হিসাবে রাশিয়ার হারানো মর্যাদা অনেকটা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। জনগণের মাঝেও তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
৩. তবে নিজ ক্ষমতাকে নিশ্চিত করতে তিনি বেছে নেন গোপন ষড়যন্ত্র এমন অভিযোগ প্রচুর। বিরোধী দল, নেতাকে ভয় ভীতি, হত্যা, গুম করে নিজ ক্ষমতাকে নিশ্চিত করেছেন পুতিন এমন অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে থামিয়ে দেবার লক্ষ্যে তাদের দেশ-বিদেশের মাটিতে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিরোধী নেতা আলেক্সাই নাভানলি। আলেক্সাই নাভানলি পেশায় রুশ এডভোকেট এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী। রাশিয়ার দুর্নীতি, বিশেষ করে অবৈধভাবে পুতিনের অর্থ সম্পদ অর্জনের তথ্য প্রকাশ ও তার কট্টর সমালোচক নাভানলি এক পর্যায়ে দেশের অভ্যন্তরে পুতিন-বিরোধী গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হন। প্রচুর জনসমাগম হতে থাকে নাভানলির ডাকা জনসভায়। পুতিন তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে নাভানলিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন বলে অভিযোগ আনা হয়। যে চক্রটির এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের এক জনের গোপন সাক্ষাৎকার থেকে নাভানলিকে কীভাবে হত্যা পরিকল্পনা করা হয় তার গোটা চিত্র প্রকাশ পায় বিভিন্ন মিডিয়ায়। ভাগ্য ভালো নাভালনি বেঁচে যান এবং জার্মানীতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এলে পুতিন তাকে মিথ্যে অজুহাতে জেলে ভরেন, জেলে ভরেন তার অনেক সমর্থকদের যারা গণতন্ত্রের জন্যে এবং নাভানলির পক্ষে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিলেন। পুতিনের পুলিশ ও পেটোয়া বাহিনী শক্তহাতে সেই আন্দোলনকে থামিয়েছে। তবে ক্রেমলিন নাভানলিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার প্রচেষ্টায় সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অস্বীকার করে।
৪. কেবল যে নাভানলিকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তা ভাবার কোন কারণ নেই। এর আগেও পুতিনের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছেন, যারা তার সমালোচনা করেছেন কিংবা যাদের মনে করা হয়েছে পুতিনের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্যে হুমকী, তাদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে একই পদ্ধতিতে। রাশিয়ার সিক্রেট সার্ভিসের দীর্ঘদিনের এই ‘বিষপ্রয়োগ’ বিরোধী-শক্তি দমনে একটি পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ। ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর উপর বিষ প্রয়োগের কাহিনী খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ২০০৪ সালে আমরা দেখেছি কীভাবে রুশ সিক্রেট সার্ভিস ডায়োক্সিন বিষ প্রয়োগ করে তাকে শারীরিকভাবে বিকৃত করা হয়েছিল। তার অপরাধ তিনি ক্রেমলিন-অনুগ্রহপ্রাপ্ত এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। একই বছর দেখা যায় বিশিষ্ট ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক, আনা পলিটকভস্কায়াকে রুশ নগরী বেসলানে যাবার পথে এক কাপ চা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে। সে যাত্রায় তিনি বেঁচে যান বটে, তবে এই ঘটনার দুই বছর পর তাকে পুতিনের জন্মদিনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে পুতিনের বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ পার পেয়ে যাবে পুতিনের রাশিয়ায় তেমনটি হবার নয়।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। রাশিয়ার এফ এস বি নিরাপত্তা পরিষেবার প্রাক্তন কর্মকর্তা আলেক্সান্ডার লিটভিনেনকো ছিলেন পুতিনের কট্টর সমালোচক। তিনিও বৃটেনের একটি হোটেলে তার চায়ের মাধ্যমে পলিনিয়াম-২১০ তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের সংস্পর্শে আসার পর মারা যান। তাকে মারার পেছনে জড়িত সন্দেহে বৃটিশ পুলিশ দুই রুশ নাগরিক – দিমিত্র কোভতুন ও আন্দ্রে লুগোভয়ের – বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার চেষ্টা করেছিল। বৃটেনের একটি গণ তদন্ত এই উপসংহারে পৌঁছে যে সম্ভবতঃ পুতিন ব্যক্তিগতভাবে তাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। রাশিয়া এই দুই ব্যক্তিকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে এবং লুগোভয়কে পরবর্তীতে পুরস্কারস্বরূপ রুশ পার্লামেন্ট সদস্য করা হয়। ২০১৮ সালে আরেক প্রাক্তন রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তা সের্গেই স্ক্রিপাল ইংলিশ শহর স্যালিসবারিতে এমনি এক স্নায়ু এজেন্টের মাধ্যমে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বৃটিশ তদন্তকারীরা এটিকে স্নায়ু (নার্ভ) এজেন্ট হিসাবে চিহ্নিত করেছিল, যা ‘নোভিচোক’ নামে পরিচিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি গোপন রাসায়নিক অস্ত্র কর্মসূচির অংশ হিসাবে এটি তৈরি করেছিল। রাশিয়া আবারো কোন সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে। যুক্তরাজ্য পুলিশ দু’জনকে ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়েছিল, যারা ছিলেন রুশ সামরিক গোয়েন্দা অফিসার। মজার ব্যাপার এই দুজন – আনাতোলি চেপিগা এবং আলেকজান্ডার মিশকিন – এর আগে রাশিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছিলেন, যা পুতিন ব্যক্তিগতভাবে ভূষিত করেছিলেন। কাহিনী এখানেই শেষ নয়। পুসি রায়ট- নামে যে প্রতিবাদী গোষ্ঠী রয়েছে তার সদস্য পিটার ভারজিলভ। দুই বছর আগে তিনিও মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চিকিৎসার জন্যে জার্মানি নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসকরা বলেন, তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। তারও ভাগ্য ভালো। তিনি বেঁচে যান। ভার্জিলভ বলেন, তার লক্ষণগুলির সাথে নাভানলির খুব মিল ছিল এবং তিনি এই দুই বিষ প্রয়োগের ঘটনার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে পুতিনকে দায়ী করেন। রুশ নিরাপত্তা সার্ভিসের দীর্ঘ দিনের এক্সপার্ট এবং বিদেশে রাশিয়ার গুপ্তচরবৃত্তির ইতিহাস নিয়ে লেখা বই ‘দ্য কম্প্যাট্রিওট’ এর লেখক আন্দ্রেই সোলদাতোভ বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে ক্রেমলিনের নির্দেশ ছাড়া নাভানলির অবস্থানের মত একজন ব্যক্তিকে এই ধরনের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা যেতে পারে। অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে এ যে অতি গুরুতর তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কথা হলো বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট