হল্যান্ড থেকে

অঞ্জলি প্রভা - হল্যান্ডে প্রথম বাংলাদেশী প্রজন্মের ইতি

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:৪৩ অপরাহ্ণ

তিনি চলে গেলেন। চিরদিনের তরে। তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে হল্যান্ডে প্রথম বাংলাদেশী জেনারেশনের ইতি ঘটলো। আর পাঁচ দশ সাধারণ গৃহিণীর মত হলে তাকে নিয়ে লেখার প্রয়োজন বোধ করতাম না। কিন্তু যাকে নিয়ে লিখছি তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। বেঁচে থাকা অবস্থায় তার অনেক কিছু ছিল আমার অজানা, মরণে তার কিছু কিছু প্রকাশ্যে এসেছে। যারা শুনেছেন, জেনেছেন তারা অবাক হয়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছেন। তার যে কীর্তি, অজানাতথ্য তা তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হল্যান্ডের হেগ শহরে যেশোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে উঠে এসেছে তারই প্রাণপ্রিয় দশ নাতিনাতনির ছয় জনের হৃদয় ছুঁয়েযাওয়া স্মৃতিচারণায়। তিনি এই দশ নাতিনাতনির কারো দিদিমা, কারো ঠাকুরমা, সন্তানদের মা, কারো শাশুড়ি। আবার হল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশিদের মাসিমা। তিনি অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়া। হল্যান্ডে প্রথম বাংলাদেশী জেনেরেশনের শুরু তার প্রয়াত স্বামী, সুনীল কান্তি বড়ুয়াকে দিয়ে। চট্টগ্রামের পটিয়া থানার করল গ্রামে জন্ম নেয়া ছোটখাট গড়ন, শ্যামবর্ণের এই সজ্জন ব্যক্তিটি হল্যান্ড এসেছিলেন আজ থেকে ৫৯ বছর আগে ১৯৬৬ সালে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পাঁচ বছর আগে। সুনীল কান্তি বড়ুয়া যখন হল্যান্ড এসেছিলেন তখন এদেশে আমাদের বর্ণের লোকজনের দেখা মিলতো না। হেগ শহরে একদিন এক উন্মুক্তবাজারে তার দেখা একই বর্ণের আর এক ব্যক্তির। নাম সিরাজুল ইসলাম। বাড়ি নোয়াখালি। সেই থেকে দুজনের বন্ধুত্ব, মরণ অবধি। সুনীল কান্তি মারা গেলেন ২০১০ সালে। সিরাজুল ইসলাম এখনো বেঁচে আছেন। জীবনের শেষ বয়সে তিনি হল্যান্ড ছেড়ে স্থায়ী আবাস গড়েছেন পাশের দেশ বেলজিয়ামে। যাই হোক

অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়ার হল্যান্ড আসতে চাননি। গ্রামে গোলাভর্তি ধান, পুকুরভরা মাছ, গরুমুরগি এই সব নিয়ে তিনি বেশ সুখেই ছিলেন। সাথে পুত্রকন্যা। স্বামী বিদেশ থাকেন। কিন্তু বিদেশে আসার চিন্তা কোনদিন মাথায় আসেনি। মাঝপথে উচ্চতর পড়াশোনা করার জন্যে বড় ছেলে এসে যোগ দেয় তার বাবার সাথে। তারই উদ্যোগে দেশের মায়া ত্যাগ করে এক সময় অঞ্জলি বড়ুয়া তার সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া দুই ছেলে ও স্কুল পাশ দেয়া মেয়েকে নিয়ে পাড়ি দেন হল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসভবনের কাছাকাছি এক অভিজাত এলাকায় পাঁচ কামরার বড়সড় ভাড়া বাড়িতে উঠেন সবাই। যখনকার কথা বলছি তখন হল্যান্ডে বাঙালির সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। সবাই নতুন দেশকে মানিয়ে নিতে পারলেও অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়ার মন পড়ে থাকতো দেশে। অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়ার মন দেশে পড়ে থাকার পেছনে আরো একটি যে বড় কারণ ছিল তা হলো দেবর কন্যা, চার বছরের পূরবী। পূরবী জন্মের পর থেকে তার জেঠিমা অর্থাৎ অঞ্জলি প্রভার বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে। জন্মের সময় তার মা খুব অসুস্থ ছিল। হল্যান্ড আসার আগে অঞ্জলি প্রভা একটি শর্ত দিয়েছিলেন। পূরবীকে হল্যান্ড আনতে হবে। বললেই তো আনা সহজ নয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। সেটিও একটা সময় হয়ে গেল। ছোট্ট মেয়ে পূরবী হল্যান্ড এলো। যোগ দিল বড়ুয়া পরিবারে। এখন অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়ার পরিবার ষোলকলায় পূর্ণ। নুতন উদ্যোমে তিনি লেগে গেলেন ছেলেমেয়েদের বড়করতে।

দুই মেয়ে স্কুল পড়ুয়া। বাসার কাছেই বাসস্ট্যান্ড। কোন প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু দেশ থেকে আসা অঞ্জলি প্রভার মন কিছুতেই সায় দেয় না। তিনি বাসস্ট্যান্ড অবধি যাবেন। আবার স্কুল ফেরত সেই বাসস্ট্যান্ডে তার অপেক্ষা। গায়ে ওভারকোট জড়িয়ে ভাষা নাজানা এই মহিলা একা অন্ধকারে হেঁটে গিয়ে অপেক্ষা করতেন কখন ওরা স্কুল থেকে ফিরবে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এমনটি করেছেন। স্বামী কাজে যাবেন, ছেলে মেয়ে স্কুলে যাবেসবার জন্যে খাবার তৈরী করা, ঘর সামলানো সব তার একার দায়িত্ব। এর বাইরে রয়েছে তার অতিথিশালা। হল্যান্ডে তখন বাংলাদেশের কোন দূতাবাস ছিলনা। তার বাসার কাছেই ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল স্টাডিজ (আইএসএস)। সেখানে ফিবছর দেশ থেকে উচ্চতর পড়াশোনা করতে আসতেন সরকারি আমলা থেকে শুরু করে সাংবাদিক, চাকরিজীবী, নানা পেশাজীবীরা। ঈদ কিংবা অন্য কোন অনুষ্ঠানে সুনীল কান্তি বড়ুয়ার বাসায় আয়োজন হতো বিশাল ভোজের। সে নব্বই দশকের শুরুর দিককার কথা, যার সাক্ষী আমি নিজে। এই ধরনের আয়োজন তারও আগ থেকে করা হতো ওনার বাসায়। হিন্দুমুসলিমখ্রিস্টানবৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সবাই মিলিত হতেন সুনীল কান্তি বড়ুয়ার বাসভবনে। আর এই আয়োজনের পেছনে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করে যেতেন সুনীল বড়ুয়ার সহধর্মিণী, অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়া। কারো কাকিমা, কারো বৌদি, কারোবা মাসিমা। তাদেরই একজন আকতার আহমদ। সরকারি কর্মকর্তা। তিনি এসেছিলেন ১৪ মাসের মাস্টার্স কোর্সে। সাথে তার স্ত্রী মিলি ও সন্তান আদিব। এক পর্যায়ে তারা এই বড়ুয়া পরিবারটির অন্যতম সদস্য হয়ে যান। ছোট্ট আদিব অঞ্জলি প্রভাকে ডাকতো বুবু। অবাক হয়েছিলাম যখন দেখি বড় হয়েও, এমন কী বিয়ে করে যখন কানাডায় থিতু হয়ে বসেছে তখনও সে বার দুয়েক তার অসুস্থ বুবুকেদেখতে হল্যান্ড এসেছে। অবাক হয়ে ভাবি তার বুবুতাকে কোন স্নেহ, কোন ভালোবাসায় আবদ্ধ করেছে যে সে বড় হয়েও সে কথা মনে রেখেছে এবং ঘুরে ফিরে এসেছে তার কাছে? দিন কয়েক আগে তার বাবা, আকতার আহমদ, বর্তমানে সিনিয়র সচিব, নির্বাচন কমিশন, গত ১০ সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে আমার সহোদর, বিমান বড়ুয়া চৌধুরীর সাথে অঞ্জলি বড়ুয়ার মরদেহ গ্রহণ করেন। আজ থেকে ১৫ বছর আগে যখন সুনীল কান্তি বড়ুয়ার মরদেহ নিজ গ্রাম করল পৌঁছে, শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন আকতার আহমদ। তার একটি অডিও বার্তা আজ হাত ঘুরে আমার কাছে এসেছে। তার কিছু অংশ পাঠকের জন্যে তুলে ধরলাম। তিনি বলেন, ”আমার নাম আকতার আহমদ। নির্বাচন কমিশনে সচিব হিসাবে কাজ করছি। আমি কাকীকে চিনি ১৯৯০ সালের শেষ দিকে যখন আমি নেদারল্যান্ডস গিয়েছিলাম পড়াশোনা করার জন্যে। ওখানে আমার স্ত্রী এবং সন্তান আদিব আমাদের সাথে ছিল। কাকীকে দেখেছি একজন অত্যন্ত মাতৃসুলভ ভদ্রমহিলা হিসাবে, যিনি আমাদেরকে নিজ সন্তানদের চাইতেও বেশি আপন করে নিয়েছিলেন। প্রকারান্তরে, আমাদের আদিব ওনার কাছে হয়ে গিয়েছিল বড় নাতি। আমাকে উনি ‘কাকাবাবু’ বলে ডাকতেন, আমার স্ত্রীকে বলতেন বৌমা। তিনি বলতেন, ‘তোমরা প্রতি সপ্তাহে আমার এখানে আসবে এবং সময় কাটাবে।যদি কোন কারণে, হয়তো পড়াশোনা বা বাইরে ঘুরতে গেছিকোন সপ্তাহে যদি যাওয়া না হতো, কাকী মনে করতেন আমরা হয়তো ওনার বা ওনাদের কোন কথায় দুঃখ পেয়েছি। তিনি পরবর্তীতে দেখা হলে বলতেন, ‘আমি কি কোন ভুল করেছি?’ একটা মানুষ কতটা উদার হলে নিজেকে আমাদের কাছে এইভাবে তুলে ধরতেন। কাকীকে নিয়ে এমন অনেক স্মৃতি আছে। বড়ুয়া কাকা, কাকী এবং তাদের পরিবার অসাধারণ একটি পরিবার। যাদেরকে আমরা সবসময় মনে রাখবো এবং রেখেছি। আমাদের সম্পর্কটা একটা পরিবারের মতো এবং তা বিচ্ছিন্ন হবার মত না। কাকার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আমরা গ্রামে উপস্থিত ছিলাম। কাকীর অনুষ্ঠানে ইচ্ছে সত্ত্বেও থাকতে পারছি না। এর মানে এই নয়, কাকী আমাদের মনের ভেতর নাই। বরঞ্চ বলি, তিনি আমাদের মনের মধ্যে সব সময় থাকবেন এবং এটা আমরা আজীবন মনে রাখবো।’ কী গভীর ভালোবাসা থেকে এই সমস্ত শব্দাবলী উচ্চারিত আকতার আহমদের কণ্ঠে।

অঞ্জলি প্রভা ছিলেন হাস্যরসে ভরা এক স্নেহময়ী দিদিমা/ঠাকুরমা। সে পরিচয় পাই যখন তার নাতি দিব্য চিরবিদায় অনুষ্ঠানে বলে, ‘ঠাকুরমাকে চিনেছি এক দৃঢ়চেতা মহিলা হিসাবে, যার রসবোধ অনেক বেশি। এমন কী তার মৃত্যুশয্যায় শেষবারের মত দেখা করতে গেলে তিনি মজা করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কবে বিয়ে করবো। দেশি না বিদেশী? মুখে সেই চিরপরিচিত হাসি।পরিবারের প্রথম নাতনী সপ্তর্ষি বলে, ‘আমার জন্মের সময় দিদিমা যেমন উপস্থিত ছিলেন, মায়ের পাশে ছিলেন সর্বক্ষণ, ঠিক তেমনি বাকি নয় নাতিনাতনির জন্মের সময়ও পাশে ছিলেন। আমাদের সবার যত্ন নেয়া যেন তার জীবনের একটি ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের বাবামা যখন কাজ করতেন তখন তিনি আমাদের দেখভাল করতেন। কখনো আমরা তিনজন এক সাথে থাকতাম। আবার কখনো সাতআটজন। আমরা কেউ ডেকেয়ারে যাইনি।ডাক্তারি পড়ুয়া নাতনি খুশির অনুভূতি -‘যখন আমি মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হই তখন ঠাকুরমা খুব খুশি হয়েছিলেন। অচেনা এই দেশে এসে তিনি আমাদের জন্যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়ার এই চিরবিদায় অনুষ্ঠানে তার নাতিনাতনিদের অন্তরছোঁয়া স্মৃতিচারণ উপস্থিত সবাইকে কাঁদিয়েছে। নাতিনাতনিদের মধ্যে আর যারা স্মৃতিচারণ করেছে তারা হলো, ইঞ্জিনিয়ার অতীশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নাতনি দীপিকা এবং লন্ডন থেকে ভিডিওযোগে নাতি ধ্রুব। শেষ করবো অঞ্জলি প্রভা বড়ুয়ার সাথে আমার কিছু স্মৃতিচারণ করে। বাড়ির বড় জামাই। আদরের কমতি ছিলনা। জামাই বাসায় গেলে কী খাওয়াবে, কোথায় বসাবে, খাবারের পর একটু বিশ্রামের জন্যে বিছানায় নুতন বিছানার চাদর বালিশ দেয়া, ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন তিনি। প্রতি বছর তিনি আমাকে একটি দামি শার্ট উপহার দিতেন। নিষেধ করলেও শুনতেন না। এই বছরের উপহার পাবার পর দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, ‘এই শেষ, আর তো দিতে পারবোনা।তাকে আশ্বাস দিয়ে বলি, ‘আমি আরো একটা শার্ট চাই।‘ ‘অদ্দিন টিকবোনা,’ তার উত্তর। তিনি টিকলেন না। তিনি চলে গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে। যাবার আগে মেয়েকে বলে গেলেন, তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কারো কাছ থেকে যেন কোন টাকা না নেয়। কেউ দিতে চাইলে, তারা সেই টাকা যেন দেয় গরিবকে, তাহলেই আমি পাবো।তিনি ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। স্বামী মারা যাবার পর তিনি একা তার স্বামীর বাসায় ছিলেন। মেয়ে বা ছেলে কারো বাসায় যাননি। বলতেন, ‘এখানে আমি আছি, স্বাধীন, কারো গলগ্রহ হতে চাইনা।তার দশ নাতিনাতনিরা যখনই তাকে দেখতে গেছে, তাদের প্রত্যেককে তিনি জোর করে ১০/২০ ইউরো থেকে ৫০ ইউরো দিতেন। তার মৃতদেহ দেশে নিয়ে যাওয়া সহ হল্যান্ড এবং দেশে তার শেষ বিদায় অনুষ্ঠান করতে কম করে হলেও ১৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এর সমস্ত খরচ তিনি দিয়ে গেছেন। মরণেও তিনি কারো উপর নির্ভর হতে চাননি। তাই বলি, জীবনে তাকে যতটুকু জেনেছি তার চাইতে অনেক বেশি জেনেছি তার মৃত্যুর পর। গত ৩১ আগস্ট তিনি হল্যান্ডে তার নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তার প্রতি রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। (১০০৯২০২৫)

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজনপ্রতিনিধি সমাচার ও কিছু ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধসকলের প্রত্যাশা সুষ্ঠু নির্বাচন