হল্যান্ড থেকে

অসম্বদ্ধ সংলাপ : বয়স ও ইচ্ছে-ঘুড়ি

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

নদীর স্রোতের মত সময় বয়ে চলেসে আমরা সবাই জানি। তেমনি বয়ে চলে মানুষের বয়স। চাইলে নদীর স্রোত পরিবর্তন করা সম্ভব। গতিও পরিবর্তন করা যায়। কিন্তু বয়স? না, সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে ভাবি মানুষ যদি সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ ‘সৃষ্টি’ হয়, তাহলে তাকে এতো কম বয়স দিলেন কেন? অথচ একটি কচ্ছপসে বাঁচে গড়ে ১৯০ বছর। এক তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সব চাইতে বেশি বয়েসী কচ্ছপ ২৫৫ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিল। সেটি মারা যায় ২০০৬ সালে। আফ্রিকার উপকূল থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত দক্ষিণ অতলান্তিক মহাসাগরের একটি দ্বীপ সেন্ট হেলেনা। সেখানে ছিল এই প্রাণীটির অবস্থান। অথচ সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জীবন কত স্বল্পস্থায়ী। অন্যদিকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শারীরিক ও ইচ্ছে শক্তিও কমতে থাকে। কমতে থাকে কাজেবেড়ানোয় আগ্রহ, উৎসাহ, উদ্যম। একটা সময় ছিল যখন পেশাগত কাজে বিদেশভ্রমণ থাকলে ‘রথ দেখা কলা বেচা’ দুটোই হবে ভেবে খুব উৎফুল্ল হতাম, ভালো লাগতো। যদিও বা কাজের ব্যস্ততায় রথ দেখা বা কলা বেচা কোনোটাই ভালোভাবে হয়ে উঠতো না। এই ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’ প্রবাদের মর্মার্থ হয়তো পাঠকদের জানা থাকবে, যা হলো ‘একটি কাজ করতে এসে আর একটি কাজ করা’। তবে সকলপাঠকের এই প্রবাদের পেছনের গল্প জানা আছে কিনা সে নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই প্রবাদের সাথে জড়িয়ে আছে মাহেশের রথের ইতিহাস। কথিত আছে ভারতের জগন্নাথ পুরীর রথ হলো সবচাইতে বড় রথ। এই রাজ্যে প্রচুর বড় রথযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তবে একটি স্থানের রথযাত্রা সবাইকে আকর্ষণ করে সবচাইতে বেশি। সেটি হলো প্রাচীনতম মাহেশের রথ। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এক উপন্যাসে মাহেশেররথের উল্লেখ আছে। প্রশ্ন হলো, রথের সাথে কলার কী সম্পর্ক। প্রথা অনুযায়ী রথযাত্রায় ভক্তরা দেবতাকে উৎসর্গ করেন কলা, সাথে পান। পানের মত হালকা জিনিস ছুঁড়লে রথের ওপর থাকা দেবমূর্তির কাছে পৌঁছুবে না। এই আশংকা থেকে সম্ভবত কলা জড়িয়ে পান, জিলিপি ছোঁড়ার চল শুরু হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে পুরীর পর মাহেশের রথই হলো ভারতের প্রাচীনতম রথ যাত্রা। আর মজার ব্যাপার হলো, এই প্রবাদ কেবল বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত। ধর্মীয় বিশ্বাস এই যে, মাসির বাড়ি যাবার পথে খিদে মেটাতে এইগুলি ছিল জগন্নাথ দেবের প্রিয় খাবার। সেই থেকে কলা ছোড়ার প্রথা চালু। আর এই কলা সরবরাহ করতেন আশপাশ গ্রামের চাষিরা। তারা রথযাত্রার দিন কলা বিক্রি করতে আসতেন। সেই থেকে ‘রথ দেখা এবং কলা বেচা’ প্রবাদটি চালু হয়েছে বলে ধরা হয়। মজার ব্যাপার বটে। আমার ক্ষেত্রে রথ হলো ভিন দেশে অনুষ্ঠিত সম্মেলন কিংবা মিটিং। কখনো অংশগ্রহণকারী, কখনো বক্তা হিসাবে। কিন্ত দিন শেষে দেখা যায়, আমার রথ দেখাই কেবল হলো, কলা আর তেমন বেচা হলো না।

মনে আছে, আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে দিন পাঁচেকের জন্যে যেতে হয়েছিল মরিশাস। উদ্দেশ্য মাইগ্রেশনসম্পর্কিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ। আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে, ভারত মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপরাষ্ট্র হলো মরিশাস। সে দেশে প্রচুর ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিকের বসবাস। দাসপ্রথা বিলুপ্তির আগে ১৭২১ থেকে ১৮১০ সালের মধ্যে ভারত থেকে কমপক্ষে ১২.০০০ শ্রমিককে আনা হয়েছিল সে দেশে। এদের বেশির ভাগই ছিল দাস যদিওবা তাদের মধ্যে ছিল দক্ষ পাথর মিস্ত্রি, কামার, কাঠমিস্ত্রি। তাদের পরবর্তী জেনারেশন শিক্ষিত হয়ে অনেকে ভালো অবস্থানে আছেন, কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছেন। প্লেন থেকে নেমে দেখলাম এয়ারপোর্টের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে মোমবাতির পাত্র। তাতে জ্বলছে বাতি। চারিদিকে উৎসব উৎসব ভাব। জানলাম সেদিন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেয়ালী (দীপাবলি) উৎসব। পরে জেনেছিলাম সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হিন্দু। ছোট্ট দেশ কিন্তু এর রয়েছে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। ছুটিতে কিংবা কোন অবকাশে বেড়ানোর জন্যে ইউরোপীয়দের জন্যে মরিশাস হলো তীর্থভূমির মতো। সে দেশে যাচ্ছি শুনে অফিসের ডাচ কলিগ, ঘরের জন ও পরিচিতজনরা সাথে সাথে অনেকটা লাফ দিয়ে উঠে বলে, ‘ওহ মাই গড, তুমি কী ভাগ্যবান, মরিশাস যাচ্ছ।’ ওদের মত উচ্ছাস আমার হয়না। কেননা বেশ কিছু দায়িত্ব মাথায় ছিল। পেপার তৈরি করা, সেগুলি উপস্থাপন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আমার প্রথম মরিশাস যাওয়া। কলা বিক্রি করতে না পারার কারণটা উল্লেখ করে শেষ করবো এই পরিচ্ছেদ। চমৎকার যে হোটেলে আমাদের থাকার আয়োজন, সেটি একেবারে ভারত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে। মহাসাগরের এত কাছে যে সন্ধ্যা বেলায় কিংবা রাতে হোটেলকামরার জানালা খুললে ঢেউয়ের শব্দ শোনা যেত। যখন চেকইন করি তখন প্রায় বিকেল। অতটা খেয়াল করিনি। সন্ধ্যে বেলায় রিসেপশন। তাই তড়িঘড়ি করে চেকইন সেরে, রুমে ব্যাগ রেখে টেক্সি ডেকে রওনা দেই নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে সম্মেলনে আসা প্রতিনিধিদের রেজিস্ট্রেশন ও ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। পরদিন ব্রেকফাস্ট করতে এসে যখন নিচে নামলাম, তখন আক্ষরিক অর্থে আমি বাকরুদ্ধ। চমৎকার অপূর্ব সে দৃশ্য। বর্ণনা করি সে সাধ্য নেই। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে লম্বা টানা ওপেনএয়ার রেস্তোরাঁর কয়েক হাত দূরে। সকাল নটায় গাড়ি এসে অপেক্ষা করবে হোটেলের সামনে। আমাদের নিয়ে যাবে নির্দিষ্ট হল ঘরে। হাতে কিছুটা সময় তখনও। হেঁটে যাই কিছুদূর মহাসাগরের পাড় ধরে। সামনে বিশাল জলরাশি। কেবল পানি আর পানি। অবাক আমি, নির্বাক তাকিয়ে থাকি। আর মনে মনে ভাবি এই বিশ্বের কত ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র আমরা। এই মহাবিশ্বের কোন এক কোণায় আমাদের অবস্থান। খানিক হেঁটে ফিরে আসি হোটেলে। এরপর বাকি যে পাঁচ দিন মরিশাস ছিলাম, আর কিছু দেখা হয়নি, কোথায়ও যাবার সুযোগ হয়নি। কেবল এক দুপুরে সম্মেলনলাঞ্চ শেষে আমার এক বিদেশি বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। এই হলো আমিবেচারার ‘কলা বেচা’।

পাঁচ দশ বছর আগে আমার কাছে পথের দূরত্ব কোন বিবেচ্য বিষয় ছিল না। তারপরও শূন্যে এক নাগাড়ে প্রায় বার ঘন্টা থাকার মত একটি দূরদেশে যাবার আমন্ত্রণ যখন এলো, তখন কিছুটা দ্বিধা হয়েছিল বৈকি ছিল। দেশটি ছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশ, একুয়াডোর। সম্মেলনের স্থান রাজধানী কিটো। কলম্বিয়া ও পেরুর প্রতিবেশি দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার মিটার উপরে এই রাজধানী শহর। বিশ্বের সব চাইতে উঁচু স্থানে অবস্থিত প্রতিবেশি দেশ বলিভিয়ার রাজধানী, লা পেজের পর কিটোর স্থান। হল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে যেতেও আকাশপথে সব মিলিয়ে কম না। প্রায় ১২১৩ ঘণ্টা, তবে তাতে মাঝখানে ট্রানজিট রয়েছে। দুবাই, দোহা, দিল্লি কিংবা ইস্তাম্বুল। ট্রানজিটে নেমে একটু এদিকওদিক হাঁটাহাঁটি করা যায়। কিন্তু এক নাগাড়ে ১২ ঘণ্টা শূন্যে থাকা বেশ দীর্ঘ ও অসহনীয় মনে হয়। মন ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না যাবো কি যাবো না। অন্যদিকে, নুতন দেশ দেখার হাতছানি। অনেকের যাবার সুযোগ হয়না। এমন সুযোগ হাতছাড়া করবো? শেষ পর্যন্ত ইচ্ছের জয় হলো। তবে দীর্ঘযাত্রায় কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম বৈকি। ঠিক করেছিলাম আর নয়। কিন্তু বছর দুয়েকের মাথায় এলো আরো একটি আমন্ত্রণ। একই দেশে, একুয়াডোর এবং রাজধানী কিটোয়। সম্মেলনের বিষয় মাইগ্রেশন। এবার আর দ্বিধা নয়। কেননা দলে যারা ছিলেন তারা সবাই বন্ধু, পরিচিতজন। একসাথে একই বিষয় নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করছি। তার মধ্যে দুজন কাছের। একজন রাষ্ট্রদূত আর্তেরো, অন্যজন মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞ হোসে। দুজনের আদিনিবাস একুয়াডোর। তবে প্রথমজনের কর্মক্ষেত্র জেনেভা, অন্যজনের লন্ডন। স্বীকার করতে সংকোচ নেই, মরিশাসে কলা বিক্রি করতে না পারলেও একুয়াডোরে সেই নাপারাটা অনেকটা উশুল হয়েছিল। সম্মেলনের ফাঁকে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। তার বর্ণনা এই পাতায় পৃথকভাবে বর্ণনা দিয়েছিলাম।

যে কারণে এই লেখা শুরু। সপ্তাহ খানেক আগে আর এক সম্মেলনে অংশ নেবার আমন্ত্রণ এলো। এবার আমন্ত্রণ এসেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ, কলোম্বিয়া যাবার। ছয়দিনের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। বিষয় মাইগ্রেশন। তাতে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা যোগ দেবেন। বাংলাদেশ থেকেও কয়েক সরকারি কর্মকর্তা এবং সিভিল সোসাইটির এক প্রতিনিধি যোগ দেবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় চারশত প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দেবেন। সে এক বিশাল যজ্ঞ। সীমিত বাজেটের কারণে এবার প্রতিনিধি নির্বাচনে ছিল বেশ কড়াকড়ি। নির্বাচন যখন চূড়ান্ত হলো, আমন্ত্রণ পত্র যখন হাতে এসে পৌঁছুলো তখন স্বাভাবিক নিয়মে আনন্দিত আবার কথা। আনন্দিত হয়েছি এতে কোন সন্দেহ নেই। আমন্ত্রণ পত্র না এলে নিজের যোগ্যতা, গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহ হতো। এর কদিন পর যখন মেইলযোগে টিকেট এলো তখন দেখলাম আমস্টারডাম থেকে কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা পৌঁছুতে বিরতিহীন প্রায় ১৪ ঘণ্টার ফ্লাইট এবং চার ঘণ্টা বিরতির পর পৌনে দুই ঘন্টা উড়াল দিয়ে ছোট্ট শহর, রিওহাচা, যেখানে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন সম্মেলন, ‘গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট’ সংক্ষেপে জিএফএমডি। এতো দীর্ঘ আকাশ ভ্রমণ। কিন্তু লক্ষ্য করি আগের মত নতুন দেশ যাবার আগের যে উত্তেজনা তা অনেকটা মিইয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে বয়স বেড়ে চলেছে, কমছে শরীর ও ইচ্ছে শক্তি। গিন্নী উৎসাহ দেয়। আমেরিকা থেকে চলতি সপ্তাহে দেশে বেড়াতে আসা ভাইপো বলে, ‘ঘুরে আসুন কাকা, ডালাস থেকে আমি এলাম না? প্রায় ১৬ ঘন্টা জার্নি।’ ওদের উৎসাহে সংশয়, দ্বিধাকিছুটা কাটে, অনুমান করি। আগামীতে লিখবো দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সে আশায়।

(২০২৫)

লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধপোশাক শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যও রপ্তানির উদ্যোগ বাড়াতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতারণার দৌরাত্ম্যে আশঙ্কিত সমগ্র জনগণ